শফিক রেহমান, মাহমুদুর রহমান, ফরহাদ মজহার ও শমসের মবিন চৌধুরী
দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ‘দুর্দিনে’ও পাশে নেই বিএনপিপন্থী চারজন বুদ্ধিজীবী। অথচ গত একদশকেরও বেশি সময় ধরে সাংবাদিক শফিক রেহমান, প্রকৌশলী মাহমুদুর রহমান ও কবি-বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহার বিএনপির প্রতিটি কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ওই সময়ের মধ্যে ঘুরে-ফিরেই তাদের দেখা যেতো দলটির পাশে। এমনকী প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে জিয়া পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত শমসের মবিন চৌধুরীকেও বিএনপির চলমান কোনও কর্মসূচি বা সংকটে দেখা যায় না। সর্বশেষ গত ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায়ে দণ্ডিত হয়ে খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকে বিএনপির কোনও কর্মসূচিতে এই চার বুদ্ধিজীবীকে দেখা যায় না। যোগাযোগ হয়নি দলটির কোনও নেতার সঙ্গেও। বিএনপির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে আলাপকালে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠ বুদ্ধিজীবীরা যখন দূরে, শনিবার সন্ধ্যায় গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে তখন বিএনপিপন্থী চারজন বুদ্ধিজীবীকে নিয়ে বৈঠকে বসেছেন বিএনপির দশজন সিনিয়র নেতা। তবে এই বৈঠকেও জাতীয়তাবাদী আদর্শের এই চার বুদ্ধিজীবীকে দেখা যায়নি।
এদিকে বিএনপির পঞ্চম ও ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেছেন শফিক রেহমান। পরে ২০১৬ সালের ১৬ এপ্রিল গ্রেফতার হয়ে জামিন লাভ পান ওই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর। কারামুক্ত হওয়ার পরই তিনি খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন কিনা, তাও জানা যায়নি। যদিও এক-এগারোর সময় খালেদা জিয়া কারাগার থেকে বের হয়েই প্রথমে তার সঙ্গেই দেখা করেন।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণা শেষে খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর কোনও উদ্যোগও দেখা যায়নি শফিক রেহমানের পক্ষ থেকে। পরদিন শুক্রবার একটি দৈনিকে তিনি তার ধারাবাহিক কলাম লিখলেও খালেদা জিয়ার বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেননি।
শফিক রেহমানের ঘনিষ্ঠ একাধিক ব্যক্তি জানান, চলতি ফেব্রুয়ারির শুরুতে তিনি ঢাকা ত্যাগ করেছেন। বর্তমানে লন্ডনে রয়েছেন। স্ত্রী গুরুতর অসুস্থ থাকায় তার চিকিৎসার পেছনেই সময় দিচ্ছেন তিনি।
আরেকটি সূত্রের ভাষ্য, শফিক রেহমান তার নতুন কোনও উদ্যোগে হাত দিয়েছেন। তার সম্পাদিত পত্রিকা সাপ্তাহিক যায়যায়দিন, মৌচাকে ঢিলের বিশেষায়িত লেখাগুলো প্রকাশ করবেন। এক্ষেত্রে নতুনভাবে অনলাইন পত্রিকা করবেন তিনি। তবে পত্রিকাটির কার্যালয় ও পরিচালনা দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত হবে।
জানতে চাইলে শফিক রেহমানের সহকারী সজিব ওনাসিস বলেন, ‘তিনি আগামী মার্চে দেশে ফিরতে পারেন।’
বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী ও পরামর্শক হিসেবে সামনের কাতারে বিবেচনা করা হয় বন্ধ থাকা দৈনিক আমার দেশ-এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে। তবে খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকে তিনিও দলীয় কোনও কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছেন না।
বিএনপির একাধিকসূত্র বলছে, খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনে যেভাবে চলছে, সে ‘শান্তিপূর্ণ’ ধারাটি মাহমুদুর রহমানের পছন্দের বাইরে। এছাড়া দল যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে, বিশেষ করে লন্ডন টু ঢাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ, স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা করা ও সমন্বিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া; এগুলোর কোনোটিই তার পছন্দের নয়। এ কারণেই মাহমুদুর রহমান বিএনপির এই ‘দুর্দিনে’ নীরব রয়েছেন।
মাহমুদুর রহমানের ঘনিষ্ঠজনরা বলছেন, তার নিষ্ক্রিয়তার বিষয়টি বিএনপিতে রহস্য তৈরি করেছে। ১৫ ফেব্রুয়ারি গুলশানে পেশাজীবীদের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠকেও অংশ নেননি মাহমুদুর রহমান। যদিও বিএনপিপন্থী পেশাজীবী পরিষদের আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
এদিকে পেশাজীবী পরিষদের নেতা সাবেক সচিব আনম আকতার বাংলা ট্রিবিউনকে বলছেন, ‘এ ব্যাপারে আমি কিছুই বলতে পারবো না’।
তবে সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের সদস্য সচিব ডা. এ জে ড জাহিদ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মাহমুদুর রহমান ৫ বছর জেল খেটেছেন। এরপরও কাজ করেননি বলবেন? পেশাজীবীদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি আসতে পারেননি, এটা ঠিক। কিন্তু তার সঙ্গে পরামর্শ করেই আমাদের কার্যক্রম এগিয়ে যাচ্ছে। তার সঙ্গেই পরামর্শ করি আমরা।’
মাহমুদুর রহমানের ঘনিষ্ঠ একজন জানান, সম্প্রতি তিনি একটি মানববন্ধনে অংশ নিয়েছেন। সেখানেও খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করেছেন। এই বুদ্ধিজীবীর বিষয়ে তার অনুসারীরা নানা কথা বললেও ফরহাদ মজহার কিন্তু দৃশ্যপটেই নেই। কাছের দুয়েকজন বলছেন, গত বছরের জুলাইতে তার নিখোঁজ হওয়া, পরে ফিরে আসা—এসব ঘটনার পর থেকে তিনি রাজনৈতিকভাবে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন। হেফাজতের সময় আলোচিত এই রাজনৈতিক ভাষ্যকার, কবি ও কলামিস্ট বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী হিসেবেই পরিচিত। যদিও বিএনপির সাংগঠনিক কোনও কার্যক্রমে তার অংশগ্রহণ নেই। গত বছর একাধিকবার বিভিন্ন বিষয়ে সেমিনার করতে চাইলে বিভিন্ন বাধায় তা সম্ভব হয়নি। খালেদা জিয়ার গ্রেফতার-পরবর্তী তার নীরবতা নিয়েও আলোচনা রয়েছে বিএনপিতে। দলের সংকটকালে তার কাছ থেকে বুদ্ধি-পরামর্শের অপেক্ষা করলেও তিনি নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন। বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
জিয়া পরিবারের সঙ্গে বহুদিনের যুক্ত রয়েছেন কূটনীতিক শমসের মবিন চৌধুরীর। বিএনপির বিগত সংকটগুলোয় সামনে থেকে সবকিছু মোকাবিলা করেছেন। অথচ এবার খালেদা জিয়ার গ্রেফতারের পরও তিনি নীরবতা ভাঙেননি। রাজধানীর ওল্ড ডিওএইচএস এলাকায় নিজের বাড়িতেই বেশিরভাগ সময় কাটে তার।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের দলের কাউন্সিলের আগে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে রাজনীতি থেকে অবসরে যান এই নেতা। এরপরও নেতাকর্মীদের প্রত্যাশা ছিল, শমসের মবিন চৌধুরী অন্তত দলে না ফিরলেও কারাবন্দি খালেদা জিয়ার পাশে দাঁড়াতে পারেন। পারিবারিকভাবে তিনি জিয়া পরিবারের ঘনিষ্ঠ হলেও চলমান সংকটে তার অনুপস্থিতি অনেককেই পীড়া দিচ্ছে বলে জানান বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যান। যদিও বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, ‘গ্রেফতারের পর কোনও যোগাযোগ হয়নি।’
বিএনপির এই দুঃসময়ে তার কোনও পদক্ষেপ থাকবে কিনা, এমন প্রশ্নে শমসের মবিন চৌধুরী’র সরাসরি উত্তর, ‘আমি দলের ভেতরে রাজনৈতিক কোনও বিষয়ে আলোচনা করতে চাই না।’
খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠ এক বুদ্ধিজীবীর ভাষ্য, ওই পরামর্শের পরেই বিএনপির সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের টানাপড়েন তৈরি হয়। এরপরও মার্কিন লবি শক্ত করতে রিয়াজ রহমান, শফিক রেহমানসহ কয়েকজনের চেষ্টা ছিল। এর ফলে ২০১৫ সালে দলীয়ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত হলেও ওই বছরই শফিক রেহমানকে পালিয়ে যেতে হয় বাড়ি থেকে। আর রিয়াজ রহমানকে বোমা হামলার শিকার হতে হয়। এখন পর্যন্ত ওই ঘটনাগুলোর কোনও সুরাহা হয়নি। কারাই বোমা হামলা করিয়েছে, এ নিয়েও কোনও সদুত্তর মেলেনি।
দলটির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্যের ভাষ্য, ‘আমার ধারণা, শফিক রেহমান ২০১৫ সালে বাড়িছাড়া হলেন। ২০১৬ সালে গ্রেফতার হলেন। এখন আবার তার স্ত্রী অসুস্থ। এসব কারণেই তিনি এখন নীরব।’
এদিকে, শনিবার সন্ধ্যায় গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে বৈঠক করছে বিএনপি। এই বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. এমাজ উদ্দিন আহমেদ, সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ, অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব উল্লাহ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী বৈঠকে অংশ নিয়েছেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন