আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জোরেশোরে প্রচারণায় নামলেও এরই মধ্যে তারা বড় চার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
এগুলো হলো : আগামী নির্বাচনে বিএনপিসহ বৈধ সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ, অস্থিতিশীল চালের বাজারের লাগাম টেনে ধরা, প্রশ্ন ফাঁসের হিড়িক রোধ এবং ইয়াবাসহ সব ধরনের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ করা। এসব দ্রম্নত মোকাবেলা করা না গেলে ক্ষমতাসীনদের বড় ধরনের খেসারত দিতে হতে পারে।
তাদের এ আশঙ্কা যে অমূলক নয় তা স্বীকার করেছেন নির্বাচনী প্রচারণার মাঠে নামা ক্ষমতাসীন দলের সম্ভাব্য এমপি প্রার্থীরা। তারা জানান, উঁচু তলা থেকে শুরম্ন করে বস্ত্মির ভোটাররাও চালের দরের অগ্নিমূল্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। ইয়াবার ভয়াল আগ্রাসন এবং প্রশ্ন ফাঁসের হিড়িক থামতে সরকার কেন ব্যর্থ হচ্ছে তা জানতে চাইছেন। অন্যদিকে রাজনীতি সচেতন মানুষের জিজ্ঞাসায় আগামীর নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের ইসু্যটি জোরালোভাবে উঠে আসছে। বিশেষ করে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কারাবন্দি হওয়ার পর ভোটারদের কাছে এ বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরম্নত্ব পাচ্ছে।
আওয়ামী দলীয় সম্ভাব্য প্রার্থীরা জানান, ভোটারদের আপাতত এসব প্রশ্নের কৌশলী জবাব দিয়ে তারা পার পেলেও আগামীতে এ ধারা বজায় রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। বাস্ত্মবিক অর্থে চলমান পরিস্থিতির পরিবর্তন না হলে সাধারণ ভোটাররা ভয়াবহভাবে বিগড়াবে। যা সামাল দিয়ে নতুন করে জনগণের আস্থা অর্জন করা নির্বাচনের আগে অত্যন্ত্ম দূরহ হবে। তাই দ্রম্নত এ চার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা সরকারের জন্য জরম্নরি বলে মনে করেন জনপ্রতিনিধিরা।
এদিকে আওয়ামী লীগের মাঠপর্যায়ের অনেক নেতা এসব ইসু্যর ততটা গুরম্নত্ব না দিলেও দল ও সরকারের নীতি-নির্ধারকদের কেউ কেউ এ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রকাশ্যে সর্বনাশা ইয়াবা প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন। ১২ ফেব্রম্নয়ারি উখিয়ার কোর্টবাজারে অনুষ্ঠিত এক পথসভায় তিনি বলেন, যে কোনো মূল্যে ইয়াবার আগ্রাসন বন্ধ করতে হবে। যারা ইয়াবা পাচার করছে কিংবা ব্যবসা করছে তাদের প্রতিরোধ করতে হবে।
বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে ইয়াবা পৌঁছে গেছে দাবি করে দায়িত্বশীল এ মন্ত্রী এর আগে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, 'আপনারা শুধু রাজনৈতিক বক্তৃতা করবেন না। মাদকের বিরম্নদ্ধে প্রচারণা চালাবেন। নিজ নিজ এলাকাকে মাদকমুক্ত করবেন। মনে রাখবেন তথাকথিত রাজনীতিকরা সবসময় পরবর্তী নির্বাচনের কথা ভাবে, আর আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরবর্তী প্রজন্মের কথা ভাবেন।'
গত ১৪ ফেব্রম্নয়ারি ধামরাইয়ের এক সমাবেশে ওবায়দুল কাদের বলেন, 'আমাদের এখন দুটি উদ্বেগের বিষয়। একটি, একশ্রেণির দুর্বৃত্ত প্রশ্নফাঁস করছে। আরেকটি হচ্ছে- গ্রামে গ্রামে মাদক ছড়িয়ে গেছে।'
গত কয়েক বছর ধরে তুমুল আলোচনা-সমালোচনার বিষয় 'প্রশ্নফাঁস' সরকারকে ভয়াবহ যন্ত্রণা দেয় বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম। আওয়ামী লীগের প্রচার উপকমিটির এক সেমিনারে তিনি বলেন, 'প্রশ্নফাঁস বর্তমানে একটা বড় রকমের সমস্যা। কোন দেশ এগিয়ে যাবার সময় এ ধরনের ঘটনা কাম্য নয়। এটা সরকারকে যন্ত্রণা দিচ্ছে।' প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি নিয়ে সরকারকে বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে বলেও স্বীকার করেন তিনি।
এদিকে বিদায়ী ২০১৭ সালের হাওড়ে আগাম বন্যা ও উত্তরাঞ্চলে ধান ডুবে যাওয়ায় চালের দাম উঠেছিল সর্বোচ্চ। যা ছিল বর্তমান সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রম্নতি ১০ টাকার সাড়ে ৫ গুণ, ৫৫ টাকা। বছরের শেষে দাম কিছুটা কমলেও এখন আবার তা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫৫ টাকা। যা আগামী ৩/৪ মাসের মধ্যে আর কমার সম্ভাবনা নেই। আগামী ধানের মৌসুমে দাম ৪/৫ টাকার বেশি কমবে এমন আশাও ক্ষীণ বলে মনে করছেন বাজার পর্যবেক্ষকরা। এ অবস্থায় চালের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি ক্ষমতাসীন দলের ভোটবাক্সে টান ধরাবে বলে মনে করছেন অনেকেই।
বাজার সংশিস্নষ্টরা জানান, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার হিসাব অনুযায়ী দুটি বন্যায় ধানের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১০ লাখ মেট্রিক টন। বন্যায় পূর্বাঞ্চলের হাওড়ে কি পরিমাণ ধান ডুবে যায়, সরকারের কাছে তার সঠিক তথ্য ছিল না। সে কারণে সরকার ঘাটতি পূরণে চাল আমদানি করতে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত্মে যেতে পারেনি। ফলে চাল ব্যবসায়ীরা কৃত্রিমভাবে চালের দাম দ্বিগুণ বাড়িয়েছে। বন্যার আগে মোটা চাল ধরন ভেদে যেখানে ৩৫ থেকে ৩৮ টাকা ছিল। সেখানে মাত্র এক মাসের ব্যবধানে তিন ধাপে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় ওঠে। ৪২ থেকে ৪৮ টাকার চিকন চাল উঠে ৬৫ থেকে ৬৮ টাকাতে। যাতে নির্দিষ্ট আয়ের শ্রমজীবী মানুষের নাভিশ্বাস ওঠে।
এ অবস্থায় সরকার চালের দামে স্বাভাবিক পর্যায়ে আনতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালালেও তা ছিল তুলনামূলক প্রলম্বিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউরের মতে, যারা চাল আমদানির জন্য উদ্যোগ নিয়েছে তারা আরও দ্রম্নত এ সিদ্ধান্ত্ম নিতে পারতেন। চাল আমদানির প্রতিবন্ধকতা দূর করে সরকারি পর্যায়ে চাল আমদানি শুরম্ন করা হয়। বেসরকারি পর্যায়েও চাল আমদানি শুরম্ন হয়। দুই মাসের মধ্যে চাল আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খোলার পরিমাণ ২০ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যায়। তবে ততদিন চালের দাম উঠে সর্বোচ্চে। এর ফলে নতুন আমন ধান উঠার পরও চালের বাজারে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারেনি। যা সরকারকে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে।
এদিকে আগামী সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা নানামুখী তীর্যক মন্ত্মব্য করলেও বহির্বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলো এ বিষয়ে অভিন্ন মত দিয়েছে। তারা সাফ জানিয়েছেন, এবারের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে দেশটির গণতান্ত্রিক মর্যদা ক্ষুণ্ন হবে। পাশাপাশি তাদের কাছেও গ্রহণযোগ্যতা হারাবে।
প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতও বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখতে চাওয়ার কথা জানিয়েছে। পাশাপাশি নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের জন্য 'সহায়ক পরিবেশ' নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে বলে মত দিয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এই বার্তা দিয়ে যান।
বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করছে জাতিসংঘও। গত ১৬ ফেব্রম্নয়ারি নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন দুজারিক জানান, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা হবে বলে আশা করছে জাতিসংঘ।
দুজারিক আরও বলেন, 'আমাদের নীতিগত অবস্থান হলো, এমন পরিবেশ যেন তৈরি করা হয়, যেখানে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে।' তিনি বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে উলেস্নখ করে বলেন, 'এ বিষয়ে এরই মধ্যে আমরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছি।'
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বলেছে, 'নির্ধারিত সময়ের মধ্যে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের আন্ত্মর্জাতিক মান অনুসরণ করে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আমরা আশা করি।'
ইইউ বিবৃতিতে লিখেছে, 'বাংলাদেশ-ইইউ ২০০১ সালে যে সহযোগিতা চুক্তি সই করে তাতে দুই পক্ষই জাতিসংঘ সনদ মেনে মানবাধিকার সুরক্ষার মূলনীতিগুলোর গুরম্নত্বের ব্যাপারে একমত হয় মানুষের মর্যাদা, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, বৈষম্যহীনতা, আইনের শাসন এবং মানবাধিকার দু'পক্ষের কাজের ভিত্তি' ইইউ আরও উলেস্নখ করেছে, 'আমরা দৃঢ়ভাবে মনে করি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।'
এদিকে শুধু বহির্বিশ্বই নয়, দেশের মানুষও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পক্ষে এবার সোচ্চার হয়ে উঠেছে। দেশের প্রায় সব কটি দল, সুশীল সমাজও সবার অংশগ্রহণে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখতে চাচ্ছে।
তবে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে যেভাবে একগুয়েমি চলছে তাতে আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্রের উত্তরণ ঘটবে, নাকি আবারো একটি একদলীয় ভোটারবিহীন নির্বাচনের প্রহসন ঘটবে- তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, একটি অংশগ্রহণমূলক অর্থপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান জাতির আকাঙ্ক্ষা ও দেশের স্বার্থেই জরম্নরি। তাদের মতে, এর মাধ্যমে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পথ অনুসরণ করে বাংলাদেশ দ্রম্নত উন্নতির দিকে এগিয়ে যাবে, দেশ থেকে দারিদ্র্যমোচন হবে, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা চাঙ্গা হবে।
রাজনৈতিক বিশেস্নষকরা বলছেন, সরকার ও নির্বাচনের কমিশনের উচিত হবে, বিগত নির্বাচন যেভাবে জনগণকে হতাশ করেছে, সেই হতাশা দূর করা। সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে যে ব্যাপক স্বাধীনতা দিয়েছে তা সমুন্নত করা এবং অক্ষুণ্ন রাখা। কমিশনকে নিরপেক্ষতার সঙ্গে কাজ করে সব দলের জন্য নির্বাচনক্ষেত্র 'সমতল' করতে হবে। নির্বাচন যাতে অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হতে পারে তার ব্যবস্থা করতে উদ্যোগী হতে হবে।
এদিকে দেশের সর্বস্ত্মরের মানুষ সর্বদলীয় নির্বাচনে আগ্রহ দেখালেও দেশের প্রধান দুই দল এ ইসু্যতে বিপরীত মেরম্নতে অবস্থান করছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলছে, আগামী সংসদ নির্বাচন শেখ হাসিনার অধীনেই হবে। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, 'বিএনপি যাই বলুক না কেন, নির্বাচন ২০১৯ শেখ হাসিনার অধীনেই হবে। আর এতে যদি বিএনপি নির্বাচনে না আসে তাদের জন্য অপেক্ষা করা হবেনা।'
অথচ বিএনপির দাবি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে কোনোভাবেই নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় অবশ্যই একটি নির্বাচনকালীন সরকার থাকতে হবে। যাতে করে মাঠ প্রশাসনের সব সেক্টরে স্বাধীনভাবে কাজ করার মানসিকতা সৃষ্টি হতে পারে।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের একটি আসনে নির্বাচনী প্রচারণায় মাঠে নামা ক্ষমতাসীন দলের একজন প্রার্থী জানান, চলমান এ পরিস্থিতিতে সাধারণ ভোটাররা নির্বাচন নিয়ে অনেকটাই আগ্রহ হারিয়েছে। তাদের কাছে আগাম ভোট চাইতে গেলে তারা তাদের এড়িয়ে চলছেন। এ ধরনের নির্বাচনে জিতে এমপি-মন্ত্রী হলে কি লাভ- অনেকে এমন প্রশ্ন করছেন। এ ধরনের ভোটে অংশ নিলে গণতন্ত্রকে গলাটিপে হত্যা করা হবে বলেও ভোটাররা কেউ কেউ উপদেশ দিচ্ছেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন