প্রশ্নপত্র ফাঁস, চালসহ নিত্যপণ্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ব্যাংকের টাকা আত্মসাতসহ সরকারের নানা ‘কর্মকাণ্ডে’ অস্বস্তিতে রয়েছে ১৪ দলের শরিকরা। জোটের বৈঠকে একাধিকবার বিষয়গুলো উত্থাপন করে ইতিমধ্যে নিজেদের ক্ষোভের কথাও জানিয়েছেন জোটের নেতারা। নির্বাচনের বছরে এ ইস্যুগুলোতে সরকারের আরো কঠোর অবস্থান দেখতে চায় জোটের শরিকরা। তাদের মতে, এসব কারণে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা ‘সরকারের ব্যর্থতা’। সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে এসব ব্যর্থতা কাটিয়ে ওঠার দিকে মনোযোগ দেয়া না হলে নির্বাচনের আগে তা ভোটের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন সরকারের শরিকরা।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলার পর ১৪ দল গঠনের উদ্যোগ শুরু হয়। ২৩ দফা ঘোষণা সামনে রেখে বাম প্রগতিশীল জোট ১১ দল, আওয়ামী লীগ, জাসদ ও ন্যাপ মিলে ১৪ দল গঠিত হয়। পরে সিপিবি, বাসদসহ ১১ দলের চারটি দল বেরিয়ে যায়। ওয়ার্কার্স পার্টি, গণফোরাম, সাম্যবাদী দল, গণতন্ত্রী পার্টি, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, বাসদ (একাংশ) ১৪ দলে থেকে যায়। পরে গণফোরাম জোট থেকে বাদ পড়ে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় এ জোটে যুক্ত হয় জাতীয় পার্টি (জেপি) ও তরীকত ফেডারেশন। এর মধ্যে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাতীয় পার্টির (জেপি) আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বর্তমান সরকারের মন্ত্রিসভায় রয়েছেন। অন্যদিকে মহাজোটের অংশ হিসেবে জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রেসিডিয়াম সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মজিবুল হক চুন্নু ও মশিউর রহমান রাঙ্গা মন্ত্রিসভায় রয়েছেন। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রধানমন্ত্রী বিশেষ দূতের দায়িত্বে রয়েছেন।
১৪ দল নেতাদের মতে, তারা এখনো আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটে ও সরকারে আছেন। জোটবদ্ধ হয়েই আগামী নির্বাচনেও অংশ নিতে চান তারা। এ সরকারের দুই মেয়াদেই অনেক উন্নয়ন হয়েছে সত্য, তবে তাদের বেশ কিছু কর্মকাণ্ডও সমালোচিত হচ্ছে। এ কারণে জোটের শরিক হওয়ায় ক্ষমতাসীনদের এসব ইস্যু ও কর্মকাণ্ড তাদের ভোটেও প্রভাব ফেলতে পারে। আলাদা দল হলেও এতে তারা অস্বস্তিতে রয়েছেন। ফলে ভোটের আগেই এই ‘নেতিবাচক’ ইস্যুগুলো যে কোনো মূল্যে কাটিয়ে ওঠার পক্ষে মত দেন তারা।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, এর আগে ১৪ দলের বেশ কয়েকটি বৈঠকে এই ইস্যুগুলোতে সরকারকে আরো কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন শরিক দলের নেতারা। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, ১৪ দলের মুখপাত্র স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের কাছেও একাধিকবার বিষয়গুলো উল্লেখ করেছেন তারা। আওয়ামী লীগের নেতারাও শরিকদের সঙ্গে একমত পোষণ করে দলের হাইকমান্ডকে অবহিত করার আশ্বাস দেন। ৫ ফেব্রুয়ারি ১৪ দলের সর্বশেষ বৈঠকেও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন বিষয় আলোচনায় আসে। জানা গেছে, নেতারা দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বৈঠকে বলেন, লাগামহীন দ্রব্যমূল্য আগামী নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। নির্বাচনের আগে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। এ ছাড়া ১৪ দলের বৈঠকের বাইরেও জোটের নেতাদের মাঝে মধ্যে এ বিষয়গুলো নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে।
সর্বশেষ গত সোমবার জাতীয় সংসদে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন প্রশ্নপত্র ফাঁস, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও ব্যাংকিং খাতের ‘দুরবস্থার’ সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, শিক্ষা ক্ষেত্রে সুবাতাস টেকেনি। এবারের প্রশ্নপত্র ফাঁসের মহামারি কেবল পরীক্ষার্থী নয়, তাদের অভিভাবকদেরও সরকার সম্পর্কে বিরূপ ধারণার জš§ দিয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এর দায়িত্ব নিতে রাজি নয়। ব্যাংকিং খাতে দুরবস্থার চিত্র তুলে ধরে সমাজকল্যাণমন্ত্রী বলেন, শিক্ষার পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতের নৈরাজ্য চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে। সরকারকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধন জোগাতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির টাকা ফিরে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা আমি জানি না। প্রতিনিয়ত বিদেশে অর্থ পাচার হচ্ছে। এই পাচারকৃত অর্থে বাংলাদেশের কয়েকটি বাজেট হতে পারে।
অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের ১৪ দলের প্রতিশ্রুতি ছিল, দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন দূর করা। খালেদা জিয়ার এই দণ্ডদান ১৪ দলের সেই রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের সূচনা মাত্র। তবে এখন অনেক বড় বড় দুর্নীতি আমাদের হাতের মাঝে থেকে যাচ্ছে। অর্থপাচার, ঋণ জালিয়াতির তদন্ত আশা করি করা হবে। দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে। পাকিস্তান পানামা পেপারস নিয়ে তদন্ত করতে পারলে আমরা পারছি না কেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ১৪ দলের বেশ কয়েক নেতা মানবকণ্ঠকে বলেন, আমরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে আছি। সরকারের টানা দুই মেয়াদে যে উন্নয়ন হয়েছে তাতে আমরা সন্তুষ্ট। তবে একই সঙ্গে সরকারের বেশ কিছু কর্মকাণ্ড জনমনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এগুলো থেকে উত্তরণ দরকার। যেমন ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় সরকারের দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া বাজার ব্যবস্থাপনায়ও দুর্বলতা রয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস মহামারি আকার ধারণ করছে। এগুলোর প্রতি সরকারকে আরো গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ নির্বাচনের বেশি দেরি নেই। এগুলো আগামী দিনে ভোটে প্রভাব ফেলতে পারে। আমরা এগুলো ১৪ দলের ফোরামে বার বার বলেছি, আগামীতেও বলব।
এ বিষয়ে ১৪ দলের শরিক বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের নেতা ও সাবেক মন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া মানবকণ্ঠকে বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস, চালসহ নিত্যপণ্যের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ব্যাংকের দুরবস্থাসহ বিভিন্ন বিষয়গুলো নিয়ে আমরা এর আগেও ১৪ দলের বৈঠকে আলোচনা করেছি। সেখানে সরকারকে এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বানও জানিয়েছি। ভবিষ্যতেও এ বিষয়ে আমরা জোটের বৈঠকে এবং বৈঠকের বাইরেও কথা বলব।
মানবকণ্ঠ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন