কূটনীতিকদের কাছে দেশের ২০টি বিশেষ চ্যালেঞ্জের কথা জানিয়েছে বিএনপি। সেই সঙ্গে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, ন্যায়বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ও নিষ্পত্তিমূলক ভূমিকা রাখতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দলটি। কূটনীতিকদের কাছে বিশেষভাবে অনুরোধ জানিয়েছে যেন বাংলাদেশের সত্যিকারের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তারা নিজ নিজ দেশের সরকারকে অবহিত করেন। বুধবার কূটনীতিকদের আনুষ্ঠানিক ব্রিফে তারা দেশের বিশেষ ২০টি সমস্যার কথা তুলে ধরে এ অনুরোধ জানান। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, লিখিত ব্রিফে পয়েন্ট আকারে সুনির্দিষ্টভাবে দেশের এসব চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করে বিএনপি। চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে- ১. দেশের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক সকল প্রতিষ্ঠান পুরোপুরিভাবে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।
২. দেশে এখন সুশাসনের অভাব, সুশাসনকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। ৩. বিচারবহির্ভূত হত্যা, জোরপূর্বক গুম ও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তীব্র আকার ধারণ করেছে। ৪. সর্বক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অনুপস্থিতি ব্যাপকতা পেয়েছে। ৫. আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘন এখন সহ্যাতীত পর্যায়ে চলে গেছে। ৬. দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা একেবারেই কুণ্ঠিত এবং শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে বাকস্বাধীনতা। ৭. সর্বক্ষেত্রে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ৮. গণতন্ত্র এখন বিপদাপন্ন অবস্থায় চলে গেছে। ৯. জীবনের সকল ক্ষেত্রে বিরাজ করছে অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা। ১০. সরকারি সকল পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস ও গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষার অভাব বড় একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১১. ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে নিরাপত্তাহীনতা। ১২. নারীদের ওপর নির্মমতা (ধর্ষণ, যৌন হয়রানি ইত্যাদি) ব্যাপক আকারে বেড়ে গেছে। ১৩. দুর্নীতি ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। ১৪. ক্ষমতাসীনরা দেশের ব্যাংকিংখাত লুটে নিচ্ছে। ১৫. বাংলাদেশে মাদকাসক্তি একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৬. নৈতিকতার অবক্ষয় এখন একেবারে নিম্নস্তরে পৌঁছে গেছে। ১৭. জনপ্রশাসন ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা পুরোপুরি দলীয় পক্ষাবলম্বী হয়ে পড়েছে। ১৮. নাগরিক সমাজে ভীতি (ফিয়ার সিন্ড্রোম) ছড়িয়ে পড়েছে এবং ১৯. বিচার বিভাগ এখন আর স্বাধীন নয়। এবং ২০. দেশের সমাজ আজ বিভক্ত হয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ব্রিফের প্রথমাংশ জুড়ে ছিল বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা, বিচার প্রক্রিয়া, সাজা, জামিন আটকে দেয়া এবং কারাগারে তার ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের প্রসঙ্গগুলো। দ্বিতীয়াংশে বাংলাদেশের বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, ন্যায়বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় স্পষ্টভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় এবং নিষ্পত্তিমূলক ভূমিকা প্রত্যাশা করেন বিএনপি নেতারা। কূটনীতিকদের কাছে চ্যালেঞ্জগুলোর তীব্রতা বুঝাতে সম্প্রতি পুলিশি রিমান্ডের পর কারাগারে ছাত্রদলের এক নেতার মৃত্যু, জাতীয় প্রেস ক্লাব আঙ্গিনা থেকে অস্ত্র উঁচিয়ে, মানববন্ধনে বিএনপি মহাসচিবের পাশ থেকে চ্যাংদোলা করে ছাত্রদল কর্মীকে গ্রেপ্তার, সাবেক একাধিকবারের এমপিকে কলার চেপে ধরে আটক, বিএনপির সিনিয়র নেতাকে গ্রেপ্তারের পর কোমরে দড়ি বেঁধে থানায় নেয়া, কর্মসূচিতে নারী কর্মীদের ওপর হামলা ও গ্রেপ্তারের ছবি এবং বিগত দুই মাসে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও গ্রেপ্তারের পরিসংখ্যান তুলে ধরেন বিএনপি নেতারা। মামলা দায়ের ও বিচার প্রক্রিয়া, রীতি রেওয়াজ ভেঙে উচ্চ আদালতে জামিন আটকে দেয়া এবং কারাগারে অসম্মানমূলক আচরণের বিষয়গুলো উল্লেখ করে বিএনপি নেতারা কূটনীতিকদের কাছে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন খালেদা জিয়া সরকারের রাজনৈতিক নির্মম প্রতিহিংসার শিকার। নিম্ন আদালত থেকে রায়ের নথি সরবরাহে বিলম্বের বিষয়টি উল্লেখ করে বিএনপি নেতারা সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, তাদের ধারণা- ‘এ বিলম্ব প্রমাণ করে তখনও রায় লেখা হচ্ছিল বা পরিবর্তন করা হচ্ছিল।’
দলটির নেতারা কূটনীতিকদের জানিয়েছেন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সাজা ও তার কারাবাস দীর্ঘায়িত করার মাধ্যমে বিএনপি নেতাকর্মীদের নৈরাজ্যের পথে পরিচালিত করতে উস্কানি দিচ্ছে সরকার। কিন্তু খালেদা জিয়াকে মুক্ত ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সর্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য গণতান্ত্রিক ও অহিংস কৌশল অবলম্বন করে প্রতিবাদ করছে বিএনপি। আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে কূটনীতিকদের প্রশ্নের উত্তরে দলের ইতিবাচক মানসিকতার কথা তুলে ধরেছেন নেতারা। সেই সঙ্গে সরকারের বিরোধী মত অসহিষ্ণুতা ও নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতমূলক আচরণের বিষয়গুলো উল্লেখ করে কূটনীতিকদের জানানো হয় সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে প্রয়োজনীয় সহায়ক পরিবেশ অনুপস্থিত। বিএনপিকে মানববন্ধনের মতো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনেও বাধা দেয়া হচ্ছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারামুক্তি ও সংলাপের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে তারা বলেন, বিএনপি উদার গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আইনের শাসন ও দ্বিপক্ষীয় বোঝাপড়ায় ও গঠনমূলক আলোচনায় বিশ্বাসী। গণতান্ত্রিক ধারায় বিশ্বাস করে এবং অনুধাবন করে একমাত্র গণতান্ত্রিক পথেই শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতার রদবদল হতে পারে। বিএনপি বিশ্বাস করে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য এবং সকলের অংশগ্রহণের পরিবেশ দরকার। আর এর সমাধানের জন্য একমাত্র পথ হচ্ছে সংলাপ। যা ক্ষমতাসীন দলের উদ্যোগে সম্ভব। সুষ্ঠু নির্বাচন আর গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে খালেদা জিয়াকে অবশ্যই মুক্তি দিতে হবে। বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার, আইনি হয়রানি ও নির্যাতনের পথ থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন