খালেদা জিয়া কারাগারে; নির্বাচনের চেয়ে তার মুক্তি বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে বিএনপির কর্মসূচিতে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলছে, তাদের ভাবনায় এখন শুধুই নির্বাচন। এই মুহূর্তে বিএনপির নির্বাচন ভাবনা না থাকলেও, দলটির নেতৃত্বাধীন ২০ দলের শরিকরা আসনের ভাগাভাগির ফয়সালা চায়। ১৯ শরিকের দাবির তালিকায় রয়েছে শতাধিক আসন। খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে এ বিষয়ে ভোটের আলাপে নারাজ বিএনপি। তবে শরিকরা নিচ্ছে ভোটের প্রস্তুতি।
আওয়ামী লীগকে মোকাবেলায় জোট সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, ড. কামাল হোসেন, আ স ম আবদুর রবের দলকে নিয়ে ২০ দলের বাইরে মহাজোটের আদলে পৃথক 'প্ল্যাটফর্ম' গড়ার পরিকল্পনা করছে। বিএনপির পরিকল্পনা, এই 'প্ল্যাটফর্ম' হবে আগামী নির্বাচনের জন্য।
বিএনপির এ পরিকল্পনায় ২০ দলের ছোট শরিকরা আসনের 'হিস্যা' হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে রয়েছে। বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন, সব শরিকের জন্য সর্বোচ্চ ৫০ আসন ছাড়বেন তারা। কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর একারই দাবি ৫০ আসন। বাকি দলগুলোর দাবির তালিকায় রয়েছে আরও অর্ধশতাধিক আসন।
জানতে চাইলে ২০ দলের সমন্বয়ক ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সমকালকে বলেন, 'খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন এ মুহূর্তে জোটের প্রধান কর্তব্য। আগামী নির্বাচন কিংবা আসন বণ্টন প্রশ্নে জোটের মধ্যে কোনো সমস্যা নেই।' এ বিষয়ে সময় মতো সিদ্ধান্ত হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
তবে জোটভুক্ত অধিকাংশ নেতার দাবি, গত নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে লোভনীয় প্রস্তাব ছিল। ভয়-ভীতিও ছিল। সব উপেক্ষা করে ২০১৩ ও ২০১৫ সালের 'আন্দোলনে' বিএনপি চেয়ারপারসন জোটনেত্রী খালেদা জিয়ার নির্দেশে তারা যার যার সাধ্যমতো রাজপথে ছিলেন। আশ্বাস ছিল, তাদের ভূমিকার মূল্যায়ন করা হবে। কিন্তু পরে পৌর ও ইউপি নির্বাচনে তাদের মূল্যায়ন করা হয়নি। ২৩৫টি পৌরসভার মাত্র তিনটি শরিকদের ছেড়ে দেয় বিএনপি। তাই এবার আগেভাগেই ফয়সালা চান তারা। একাধিক নেতা সমকালকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
২০০১ ও ২০০৮ সালে চারদলীয় জোটের ব্যানারে নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। ২০০১ সালে শরিকদের ৪৫ আসন ছেড়েছিল দলটি। সেই সময়কার ইসলামী ঐক্যজোট ও বিজেপিকে ১৫ আসন ছাড়লেও, দল দুটির প্রার্থীরা 'ধানের শীষ' প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেন। ২৭০ আসনে ছিল ধানের শীষের প্রার্থী। বাকিগুলোতে জামায়াত 'দাঁড়িপাল্লা' প্রতীকে জোটের সমর্থনে ভোটে লড়ে। ২০০৮ সালে জামায়াতকে ৩৫ আসন ছেড়ে দেয় বিএনপি। ২৬০ আসনে ছিলেন 'ধানের শীষ'-এর প্রার্থী। এর মধ্যে কয়েকজন ছিলেন শরিক দলের। যারা বিএনপির প্রতীকে ভোটে লড়েছিলেন।
জামায়াত : ২০০১ সালে বিএনপির সঙ্গে জোট করে ৩১টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল জামায়াত। একটি আসনে দুই দলেরই প্রার্থী ছিল। ২০০৮ সালে ৩৯ প্রার্থী ছিল দলটির। চারটি আসনে বিএনপি-জামায়াত দুই দলেরই প্রার্থী ছিল। দশম সংসদ নির্বাচনে ৪৩ আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছিল। এবার দলটির দাবি অন্তত ৫০ আসন।
২০১৩ সালে হাইকোর্টের রায়ে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। আপিলে নিবন্ধন ফিরে না পেলে আগামী নির্বাচনে দলীয় পরিচয়ে অংশ নিতে পারবে না। নিবন্ধন ফিরে না পেলে আগামী সংসদ নির্বাচনেও একই প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি রয়েছে দলটির।
আগামী নির্বাচনে একই পথে হাঁটতে পারে দলটি। যদিও যুদ্ধাপরাধের দায়ে দলের শীর্ষ নেতাদের সাজা কার্যকর হওয়ায় দলটিতে 'হেভিওয়েট' প্রার্থীর সংকট রয়েছে। ফাঁসির রায় রয়েছে মাওলানা আবদুস সুবহান ও এটিএম আজাহারুল ইসলামের। আমৃত্যু কারাদণ্ডের সাজায় জেলে রয়েছেন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। জামায়াতের সিদ্ধান্ত, এ আসনগুলো তারা ছাড়বে না।
দলের কর্মপরিষদ সদস্য এহসানুল মাহবুব জোবায়ের জানিয়েছেন, দণ্ডিত নেতাদের আসনে জয়ী হওয়ার প্রার্থী রয়েছে। ধরপাকড়ে কোণঠাসা হয়ে পড়লেও জামায়াতে অন্তত ৫০টি আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি রয়েছে বলে তার দাবি।
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি : ২০০৮ সালে বিএনপির সঙ্গে জোট করে নির্বাচন করে এলডিপি। একটি আসনে জোটের মনোনয়ন পেলেও ১৯টি আসনে প্রার্থী ছিল দলটির। এবারও ২০টি আসনে প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতি রয়েছে দলটির। এলডিপি সভাপতি ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ চট্টগ্রাম-১৩, ড. রেদোয়ান কুমিল্লা-৭, শাহাদাত হোসেন সেলিম লক্ষ্মীপুর-১, আবদুল করিম আব্বাসী নেত্রকোনা-১ থেকে প্রার্থী হতে চান। অলি আহমদ দাবি করেছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন ও জোটনেত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোট ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছে।
জাতীয় পার্টি (জাপা-জাফর) : ২০১৩ সালে এরশাদের জাপার একাংশ প্রয়াত কাজী জাফর আহমদের নেতৃত্বে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দেয়। দলটিতে ১৭ সাবেক এমপি রয়েছেন। আগামী নির্বাচনে জাপা (জাফর) ২০টি আসন চায়। দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য নওয়াব আলী আব্বাস খান এ তথ্য জানিয়েছেন। মৌলভীবাজার-১ আসন থেকে জাপার মনোনয়নে দুইবার নির্বাচিত এ নেতা আগামীতে বিএনপি জোটের প্রার্থী হতে চান। গাইবান্ধা-৩ আসনে প্রার্থী হতে পারেন জাপার (জাফর) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ড. টি আই ফজলে রাব্বী চৌধুরী। এ আসন থেকে তিনি ছয়বার নির্বাচিত হয়েছেন।
এদিকে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ ভোলা-১ আসন বা ঢাকার একটি আসন থেকে মনোনয়ন চাইবেন।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম : অষ্টম সংসদ নির্বাচনে দুইজন এমপি ছিল জমিয়তের, যারা বিএনপি জোটের মনোনয়নে জয়ী হন। সম্প্রতি জমিয়ত ভেঙে গেছে। দুই অংশই ২০ দলের শরিক। শায়খ আবদুল মোবিনের নেতৃত্বাধীন অংশ পাঁচটি আসন চায়। সুনামগঞ্জ-৩ আসনের সাবেক এমপি কাজী শাহীনূর পাশা একই আসনে জোটের প্রার্থী হতে চান। সিলেট অঞ্চলে প্রার্থী হতে চান সহসভাপতি আবদুর রব ইউসুফী ও সাংগঠনিক সম্পাদক মুনতাসির আলী। যশোর-৩ আসনের সাবেক এমপি মুফতি ওয়াক্কাসের নেতৃত্বাধীন অংশও একই সংখ্যক আসনে জোটের মনোনয়ন চায়।
খেলাফত মজলিশ : ২০০১ সালে ইসলামী ঐক্যজোটের ব্যানারে দলটি এক আসনে জয়ী হয়েছিল। ওই নির্বাচনে নড়াইল-২ আসনে জয়ী মুফতি শহীদুল ইসলাম দল ছেড়েছেন। আগামী নির্বাচনে কোন কোন আসনে খেলাফত নির্বাচন করতে চায় তা চূড়ান্ত না করলেও, অন্তত দুই/তিনটি আসনে তারা জোটের মনোনয়ন দাবিদার এমনটিই জানিয়েছেন দলের মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের। তিনি হবিগঞ্জে প্রার্থী হতে চান।
কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক (চট্টগ্রাম-৪), মহাসচিব এম.এম. আমিনুর রহমান (পাবনা-১) আসনে মনোনয়ন চাইবেন। ন্যাপের চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি (নীলফামারী-১), মহাসচিব এম. গোলাম মোস্তফা ভূইয়া (নরসিংদী-৩) আসনে মনোনয়ন চাইবেন। এর বাইরেও আরও ১০টি আসনে নিজেদের প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানান মোস্তফা ভূইয়া।
জাগপার প্রয়াত চেয়ারম্যান শফিউল আলম প্রধানের স্ত্রী রেহানা প্রধান অথবা তার মেয়ে তাসমিয়া প্রধান প্রার্থী হতে পারেন। দলটির মহাসচিব খন্দকার লুৎফর রহমান বগুড়া-১ থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এনপিপির ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ নড়াইল-২, এনডিপির খোন্দকার গোলাম মোর্ত্তজা পাবনা-২, মুসলিম লীগ-বিএমএলের এএইচএম কামরুজ্জামান খান কিশোরগঞ্জ-৫, ডেমোক্রেটিক লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দিন আহমেদ মনি ময়মনসিংহ-৮ আসনে মনোনয়ন চাইবেন।
সাম্যবাদী দলের কমরেড সাঈদ নারায়ণগঞ্জ থেকে নির্বাচন করতে চান। লেবার পার্টির নিবন্ধন না থাকলেও এর একাংশের চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান পিরোজপুর-২ ও ঢাকা-১৫ থেকে মনোনয়ন চাইবেন বলে জানিয়েছেন। এছাড়া জোটভুক্ত দল বাংলাদেশ পিপলস্ লীগ, বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি, ন্যাপ ভাসানী ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করতে চায় বলে জানা গেছে। ২০০১ সালের নির্বাচনে ইসলামী ঐক্যজোটকে চারটি আসন ছেড়েছিল বিএনপি। তবে দলটির মূল অংশ জোট থেকে বেরিয়ে গেছে। আবদুর রকিবের নেতৃত্বাধীন অংশও আসনের দাবিদার।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন