কমিউনিস্ট বললেই মনেই পর্দায় ভেসে ওঠে একজন ত্যাগী, মানুষের জন্য নিবেদিত প্রাণ মানুষ। কমিউনিস্টরা মানুষের কথা বলে, অধিকার আদায়ে সোচ্চার থাকে। পুরো বিশ্বের এমন চিত্রটিই সাধারণ। কিন্তু বাংলাদেশে যেন এর ব্যতিক্রম। সারাজীবন কমিউনিস্ট থাকা ব্যক্তিও ক্ষমতায় গিয়ে দুর্নীতির মূর্ত প্রতীকে পরিণত হন। অন্তত এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস তাই বলছে। তবে মতিয়া চৌধুরীরর মতো ব্যতিক্রমও আছে, এক কালের কমিউনিস্ট নেত্রী যিনি এখনো আদর্শ ও সততার ধরে রাখতে পেরেছেন। কিন্তু অন্যদের এমন দুরবস্থা কেন?
বিএনপির সাবেক মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভুঁইয়া। নিবেদিত প্রাণ কমিউনিস্ট ছিলেন ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে বিএনপির যোগদান পর্যন্ত। দলটির সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের মহাসচিব ছিলেন তিনি। ১৯৯১ সালে বেগম জিয়ার প্রথম সরকারের শ্রম ও জনশক্তি এবং পরে কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর জোট সরকারের আমলে তিনি স্থানীয় সরকার মন্ত্রী হয়েছিলেন। তাঁর মন্ত্রণালয়গুলোতে ব্যাপক দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। ক্ষমতায় যাওয়ার আগে নিবেদিত প্রাণ কমিউনিস্ট থাকলেও, ক্ষমতায় যাওয়ার পর তিনি হয়ে যান পুরোদস্তুর দুর্নীতির প্রতিচ্ছবি। ব্যক্তি মান্নান ভুঁইয়ার বিরুদ্ধেও দুর্নীতি অভিযোগে ওঠে বহুবার।
বিএনপিতে ঠাঁই পাওয়া আরেক কমিউনিস্ট দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম। ছাত্রজীবনে তিনি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ১৯৯২ সালে তরিকুল ইসলাম সমাজকল্যাণ ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পান। পরে তিনি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রীও হন। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর তিনি খাদ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে তথ্য মন্ত্রণালয় এবং আরও পরে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। উল্লিখিত সময়কালে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোতে ব্যাপক দুর্নীতি-অনিয়ম ঘটে, যার দায়ভার মন্ত্রীর ওপরই বর্তায়। তাঁর নিজের বিরুদ্ধে আছে দুর্নীতির নানা অভিযোগ।
বর্তমান শিক্ষমন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ। ‘বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের’ এ প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সুদীর্ঘকাল ‘ছাত্র ইউনিয়ন’ এরও সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। তাছাড়া এই বৃহৎ ছাত্র সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এবং সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে ৭ম ও ২০০৮ সালে ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং বর্তমানে টানা ৯ বছর ধরে শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। প্রথম পাঁচ বছরে দুর্নীতির তেমন অভিযোগ না থাকলেও পরবর্তী সময়ে হয়েছেন ব্যাপক সমালোচিত। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বর্তমানে পরিণত হয়েছে দুর্নীতির আখড়ায়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি-অনিয়ম, প্রশ্নপত্র ফাঁস, পাঠ্যবই কেলেঙ্কারিসহ নানা অভিযোগ শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিয়ে। এগুলো নিয়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে মন্ত্রী ব্যর্থ। উপরন্তু শিক্ষামন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী সহ একাধিক কর্মচারী গোয়েন্দা পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন। মন্ত্রীর নাকে ডগায়ই দুর্নীতি ঘটছে তা কি মন্ত্রী সত্যিই জানতেন না? এখন প্রশ্ন অনেকের।
বর্তমান সরকারের আরেক মন্ত্রী কমিউনিস্ট হিসেবে দেশব্যাপী স্বীকৃত বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন। তিনি চীনপন্থী রাজনীতিতে দীক্ষিত এবং মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ভাবশিষ্য। ১৯৬২-র শিক্ষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। পরে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। সম্প্রতি দায়িত্ব পেয়েছেন সমাজকল্যাণের। তিনি মন্ত্রী থাকাকালে বিমানের দুর্নীতি-অনিয়ম কমেনি বরং ক্ষেত্রবিশেষে বেড়েছে। এমন ত্যাগী কমিউনিস্টের ক্ষমতায় থাকাকালে দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে আপসের বিষয়টি কোনোভাবেই মেলাতে পারেন না বিশেষজ্ঞরা।
এমন পরিপ্রেক্ষিতে জনমনে প্রশ্ন তবে কী বাংলাদেশের কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় গেলেই তাঁদের নীতি ভুলে যান। সবাই কিন্তু নয়। তাঁর উজ্জ্বল উদাহরণ মতিয়া চৌধুরী। ষাটের ছাত্ররাজনীতিতে মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীদের কাছে মতিয়া চৌধুরী ছিলেন অগ্নিকন্যা। ১৯৭৩ সালে ন্যাপের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালে ন্যাপ ছেড়ে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন হলে তিনি কৃষি, খাদ্য ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। এখনো তিনি কৃষিমন্ত্রীই। দীর্ঘ সময় মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেও তিনি নিজের স্বচ্ছতা ধরে রেখেছেন। অন্য কমিউনিস্টদের মতো ভুলে যাননি নিজের নীতি। দুর্নীতি-অনিয়মে আপসের অভিযোগ ওঠেনি কখনো।
ক্ষমতায় গিয়ে বাংলাদেশে কমিউনিস্টদের নীতিগত দুর্বলতা প্রকাশ পেলেও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ওপার বাংলা। সেখানকার বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা জ্যেতি বসু। ১৯৭৭ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত একটানা ২৩ বছর জ্যোতি বসু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনিই ভারতের দীর্ঘতম মেয়াদের মুখ্যমন্ত্রী। ১৯৬৪ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির বিভাজনের পর বসু যোগ দেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) দলে। ১৯৬৭ সালের যুক্তফ্রন্ট সরকারের উপমুখ্যমন্ত্রী হন জ্যোতি বসু। এরপর ১৯৭৭ সালের ২১ জুন শপথ নেন পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে। ১৯৯৬ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রীহিসেবে তাঁর নাম বিবেচিত হলেও, তিনি পার্টির সিদ্ধান্তে সেই পদ প্রত্যাখ্যান করেন। টানা ২৩ বছর মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের পর শারীরিক অসুস্থতার কারণে ২০০০ সালের ৬ নভেম্বর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হাতে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পণ করে অবসর নেন বসু। বাঙালি ভদ্রলোক সমাজের প্রতিনিধি বসু ছিলেন এক অবিসংবাদী জননেতা ও নিজের দল এবং দলের বাইরেও এক বিশিষ্ট সম্মানের অধিকারী। ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকার পরও দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে দুর্নীতি-অনিয়মে জ্যেতি বসুর কোনো সংশ্লিষ্টতা কখনোই দাবি করতে পারেনি কেউ।
বাংলাদেশে কমিউনিস্টদের কখনোই নিজস্ব শক্তিতে ক্ষমতায় আসার জোর ছিল না। এখনো নেই। সব সময়ই ভর করতে হয় অন্য দলের। ক্ষেত্র বিশেষে এমন ভর করায় বিসর্জন দিতে হয় নিজেদের নীতিও। আর ক্ষমতায় যাওয়ার পর তো পুরো নীতিকথাই ভুলে বসেছেন বেশিরভাগ সাবেক কমিউনিস্ট। পশ্চিমবঙ্গের মতো অথবা বাংলাদেশের অগ্নিকণ্যার মতো ক্ষমতায় গিয়ে নিবেদিত কমিউনিস্টদের পাওয়ার ভাগ্য কবে হবে বাংলাদেশের?
বাংলা ইনসাইডার
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন