আটপাড়া ও কেন্দুয়া—দুই উপজেলা নিয়ে গঠিত জাতীয় সংসদের ১৫৯ আসন নেত্রকোনা-৩। আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসেবে পরিচিত এ আসনে এরই মধ্যে দুইবার হানা দিয়েছে বিএনপি। বর্তমানে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য থাকলেও বিএনপি জনপ্রিয় প্রার্থী দিলে দুই দলের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে বলে মনে করছে ভোটাররা।
এ আসনটি বহু আগে থেকেই আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে বিএনপির মনোনয়নে সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা প্রয়াত নুরুল আমিন তালুকদার আওয়ামী লীগের তিনবারের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট এম জুবেদ আলীকে দু-দুবার পরাজিত করেন। দুবার জেতার পর বিএনপি সুসংগঠিত হয়। ২০০৩ সালে বিএনপির সংসদ সদস্য নুরুল আমিন তালুকদারের মৃত্যুতে আসনটি শূন্য হলে উপনির্বাচনে তাঁর স্ত্রী খাদিজা আমিন স্বামীর জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে এমপি নির্বাচিত হন। সেবারও আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন অ্যাডভোকেট জুবেদ আলী।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নতুন মুখ মঞ্জুর কাদের কোরায়শী মনোনয়ন পেয়ে বিএনপি প্রার্থী রফিকুল ইসলাম হিলালীকে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হন। এরপর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ইফতেখার উদ্দিন তালুকদার পিন্টু আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হন।
আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বিএনপি, জাতীয় পার্টির মনোনয়নপ্রত্যাশী একাধিক নেতা এরই মধ্যে পোস্টার-ব্যানার, সভা-সমাবেশের মাধ্যমে প্রচার শুরু করেছেন।
আওয়ামী লীগ : আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থীরা এ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী। আবার দুই উপজেলা নিয়ে এ আসন হওয়ায় মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যাও বেশি। সে কারণে নেতাকর্মীদের মধ্যে কিছুটা দ্বিধাবিভক্তিও রয়েছে।
মনোনয়নপ্রত্যাশীরা হলেন বর্তমান এমপি মো. ইফতেখার উদ্দিন তালুকদার পিন্টু, সাবেক এমপি মঞ্জুর কাদের কোরায়শী, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, আওয়ামী লীগ নেতা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সামছুল কবীর খান, সাবেক এমপি আবদুল খালেকের ছেলে ও আটপাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি খায়রুল ইসলাম, ঢাকা বারের সাবেক সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট সাইদুর রহমান মানিক, জেলা কৃষক লীগের সভাপতি কেশব রঞ্জন সরকার।
এবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাওয়ার বিষয়ে ইফতেখার উদ্দিন তালুকদার পিন্টু বলেন, ‘আমার আমলে নির্বাচনী এলাকার যে উন্নয়ন হয়েছে বিগত সময়ে এমন উন্নয়নের ছোঁয়া ছিল না দুই উপজেলায়। এমপিগিরি করতে গিয়ে আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। মনোনয়ন নিয়ে ভাবছি না, এলাকার উন্নয়নে কাজ করছি। মনোনয়ন কে পাবে, কাকে দেওয়া হবে, সেটা দলীয় হাই কমান্ডের বিষয়।’
ঢাকসুর সাবেক মিলনায়তন সম্পাদক, নেত্রকোনা-৩ আসনের সাবেক এমপি মঞ্জুর কাদের কোরায়শী বলেন, ‘নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলাম। আশা করছি, দলীয় হাই কমান্ড বিষয়টি বিবেচনা করে আমাকে মনোনয়ন দেবে।’
কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল মনোনয়ন প্রত্যাশায় নির্বাচনী এলাকায় কাজ করে যাচ্ছেন। এবার স্ত্রী, কেন্দ্রীয় যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাবেক এমপি অধ্যাপক অপু উকিল তাঁর হয়ে নির্বাচনী মাঠে নেমেছেন। অসীম কুমার উকিল আগে থেকেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন চেয়ে আসছেন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি তৃণমূলের ভোটে প্রথম হয়েছিলেন।
এবার নির্বাচনী এলাকায় দলের বেশির ভাগ নেতাকর্মী তাঁর সঙ্গে কাজ করছে দাবি করে অসীম কুমার উকিল বলেন, ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সমাজকে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, মাদকমুক্ত করতে চাই। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, গ্রাম থেকে গ্রামে পাকা সড়ক নির্মাণ ও আধুনিক স্যানিটেশন ব্যবস্থা গড়ার প্রত্যয় নিয়ে কাজ করতে চাই। আশা করি, দল আমাকে মনোনয়ন দেবে।’
আওয়ামী লীগ নেতা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সামছুল কবীর খানও নির্বাচনী মাঠে আছেন। প্রায়ই নির্বাচনী এলাকায় যাচ্ছেন। দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন। তিনিও বলেন, ‘আশা করি, দল আমাকে মনোনয়ন দেবে।’
আটপাড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি খায়রুল ইসলাম দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী। সমাজসেবায় অবদানের জন্য এরই মধ্যে তিনি তিনবার জেলার শ্রেষ্ঠ উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। খায়রুল ইসলাম জানান, একজন এমপিকে ডোবাতে তাঁর ভাই-ভাতিজা, ভাগ্নে থাকলেই যথেষ্ঠ। পিন্টু ভাইয়ের সবচেয়ে বড় গুণ তিনি তাঁর ভাই-ভাতিজাদের এলাকায় আসতে নিষেধ করেছেন। আমি মনোনয়ন চাইলেও তিনি যে একজন পরিচ্ছন্ন লোক, এটা আমি তাঁর সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে বুঝে ফেলেছি।’
নেত্রকোনা জেলা কৃষক লীগের সভাপতি কেশব রঞ্জন সরকার এবার মনোনয়ন প্রত্যাশায় সভা-সমাবেশ করছেন। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘কৃষিবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় প্রার্থী মনোনয়নে এবার চমক দেখাবেন। দলীয় প্রধান আমাকে মনোনয়ন দেবেন বলে আমি শতভাগ আশাবাদী।’
ঢাকা বারের সাবেক সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট সাইদুর রহমান মানিক এবারই প্রথম আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশায় নির্বাচনী এলাকায় আসা-যাওয়া করছেন। এলাকাবাসীর সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়, গণসংযোগ করে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন। সাইদুর রহমান মানিক বলেন, ‘সারা জীবন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি করেছি। দলের হয়ে কাজ করছি। বিগত সময়ে আইনজীবীদের নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রামে কাজ করেছি। অবহেলিত এলাকার উন্নয়নে কাজ করতে চাই। আশা করি, দলীয় হাই কমান্ড আমার বিষয়টি বিবেচনা করবে।’
বিএনপি : এ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা হলেন কেন্দুয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি ড. রফিকুল ইসলাম হিলালী, উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক, জেলা বিএনপির সহসভাপতি ও কেন্দুয়া উপজেলা চেয়ারম্যান মো. দেলোয়ার হোসেন ভুইয়া দুলাল; বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এসিআই সল্টের এমডি সৈয়দ আলমগীর খসরু, চার্টাড অ্যাকাউন্ট্যান্ট মুক্তিযোদ্ধা হায়দার আহাম্মেদ খান মন্টু, মুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশায় কেন্দুয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বর্তমানে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছেন। এ কারণে তৃণমূল নেতারা দ্বিধাবিভক্ত। উপজেলা বিএনপির কার্যালয় নেই দীর্ঘদিন ধরে। সভাপতি-সম্পাদক দলীয় কর্মকাণ্ড চালান নিজ নিজ বাসভবনে।
কেন্দুয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি ড. রফিকুল ইসলাম হিলালী বলেন, ‘গত নির্বাচনে আমি মনোনয়ন পেয়েছিলাম। এবারও মনোনয়ন পাব বলে আশা করি। নিয়মিত এলাকায় যাচ্ছি। সবাইকে নিয়ে দলীয় কর্মকাণ্ড পালন করছি। দলীয় কার্যালয় আছে। সঠিক সময়ে সম্মেলন করে কমিটি অনুমোদন দেওয়া হবে।’
কেন্দুয়া উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. দেলোয়ার হোসেন ভুইয়া দুলালও দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশায় নির্বাচনী মাঠে নেমেছেন। প্রায় তিন দশক ধরে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে আসছেন তিনি। ইউপি চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে পৌর মেয়র হয়েছেন তিনি। দেলোয়ার হোসেন ভুইয়া বলেন, ‘এলাকায় জনসেবায় কাজ করে যাচ্ছি। দল আমাকে মনোনয়ন দেবে বলে আমার বিশ্বাস। জেলা ও কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে সঠিক সময়ে সম্মেলন দেওয়া হবে।’
তৃণমূলের নেতা হিসেবে কেন্দুয়া উপজেলার গণ্ডা ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি রৌশন আলী কালের কণ্ঠকে জানান, মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে দেলোয়ার হোসেন দুলাল বেশি জনপ্রিয়। তবে তিনি বলেন, ‘দল যাকে মনোনয়ন দিক স্থানীয় হলে ভালো। যারা ঢাকা থেকে এসে কেন্দুয়ায় রাজনীতি করে তাদের মনোনয়ন দিলে কোনো লাভ হবে না।’
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, এসিআই সল্টের এমডি সৈয়দ আলমগীর খসরু বলেন, ‘দলীয় মনোনয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আশা করি, দলীয় হাই কমান্ড আমাকেই মনোনয়ন দেবে।’
নেত্রকোনা জেলা বিএনপির সহসভাপতি মুক্তিযোদ্ধা হায়দার আহমদ খান মন্টুও মনোনয়ন চাইবেন। তিনি বলেন, ‘দল থেকে মনোনয়ন পেলে ভালো, যদি না পাই সেও ভালো। সে ক্ষেত্রে দলের প্রার্থীর পক্ষে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করব।’
মনোয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে আরো আছেন জেলা বিএনপির সহসভাপতি মুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী।
জাতীয় পর্টি : এ আসনে জাতীয় পার্টির একক প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা জসীম উদ্দিন ভুইয়া।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন