বিএনপির সংকট ক্রমেই বাড়ছে। বলা যায়, দলটি এখন গভীর সংকটের পথে। ওয়ান-ইলেভেনের ধাক্কা সামলিয়ে নানাভাবে সাংগঠনিক বিপর্যয় কাটিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে দলটি। বিগত আন্দোলনে জ্বালাও-পোড়াওয়ের জের সামলে নির্বাচনী মাঠে সক্রিয় হতে নানামুখী তৎপরতা চালায় দলটি। আগামী নির্বাচনকে টার্গেট করে তারা সবকিছু প্রায় গুছিয়েও আনে।
কিন্তু দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারারুদ্ধ হওয়ার পর আবারও ‘কঠিন পরীক্ষায়’ পড়েছে বিএনপি। আইনি লড়াই, শীর্ষ নেতৃত্বের শূন্যতা, খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশগ্রহণ, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের ব্যাপারে সমঝোতা না হওয়া, দল হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারা না পারা, দলের ভাঙন রোধ এবং ঐক্য ধরে রাখার মতো কঠিন চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে হবে দলটিকে।
চেয়ারপারসনের কারামুক্তিতে বর্তমানে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চলছে। কিন্তু দাবি মানতে বাধ্য করার মতো আন্দোলন কর্মসূচির অভিষেক এখনও করতে পারেনি। কিংবা তাদের সে সক্ষমতা নেই। এ অবস্থায় গণতান্ত্রিক পন্থায় বিএনপি তাদের ভোটার ও সমর্থকদের শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে সেটিই এখন ভাবার বিষয়।
এমন মন্তব্য ছাড়াও বিশ্লেষকদের কয়েকজন শনিবার যুগান্তরকে এ-ও বলেন, ক্ষমতার রাজনীতির লড়াইয়ে পৃথিবীতে কেউ কাউকে একবিন্দু ছাড় দেয় না। কিন্তু জায়গা করে নিতে হয়। কৌশলতগত সেই লড়াইয়ে বিএনপির গন্তব্য কোথায় সেটিই এখন দেখার বিষয়। এদিকে দলটির নেতাকর্মীরাও মনে করেন, অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বিএনপি সবচেয়ে সংকটকাল অতিক্রম করছে।
চেয়ারপারসন কারাগারে, দ্বিতীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি দলের বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশের বাইরে। মামলা-হামলায় জর্জরিত দলটির নেতাকর্মীরা। এমন সংকটকালে সরকার উল্টো আরও কঠোর হচ্ছে। তবে এসব প্রতিকূলতার মধ্যেও দলটির নীতিনির্ধারকরা আশাবাদী।
যে কোনো মূল্যে তারা আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে চায়। সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে সমঝোতার পথে আসতে বাধ্য করতে নানা পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে তারা। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে তারা এক পর্যায়ে গণআন্দোলনে রূপ দিতে চায়। পাশাপাশি কূটনৈতিক রাজনীতিও তারা জোরালোভাবে করবে। এ দুটি চাপ অব্যাহত রাখা সম্ভব হলে একতরফা নির্বাচন থেকে সরকার পিছু হটবে বলে মনে করছেন দলটির নেতাকর্মীরা।
সরকারের ছাড় না দেয়ার মনোভাব বা বিএনপির প্রতি শক্তভাবে চড়াও হওয়ার বিষয়টি আরও ভাবিয়ে তুলছে দলটির নীতিনির্ধারকদের। তাদের মতে, আগামী নির্বাচনে অংশ নেয়া না নেয়া নিয়েও তারা উভয় সংকটে আছেন। নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় না করে নির্বাচনে অংশ নিলে ফলাফল অনুকূলে আসবে বলে মনে করেন না তারা।
পক্ষান্তরে নির্বাচন বর্জন করলেও কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে। পরপর দু’বার জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিলে রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন বাতিল হওয়ার মতো আইনি জটিলতায় পড়তে পারে দলটি। এছাড়া আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলে দলের সাংগঠনিক অবস্থা তলানিতে গিয়ে ঠেকবে।
জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, ‘শুধু বিএনপি নয়, পুরো দেশ ও জাতিই এখন গভীর সংকটের মধ্যে রয়েছে। আসলে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নির্বাচনের বাইরে রেখে আবারও একদলীয় নির্বাচনের ষড়যন্ত্র করছে আওয়ামী লীগ। তবে বাস্তবতা হল- জনগণই হচ্ছে সবচেয়ে বড় অস্ত্র। গণশক্তির কাছে কোনো কিছুই টিকে না। দেশবাসী ও সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হব বলে আশা করি।’
তিনি বলেন, ‘যে কোনো পরিস্থিতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর মতো শক্তি এবং সামর্থ্য বিএনপির রয়েছে। অতীতেও বেশ কয়েকবার এর প্রমাণ দিয়েছে দলটি। বর্তমান সংকট ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আবারও বিএনপি ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা করি।’
দলটির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, চেয়ারপারসনের এই মামলার রায়ের একটি সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য রয়েছে। রায়ের পর সরকার বিএনপিকে নিয়ে নানা কৌশল নিচ্ছে। যেমন- চেয়ারপারসন কারাগারে, নেতাকর্মীরা মামলা হামলায় দৌড়ের মধ্যে আছে। কেউ বাড়িতে থাকতে পারছে না। কোনো কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করেও কুলিয়ে উঠতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে পাল্টা কৌশল হিসেবে সরকার আরও কঠোর হবে বলেই মনে করছেন তারা।
তারা জানান, দলকে নেতৃত্বশূন্য করতে বিএনপির সিনিয়র কয়েকজন নেতাকে শিগগির আটক করা হতে পারে। এমন আলোচনাও রয়েছে দলটিতে। তাদের আশঙ্কা, তাহলে দল আরও সংকটে পড়বে। তারা বলেন, যে কোনো আন্দোলন বেগবান করার পূর্বশর্ত হচ্ছে নেতৃত্ব। কিন্তু বাস্তবতা হল, শীর্ষ নেতা থেকে তৃণমূলের শত শত নেতা এখন কারাগারে। এ পরিস্থিতিতে কর্মীদের সঠিকভাবে দিকনির্দেশনা দেয়াও সহজ হবে না। আবার সিনিয়র নেতাদের গ্রেফতার করা হলে দ্বিতীয় সারির নেতারা রাজপথের আন্দোলন কতটা চালিয়ে যেতে পারবে তা নিয়েও যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।
জানতে চাইলে বরিশাল উত্তর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, সরকারের নানামুখী কৌশলে বিএনপি এখন চাপে আছে এটা অস্বীকার করা যাবে না। এ চাপ মোকাবেলায় প্রয়োজন সঠিক নেতৃত্ব ও দলের ঐক্য।
তিনি বলেন, হামলা মামলায় বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা পর্যুদস্ত। তারপরও তারা জীবন বাজি রেখে রাজপথে আছেন। তবে বর্তমান সরকারের একগুঁয়েমির বিরুদ্ধে আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে।
সাধারণ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হলে সরকার এক সময় দাবি আদায়ে বাধ্য হবে। আর ইতিহাসে কোনো কিছুই অবাস্তব নয়, বিশেষ করে রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও সাফল্য আসার অনেক নজির আছে।
পাঠক মন্তব্য
হায় আপসোস! যদি এরা বিএনপি সংকট না দেখে দেশের সংকট দেখতো!
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন