ভারত-বাংলাদেশ দীর্ঘ চিত্রনাট্যের শেষ মহানায়ক। তিনি হলেন ভারতের সর্বোচ্চ তথা রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হওয়া দেশের সবচেয়ে শ্রদ্ধাভাজন ও সবচেয়ে সিনিয়র বাঙালি রাজনীতিবিদ। কলামিস্ট ও গ্রন্থাকার সুনন্দা কুমার দত্ত রায় একবার প্রণব মুখার্জি সম্পর্কে বলেছিলেন, তিনি হলেন, ‘ভারতের কখনো না পাওয়া সেরা প্রধানমন্ত্রী।’ প্রণব হলেন কংগ্রেসের ‘হাই কমান্ড’সংস্কৃতিকে চ্যালেঞ্জ করা বাঙালি রাজনীতিবিদদের দীর্ঘ তালিকার থাকা লোক, যিনি কেবল ফেরার জন্যই দল ত্যাগ করেন এবং তারপর মেধাবলে প্রাপ্য আদায় করেন । প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অবসর গ্রহণ করা মনমোহন সিং সম্প্রতি বলেছেন, তার চেয়ে প্রণব হতে পারতেন অনেক ভালো প্রধানমন্ত্রী। মনমোহনের অবস্থান ও বিশাল হৃদয়ের কথা বাদ দিলেও তার এই মন্তব্যটি অবশ্যই যথার্থ। ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জ্যোতি বসুকে নির্বাচিত করা হলে অ-কংগ্রেস ও অ-বিজেপি প্লাটফর্মের সফল হওয়ার একটি সুযোগ সৃষ্টি হতো। কিন্তু তার নিজের দল সিপিআইয়ের (এম) পিগমিদের কারণে তা হতে পারেনি। ওই দলের ভাবনায় ছিল অন্য কিছু। আর তাতে করে জাতীয় রাজনীতিতে একটি শক্তি হিসেবে বামদের আত্মপ্রকাশের একটি সুযোগ নষ্ট হয়ে যায়। বিবিসির সাথে আমাকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে জ্যোতি বসু যথার্থভাবেই সেটিকে ‘ঐতিহাসিক ভুল’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। অন্তত ২০০৯-২০১৪ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রণব মুখার্জিকে গ্রহণ করা হলে ২০১৪ সালে কংগ্রেস এমন বিপর্যয়ের মুখে পড়ত না।
প্রণব মুখার্জি তার আত্মজীবনীতে স্বীকার করেছেন, তিনি গণনেতা নন, তবে দক্ষ কৌশলবিদ, তিনি এমনকি মোদির মতো ব্যক্তি নেতৃত্বে থাকলেও গেরুয়া স্ট্রিম রোলার বানচাল করে দিতে পারেন। জ্যোতি বসুকে ইউনাইটেড ফ্রন্টের দেওয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাবটি গ্রহণ না করে সিপিআই(এম) যে ভুল করেছে, একই ধরনের ভুল করে প্রণব মুখার্জিকে প্রধানমন্ত্রী না করে ভারতের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দলকে ভয়াবহ মূল্য চোকাতে হয়েছে। রাহুল গান্ধী যদি স্মার্ট হন এবং কংগ্রেসকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে আগ্রহী থাকেন, তবে প্রণব মুখার্জি হবেন এমন এক রাজনীতিবিদ, যার পরামর্শ তিনি সক্রিয়ভাবে কামনা করতে পারেন।
প্রণব মুখার্জি হলেন ভারতের শেষ বাঙালি রাজনীতিবিদ, যিনি বাংলাদেশের সাথে প্রবলভাবে সম্পৃক্ত। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় প্রণব ছিলেন জুনিয়র রাজনীতিবিদ। ওই সময় তার ভূমিকা ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। তবে ইন্দিরা গান্ধী তাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন মুজিব পরিবারের, বিশেষ করে ১৯৭৫ সালের পর তার বড় মেয়ে শেখ হাসিনার। আর এতে করে হাসিনার কাছে তার গুরু এবং সেইসাথে তার সবচেয়ে বড় ঢাল হিসেবে আত্মপ্রকাশের সুযোগ ঘটে। হাসিনার নিন্দুকেরা হয়তো বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রণব মুখার্জির হস্তক্ষেপকে একটি ইস্যুতে পরিণত করতে পারেন (হিলারি ক্লিনটনের হয়ে তার লড়াই, বেসামরিক শাসনে ফেরার জন্য সেনাপ্রধান মইনকে তার উপদেশ প্রদান), কিন্তু প্রণব মুখার্জি দৃশ্যত অবিচল। ঠিক যেমন ছিলেন জ্যোতি বসু। এই বাঙালি সমীকরণটি বিএনপি-জামায়াত ও তাদের মতো অন্যরা কখনো বুঝতে পারবে না।
১৯৬২ সালে শেখ মুজিবের সাথে গোপনে সাক্ষাতকারী ত্রিপুরার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী সচিন্দ্র লাল সিংহ যদি নাছোড়বান্দার মতো লেগে না থাকতেন তবে ভারতীয় হস্তক্ষেপ হতো না, বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। আমার আগরতলা ডকট্রিনে এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। ইন্দিরাকে সচিন্দ্র বুঝিয়েছিলেন, পাকিস্তান ও চীনের সমর্থনপুষ্ট ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলের জাতিগত বিদ্রোহ থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো ‘পূর্ব থেকে পাকিস্তানকে তাড়িয়ে’ দেওয়া। তিনি কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসু ও স্নেহাংসু আচার্যের (ময়মনসিংহের রাজপরিবারের এই সদস্য বন্ধুদের কাছে পরিচিত ছিলেন দোদো দা নামে) সহায়তা নিয়ে ভারতীয় হস্তক্ষেপের জন্য চাপ দেন। বলা হয়ে থাকে মহান বঙ্গবন্ধু সচিন্দ্রকে স্বাগত জানাতে তার অফিসের দরজায় দাঁড়িয়ে যে কথাগুলো বলেছিলেন তা বিখ্যাত হয়ে আছে : ‘আপনাকে ছাড়া এই দেশ হতো না।’
১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে প্রণব ও জ্যোতি এই ভূমিকা পালন করেন। দিল্লিতে বাংলাদেশ ও আওয়ামী লীগের প্রধান লবিস্ট হিসেবে, দুই দেশ ও সরকারের মধ্যকার সেতুবন্ধ হিসেবে, বাঙালি ঐক্যতান হিসেবে, বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম ভাষার অধিকারী হয়েও বাঙালিদের রাজনৈতিক ক্ষমতায় নিয়ে যেতে ব্যর্থ বিভক্ত জাতির শেষ আশা হিসেবে তারা তা করেছিলেন।
নরেন্দ্র মোদির তার পূর্বসূরির মতো বাংলাদেশ প্রশ্নে প্রণব মুখার্জির উপদেশ গ্রহণের বিষয়টি দারুণ বিষয়। তবে প্রণব মুখার্জি যখন থাকবেন না, তখনকার জন্য বিজেপিকে নিজস্ব ধরনের কাউকে গড়ে নিতে হবে। পাকিস্তানের মতো করে বাংলাদেশকে আরএসএস’র স্টাইলে সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশ বিবেচনা করাটা প্রতিরোধ করতে পারেন কেবল প্রণব মুখার্জি (কিংবা বিজেপির তথাগত রায়)। কিন্তু তথাগতেরও বয়স কম হয়নি। ফলে বিজেপিকে এমন কাউকে খুঁজে বের করতে হবে, যাতে বাংলাদেশ প্রশ্নে পরবর্তী প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে তথাগত রায় তাকে তৈরি করে নিতে পারেন। তাকে বাঙালি হতে হবে, পূর্ব বাংলার শেকড় থাকলে আরো ভালো হয় এবং ‘হিন্দু পাড় পাদশাহি’র নাগপুর পক্ষপাতিত্ব থেকে মুক্ত থাকতে হবে। তা না হলে এই বিশেষ সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
কারণ বিভক্তি পূর্বে যেমন শেষ কথা নয়, পশ্চিমেও নয়। অযোধ্যায় যেদিন উগ্র ধর্মান্ধরা বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে ফেলেছিল, কলকাতায় হলভর্তি দর্শকের সামনে পারফর্ম করছিল ঢাকা থিয়েটার। বিভক্তির কারণে তিন বাংলার মধ্যে (বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তরপূর্বের বাঙালি মিলে হয় তৃতীয় ভূবন) সৃষ্ট প্রাচীর গুঁড়িয়ে দেওয়ার এই সুযোগের বেশির ভাগই নষ্ট হয়েছে পানিবণ্টন প্রশ্নে মমতা ব্যানার্জির মনোভাবের কারণে (অথচ জ্যোতি বসু ১৯৯৬ সালের গঙ্গা পানি চুক্তির চালক ছিলেন)। মমতা যদি রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকতে চান এবং বাংলার ক্ষমতা থেকে গেরুয়াকে দূরে রাখতে চান তবে তাকে পাকিস্তান-সমর্থিত উর্দুভাষী ইসলামি মৌলবাদী বৃত্ত থেকে বের হয়ে বাঙালি মুসলিম নেতাদের ওপর বেশি নির্ভর করতে হবে, বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক জোরদার করতে হবে।
প্রণব মুখার্জির সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরের কথা এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। ঢাকার বাংলা একাডেমিতে আন্তর্জাতিক বাঙালি সাহিত্য সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশনে বক্তৃতাকালে প্রণব মুখার্জি বলেছেন, সন্ত্রাসীরা কী চায়, তা অস্পষ্ট, তবে তারা জীবন্ত মানববোমায় পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, পরিবেশগত দূষণ নয়, বৃহত্তম দূষণ হচ্ছে মানুষের চিন্তায়, ভাষায় ও মনে। তিনি জানান, কেবল লেখক, শিল্পী, কবি, উপন্যাসিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরাই এ ধরনের দূষণ থেকে জনগণকে রক্ষা করার দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারে, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো তা পারে না। সাবেক ভারতীয় রাষ্ট্রপতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের পারিবারিক বন্ধু বলেন, সন্ত্রাসীরা পেন্টাগনে পর্যন্ত হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করছে। ‘আমরা বিষাক্ত পৃথিবী ও সন্ত্রাসবাদের বিষ থেকে নতুন প্রজন্মগুলোকে রক্ষা করতে দৃঢ়প্রত্যয়ী’ জানিয়ে তিনি সৃষ্টিশীল লোকজন, লেখক, শিল্পীদের এই লক্ষ্যে কাজ করতে আহ্বান জানান। বাংলা ভাষা এবং বাংলাকে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের সংগ্রামে অংশগ্রহণকারীদের ভূমিকার কথা স্মরণ করে প্রণব বলেন, প্রত্যেকের প্রতিটি মুহূর্তে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা উচিত। ‘এ ধরনের সম্মেলন আয়োজন করতে ঢাকার চেয়ে আরো ভালো জায়গা কোথায় পাওয়া যাবে?’ তিনি সফলভাবে সম্মেলন আয়োজনের জন্য আয়োজকদের প্রয়াসের প্রশংসা করেন। ‘এখানে আসতে পেরে আমি সম্মানিত বোধ করছি।’ তিনি বলেন, ঢাকা ঘোষণায় বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে নিখুঁত মূল্যায়ন করা হয়েছে।
গত এক দশকে বিশেষ করে নিরীহ লোকজনের প্রাণহানিতে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘এই বিশ্বকে বদলানোর দরকার আছে।’ ভবিষ্যত খুবই ভালো হবে আশাবাদ ব্যক্ত করে প্রণব বলেন, নতুন বাংলা বছর সবার জন্য শান্তি বয়ে আনবে। সম্মেলনের আহ্বায়ক অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এম শাহরিয়ার আলম, সম্মেলনের প্রথান সমন্বয়কারী নাসিরউদ্দিন ইউসুফ, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানও অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। অর্থমন্ত্রী মুহিত বলেন, সম্মেলনটি ছিল একটি বড় অনুষ্ঠান, এ ধরনের ইভেন্ট একটি অনুষ্ঠান হয়েছিল ১৯৭৪ সালে, বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের উদ্যোগে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, সম্মেলনটি একে অপরকে জানার সুযোগ করে দিয়েছে। তিনি আশা করেন, আগামীতে বাংলাদেশে এ ধরনের আরো সম্মেলন হবে।
সাংস্কৃতিক মন্ত্রী নূর অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই এবং এ ধরনের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাকে সমুন্নত রাখার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান। শাহরিয়ার আলম বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় উপনীত হয়েছে। তিনি এ ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
তবে প্রণব মুখার্জির সফরের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, তার বাংলাদেশকে জোরালোভাবে তুলে ধরা। সাহিত্য সম্মেলনে বক্তৃতা করার আগে প্রণব মুখার্জি বলেন, বাংলাদেশ এখন বিনিয়োগের আকর্ষণীয় স্থান। এটি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী ভারতীয় রাজধানীর মধ্যে আত্মবিশ্বাসে প্রভাব ফেলবে।
এখানে তিনি একজন বাঙালি রাজনীতিবিদ, যিনি একই সুরে ‘জয় হিন্দ’ ও ‘জয় বাংলা’ বলতে পারেন।
শেখ হাসিনাকে প্রণবদা কত গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন এবং দিয়ে যাচ্ছেন, তা আমি জানি। যুক্তরাষ্ট্রকে কিংবা নিজের সেনাবাহিনীকে সামলানোর মতো বিভিন্ন বিষয়ে তিনি পরামর্শ দিয়ে থাকেন। আওয়ামী লীগে আমার এক বন্ধু বলেছেন, হাসিনার কাছে প্রণব মুখার্জি হলেন পীর সাহেব। বর্তমান সফরকালে প্রণব মুখার্জি নিশ্চিতভাবেই হাসিনার নির্বাচনী সম্ভাবনা নিয়ে তার মূল্যায়ন জানাবেন। আর তিনি তার বিতর্কিত ছেলে অভিজিতকে (বিএনপি অভিযোগ করেছে, তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বাণিজ্যে জড়িত) না এনে তার স্পর্শকাতর মেয়ে রাজনীতিবিদ শর্মিষ্ঠাকে সাথে আনার বিষয়টিও খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আগামী নির্বাচনের জন্য হাসিনার কৌশল প্রণয়নেই প্রণব মুখার্জি কেবল সহায়তা করবেন না, সেইসাথে ২০১৪ সালের মতো কোনো বিতর্কিত নির্বাচন ছাড়াই যাতে ভারতের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মিত্র ক্ষমতায় ফিরতে পারে, সে ব্যাপারে করণীয় সম্পর্কেও মোদিকে যথাযথ পরামর্শ দেবেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন