দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যদি নির্বাচনের অযোগ্য বিবেচিত হন তাহলেও উদ্ভূত পরিস্থিতিই বিএনপিকে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে নিয়ে যেতে পারে। কারণ এ ছাড়া দলটির সামনে ওই সময় ভালো বিকল্প আর কিছুই থাকবে না।
এমন আলোচনা দলীয় নেতাদের পাশাপাশি সমর্থক সুধীজনদের মধ্যেও ঘুরেফিরে উঠছে। এ ছাড়া নির্বাচনের সময় খালেদা জিয়া একান্তই দলের হাল না ধরতে পারলে বিকল্প হিসেবে তারেক রহমানের স্ত্রী জোবাইদা রহমানের নাম উঠছে দলের মধ্যে। বিএনপির সংশ্লিষ্ট নেতারা বলছেন, খালেদা ও তারেকের অনুপস্থিতিতে পরিস্থিতিই জোবাইদাকে টেনে আনতে পারে।
এসব বিষয়ে দলটির মধ্যে আনুষ্ঠানিক কোনো আলোচনা অবশ্য এখনো হয়নি। তবে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজা হওয়ার পর বিএনপি চেয়ারপারসন কারাগারে যাওয়ায় দলটির সামনে কী করণীয়, সে আলোচনা অনানুষ্ঠানিকভাবে সামনে আসছে। বিএনপি নেতাদের আশঙ্কা, শেষ পর্যন্ত জামিনে খালেদা জিয়ার মুক্তি মিললেও আইনগত মারপ্যাঁচে তাঁকে নির্বাচনে অযোগ্য গণ্য করা হতে পারে। বিএনপি নেতারা এমন অভিযোগ প্রকাশ্যেই করছেন। আর আওয়ামী লীগ ও নির্বাচন কমিশন বলছে, বিষয়টি আদালতের ওপর নির্ভর করছে।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, খালেদা জিয়া নির্বাচনের অযোগ্য বিবেচিত হলে বিএনপির সামনে দুটি পথ খোলা থাকবে।
প্রথমত, খালেদা জিয়াকে ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং দ্বিতীয়ত, খালেদা জিয়ার সম্মতি নিয়েই নির্বাচনে যাওয়া।
খালেদা জিয়া কী সিদ্ধান্ত দেবেন, দলটির নেতাদের কাছে তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে কারাগারে যাওয়ার আগে যে অবস্থান তিনি ব্যক্ত করে গেছেন, তা বেশ ইতিবাচক বলেই ধরে নিয়েছেন নেতারা। খালেদা জিয়া সংঘাতের পথ পরিহার করে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করার জন্য নেতাদের নির্দেশ দিয়ে গেছেন। আর বিএনপি এখনো সেই অবস্থানেই আছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনাও এখনো ইতিবাচকই আছে। ফলে অন্য কোনো ‘অপশন’ না থাকলে শেষ পর্যন্ত খালেদা জিয়া ইতিবাচক পথে থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার নির্দেশনাই দিতে পারেন বলে মনে
করছে বিএনপির বড় একটি অংশ। যদিও কৌশলগত কারণে বিএনপি এ বিষয়ে অবস্থান এখনই স্পষ্ট করতে রাজি নয়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ মনে করেন, খালেদা জিয়া জামিনে মুক্তি লাভ করবেন। তবে তাঁকে নির্বাচনে অযোগ্য ‘ঘোষণা’ করা হলে নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়ার বিষয়ে এখনই ‘কনক্লুশনে’ আসা যাবে না। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ইট ইজ টু আরলি। নির্বাচনের এখনো বেশ সময় বাকি আছে। তা ছাড়া এটি আইন-আদালতের ব্যাপার। ’ তাঁর মতে, বিএনপির জনসমর্থন অনেক। কিন্তু খালেদা জিয়ার অবস্থা কী হবে, নির্বাচনের আগে সে বিষয়ে জনগণ জানতে চাইবে। ফলে পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জনগণের ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ায় বিশ্বাস করে বিএনপি। কারণ বিএনপি নির্বাচনের দল। তবে চেয়ারপারসনকে সরকার অযৌক্তিকভাবে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করলে জনমনে তার ব্যাপক প্রতিক্রিয়া ঘটবে। ওই অবস্থায় বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে। তবে খালেদা জিয়াকে ছাড়া এ দেশের কোনো নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। ’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘চেয়ারপারসনকে অযোগ্য ঘোষণা করা হলে বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত এত তাড়াতাড়ি নেওয়া যাবে না। সময়ই তা বলে দেবে। বাইরে এ প্রসঙ্গে যে আলোচনা সেটিকে স্পেকুলেশন ছাড়া কিছুই বলা যায় না। তবে এটি ঠিক যে সরকার চাইছে না যে বিএনপি নির্বাচনে যাক। ’
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী আহমেদ প্রায় প্রতিদিনই বলছেন, খালেদা জিয়া ছাড়া কোনো নির্বাচন হবে না। দলের সিনিয়র অন্য নেতারা বলছেন, খালেদা জিয়াকে মুক্ত করেই বিএনপি নির্বাচনে যাবে। অর্থাৎ নির্বাচনের পক্ষেই এখনো তাঁদের অবস্থান। কিন্তু খালেদা জিয়া অংশ না নিতে পারলেও বিএনপি নির্বাচনে যাবে—এ কথা কৌশলগত কারণে বলতে পারছেন না তাঁরা। তবে নির্বাচন সামনে রেখে যে রাজনৈতিক চিত্র তাঁদের সামনে ভেসে উঠছে, তাতে খালেদা জিয়াকে জামিনে মুক্ত করানোর পাশাপাশি ‘নিরপেক্ষ’ নির্বাচন আদায় করার দাবি তাঁরা সরকারকে মানতে বাধ্য করতে পারবেন কি না, এ নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি বিএনপি যাতে নির্বাচন থেকে দূরে থাকে—এমনটিই সরকার চাইছে বলে বিএনপি মনে করে।
দলটির নেতাদের মতে, বিএনপিকে নির্বাচনের ব্যাপারে নেতিবাচক অবস্থানে নিতেই খালেদা জিয়াকে সাজা দিয়ে কারাগারে নেওয়া হয়েছে। রায় ঘোষণার দিনই বিএনপি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করুক এবং তার সূত্র ধরে
দলটির নেতাকর্মীদের ওপর ‘ক্র্যাকডাউন’ চালানোর পরিকল্পনা সরকারের ছিল বলে বিএনপি বিশ্বাস করে। কিন্তু আগেই সেটা বুঝতে পেরে বিএনপি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে যায়।
এদিকে খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে দলের সিনিয়র নেতারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে হাল ধরেছেন। কিন্তু তাঁর জামিনে মুক্তি না মিললে ওই ইস্যুতে আন্দোলন, পাশাপাশি নিরপেক্ষ নির্বাচন আদায়ের আন্দোলনে গেলে তাতে কতখানি সফলতা পাওয়া যাবে, সে নিয়ে তাঁরা নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। অন্যদিকে নির্বাচনে না গেলে দলের নিবন্ধন বাতিলের জন্য চাপ তৈরি হবে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ও নির্বাচনে আগে ঘোষণা হতে পারে। তারেক রহমান ওই মামলার আসামি। অনেকের মতে, রায় ঘোষিত হওয়ার পর বিএনপির নেতৃত্বে তারেকের থাকা না থাকা নিয়েও নতুন করে বিতর্ক তৈরি হতে পারে।
সম্ভাব্য ওই পরিস্থিতির প্রসঙ্গ উঠলে অনেকে আবার জোবাইদা রহমানের নাম নিচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, নির্বাচনী প্রচারে জিয়া পরিবারের কারো না কারো মাঠে থাকতে হবে। সেদিক থেকে দলের ভেতরে ও বাইরে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মনে করা হচ্ছে জোবাইদাকে।
অবশ্য ওই সময় পর্যন্ত বিএনপির নেতাকর্মীরা কতটা সক্রিয় থাকতে পারবে, সেটা নিয়েও সংশয় আছে নানা মহলের। ওই পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়া নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে পারেন বলে অনেকে মনে করছেন।
বিকল্পধারার সভাপতি সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী মনে করেন, খালেদা জিয়া নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত দিলেও তাঁর ছেলে তারেক রহমান কী করবেন, সেটি নিশ্চিত নয়। তাঁর মতে, বিএনপির সমস্যা এখনো লন্ডন আর ঢাকা। তিনি বলেন, ছেলের স্বার্থের বাইরে বিএনপি নেত্রী যাবেন কি না, সেটি সময় বলে দেবে। এ ছাড়া বিএনপির নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়টি ওই সময়কার পরিস্থিতি, বিশেষ করে লন্ডন (তারেকের মনোভাব), খালেদা জিয়ার মামলার গতি-প্রকৃতি, আন্তর্জাতিক চাপ—সব কিছুর ওপর নির্ভর করবে। বি চৌধুরী আরো বলেন, ‘বিএনপি না এলেও সরকার এককথায় নির্বাচন করে ফেলবে, বিষয়টি এত সহজ নয়। কারণ সরকারকে একটি ক্রেডিবল (বিশ্বাসযোগ্য) পার্লামেন্ট দেখাতে হবে। এটি দেশের জনগণের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলেরও দাবি। তাই সব কিছুর জন্য অপেক্ষা করতে হবে। সরকার কী পদক্ষেপ নেয়, সেটিও দেখার বিষয়। ’
শত নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘নির্বাচনে যাওয়াই বিএনপির লক্ষ্য। তবে খালেদা জিয়া নির্বাচন করতে না পারলে শেষ পর্যন্ত বিএনপি কী করবে, সেটি এখনই বলা সম্ভব নয়। তবে এটুকু বলা যায়, খালেদা জিয়াকে সরকার নির্বাচন করতে না দিলে জনগণ আরো বেশি পরিমাণে বিএনপির দিকে ঝুঁকে পড়বে। সে পরিস্থিতিতে দলটির নির্বাচনে যাওয়া অসম্ভব নয়। ’
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতে, খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করা সরকারের জন্য কঠিন। কিন্তু সরকার যদি সে পথে যায়ও, তার পরও বিএনপি নির্বাচনে যাবে। তিনি বলেন, বিএনপি নির্বাচনে গেলে সরকারেরই বেশি ক্ষতি হবে। আবার বিএনপিরও না গিয়ে উপায় নেই। তাদের টিকে থাকতে হলে লড়াই করতে হবে। তবে বিএনপির উচিত হবে সব বিরোধী দলকে ঐক্যবদ্ধ করে নির্বাচনে যাওয়া।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন