বাংলা ভাষার বিকৃতি পীড়া দেয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। বিদেশি উচ্চারণে বাংলা বলার চেষ্টা, বিদেশি ভাষায় প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা, উচ্চ আদালতে বাংলার চর্চা না হওয়ায় হতাশ প্রধানমন্ত্রী বিশেষভাবে নাখোশ ইংরেজি ভাষায় দাওয়াতপত্র ছাপানোয়।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের স্মরণে শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনে শনিবার রাজধানীতে আওয়ামী লীগের আলোচনায় বক্তব্য রাখছিলেন প্রধানমন্ত্রী।
এই আলোচনায় বঙ্গবন্ধু কন্যা বক্তব্য দেয়ার আগে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী সৈয়দ আনোয়ার হোসেন এবং রফিকুল ইসলাম বাংলা ভাষা চর্চায় অনীহা নিয়ে নানা সমালোচনা করেন। বিশেষ করে উচ্চ আদালতে বাংলা ব্যবহার না করা, সাইনবোর্ডে বাংলা ব্যবহার না করা, আর হাল আমলের প্রবণতা ইংরেজিতে দাওয়াতপত্র লেখার কথা তুলে ধরেন। সেই সঙ্গে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার চর্চা না হওয়ার বিষয়টিও তুলে ধরেন তারা।
পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এসব প্রতিটি বিষয়ে একমত হন। জানান, তিনি বিষয়গুলো নোট করে নিয়েছেন, এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন।
ইংরেজি ভাষায় বিয়ের দাওয়াতপত্র নিজেও পান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এটা ঠিকই, বিয়ের কার্ড হয় ইংরেজি ভাষায়। জানি না কেন হয়। সেদিন একজনের মেয়ের বিয়ে। আমি জিজ্ঞাস করলাম ইংরেজি ভাষায় কেন? কিসের জন্য দাওয়াতের কার্ড ইংরেজি ভাষায় লিখতে হবে?’
‘আমি ঠিক জানি না, মর্যাদার কোনো বিষয় আছে কি না সেটা আমি বুঝি না, কিন্তু ইংরেজি ভাষায় লেখে। এটা কিন্তু ব্যাপকভাবে ব্যধির মতো ছড়িয়ে গেছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘হ্যাঁ যদি কোনো ইংরেজি ভাষাভাষির জন্য যদি তৈরি করেন, তাহলে সেটা গ্রহণযোগ্য। কিন্তু আমরা বাংলা ভাষায় লিখব না কেন, এই দৈন্যতাটা কেন দেখাতে হবে এটা আমিও বুঝি না।’
‘উচ্চ আদালতে বাংলায় রায় না লেখার সমালোচনা’
উচ্চ আদালতের রায় বাংলায় না হওয়ায় বিচারপ্রার্থীরা ঠকছেন বলেও মনে করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমাদের তো অনেক সাধারণ মানুষ আছে। তারা ইংরেজি ভাষা জানে না। উকিল সাহেব ওই রায়ের পর যেটা বুঝান, সেটাই তাদের বুঝতে হয়।’
‘উকিল সাহের ভালো করে বললেন না বা বুঝলেন না, কিন্তু এমন কথা বলে দিলেন, যাতে পকেট থেকে তার আরও টাকা খসল।
‘রায়টা পাওয়ার পর সাধারণ মানুষ তো সেটা পড়ে বুঝতে পারবেন না। তিনি যার ওপর নির্ভর করছেন, তিনি যেভাবেই বলছেন, সেটার ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে। তাতে তার যদি পকেট খালি হয়, সেটাও হচ্ছে। কাজেই তাকে জানার, বুঝার সুযোগটা তো দিতে হবে।’
তবে এই চিত্র বেশিদিন থাকবে না বলেও আশা করেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘এখন নিম্ন আদালতে শুরু হয়ে গেছে বাংলা ভাষায় রায় লেখা, আমরা আশা করি উচ্চ আদালতেও ভবিষ্যতে...’।
‘দীর্ঘদিনের একটা চর্চা, চট করে পরিবর্তন করা সম্ভব না, তার পরও আমরা আশা করি নিশ্চয় সেটা লেখবে। প্রয়োজনে সেটা ইংরেজিতে অনুবাদ করা হোক, অনুবাদের বিরুদ্ধে আমরা না। কিন্তু অন্তত যারা ন্যয়বিচার চাচ্ছিল তারা কী বিচার পেল অন্তত সেটুকু তো তারা জানতে পারবেন, সে সুযোগটা তো তারা পারবে।’
বিকৃত উচ্চারণের নিন্দা্
অনেকেই বাংলা এখন অনেকটা ইংরেজির ঢংয়ে বলেন জানিয়ে এরও সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘ভাষাটাকে বিকৃত করে বলার একটা চর্চা শুরু হয়ে গেছে। সেটা কেন আমি জানি না। ...যারা এখানেই মানুষ হচ্ছে, তাদের মধ্যে এই বিকৃতিটা কেন?’
বিদেশে অবস্থানকালে শেখ রেহানা এবং তিনি তাদের সন্তানদের বাংলা বলতে শেখা, পড়তে শেখা ও লিখতে শেখার চেষ্টা করেছেন বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার নিজের দেশে যে ভাষার জন্য... রক্তের অক্ষরে যে ভাষার মর্যাদা রেখে গেছে, আমরা সেটা শিখব না কেন, আমরা সেটা বলব না, কেন, আমরা সেটার চর্চা করব না কেন।’
বাংলা ভাষার মর্যাদার বিষয়টি কেবল ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখের নয় জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘শুধু দিবসটা আসল, পালন করলাম, সেটা না। সাইনবোর্ড লেখা হয়, ইংরেজি ভাষায়।... অন্য ভাষা দিতে চায়, সেটা দিক। কিন্তু মাতৃভাষা তো বড় করে লিখবে। অন্য ভাষা ছোট করে আলাদাভাবে লিখুক, আমাদের আপত্তি নেই।’
দ্বিতীয় ভাষা শিখতে হবে
বাংলা ভাষার ওপর জোর দিয়েও ভিনদেশি ভাষা শেখার ওপর গুরুত্বারোপ করেন প্রধানমন্ত্রী। বিশেষ করে ইংরেজি শেখার তাগাদা দেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘দ্বিতীয় ভাষা, এটা কিন্তু পৃথিবীর সব দেশেই আছে। একটা হচ্ছে মাতৃভাষা শিক্ষা, আরেকটা হচ্ছে দ্বিতীয় ভাষা শিক্ষা। এই দ্বিতীয় ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থাটা করতে হবে। কারণ, এখন বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ, আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ করে দিয়েছি, এখন গ্রামে বসে আমাদের ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন ভাষা শিখে অনলাইনে অর্থ উপার্জন করছে। এই সুযোগটা সৃষ্টি করতে হবে।’
‘ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষার মাধ্যম হয়ে গেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ইংরেজি ভাষাটা শিখছে। ...যখন আমাদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কথা বলতে হয়, তখন আমরা বললাম।’
বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে গেলে অন্য ভাষা শিখতেই হবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী এও বলেন, অন্য ভাষা না শিখতে পারলে উন্নত হওয়া যাবে না, এটাও মনে করেন না তিনি। এ ক্ষেত্রে তিনি জাপানিদের উদাহরণ দেন। বলেন, ‘সারা বিশ্বে এক সময় অর্খনৈতিকভাবে সব থেকে উন্নত জাতি হিসেবে তারা নিজেদেরকে গড়ে তুলেছিল। এখনও জাপানি ভাষাই তারা ব্যবহার করে।’
ঢাকাটাইমস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন