দলের বিতর্কিত, দুর্নীতিবাজ, কোন্দলের মদদদাতা এমপি ও হাইব্রিড 'কাউয়া' নেতাদের তালিকা করছে আওয়ামী লীগ। আগামীতে তাদের কোনো নির্বাচনে মনোনয়ন না দেয়ার বিষয়ে শক্ত অবস্থানে দলটি। এই পরিস্থিতিতে মনোনয়নপ্রত্যাশী এসব এমপি ও নেতাদের দৌড়ঝাঁপ বেড়েছে। তারা দলের নীতি-নির্ধারকদের ম্যানেজ করে এই তালিকা থেকে নিজেদের নাম কাটানোর চেষ্টা করছেন।
সূত্র জানায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় মনোনয়ন ঠিক রাখতে এমপিরা এবং নতুন মনোনয়নপ্রত্যাশীরা দলের নীতি-নির্ধারকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। প্রায়ই কেন্দ্রীয় নেতাদের ব্যক্তিগত অফিসে তাদের দেখা মিলছে। এরমধ্যে যেসব এমপির নাম গণমাধ্যমে বিতর্কিত, কোন্দলবাজ, বিশেষ লীগের মদদদাতা হিসেবে আলোচিত হয়েছেন, তাদের তদবির লবিংয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে।
এ অবস্থায় প্রতিপক্ষের নেতারা তাদের নানা অপকর্ম কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। বিগত সময় কেন্দ্র থেকে এ সব এমপিকে ডেকে বৈঠক করলেও সেখানে তারা স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্বিত-ায় জড়িয়ে পড়েছেন। এমতাবস্থায় নিজের অবস্থান ঠিক রাখতে দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের দ্বারস্থ হচ্ছেন তারা।
নানাভাবে আলোচিত-সমালোচিত, বিতর্কিত এ রকম প্রায় ৫০ জন এমপিকে কেন্দ্রীয় নেতাদের বাসা ও অফিসে দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় নেতাদের ম্যানেজ করার পাশাপাশি তারা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করাসহ প্রতিপক্ষের অধঃস্ত্মন নেতাদের কাছে টানতে নানা প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।
সূত্র আরও জানায়, গত ৩১ মার্চ গণভবনে দলের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে বিতর্কিত, স্থানীয় সংগঠনে কোন্দল সৃষ্টিকারী, দলীয় সিদ্ধান্ত্মের বিপক্ষে অবস্থান নেয়া এমপি ও নেতাদের তালিকা করতে দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দেন। এরপর থেকে এদের দৌড়ঝাঁপ বেড়ে যায়।
ইতোমধ্যে দ্বন্দ্ব-কোন্দল অনুসন্ধানে আওয়ামী লীগের পাঁচ সদস্যের কমিটি কাজ শুরম্ন করেছে। কমিটির প্রধান ও দলের সভাপতিম-লীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ। অন্য সদস্যরা হলেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক
মাহাবুবউল আলম হানিফ, ডা. দীপু মনি, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আবদুর রহমান।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, কোন্দলপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত চট্টগ্রাম মহানগর, চট্টগ্রাম দক্ষিণ ও উত্তর, নোয়াখালীর হাতিয়া, যশোর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কুমিলস্না উত্তর, দক্ষিণ ও মহানগর, বরিশাল মহানগর, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর, ফরিদপুর, শরীয়তপুর, খুলনা, রাজশাহী, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, নাটোর, নওগাঁ, ভোলা, পিরোজপুর, মৌলভীবাজার, মাদারীপুর ও সুনামগঞ্জ অন্যতম।
এর মধ্যে অন্ত্মর্কোন্দল, সহিংসতা ও খুনোখুনিতে এগিয়ে যশোরের শার্শা, নোয়াখালীর হাতিয়া, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ, সিলেট ও চট্টগ্রাম।
শার্শায় দলীয় কোন্দলে গত ১০ বছরে নিহত হয়েছেন প্রায় ৪৫ জন নেতাকর্মী। হাতিয়ায় নিহত হয়েছেন গত দুই বছরে ৯ জন নেতাকর্মী। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতা প্রফেসর আশরাফ উদ্দীন আহমেদের হত্যার ঘটনায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। গত বছরের ৩০ মার্চ চরকিং ইউনিয়নের আফাজিয়া বাজারে প্রতিপক্ষ প্রকাশ্যে তাকে গুলি করে। পরে ৯ এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। ৩০ আগস্ট সকালে হাতিয়ার সোনাদিয়া ইউনিয়নের পূর্ব সোনাদিয়া গ্রামের বাসিন্দা ইউনিয়ন যুবলীগ নেতা ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান হাজি নুরম্নল ইসলামের ব্যক্তিগত সহকারী রিয়াজ উদ্দীনকে প্রকাশ্যে পায়ের রগ কেটে ও গুলি করে হত্যা করে তার প্রতিপক্ষ। এ ছাড়া মামলার কারণে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা ঘরছাড়া। এমপির পক্ষ-বিপক্ষ সব নেতাকর্মীই মামলার আসামি। এ ছাড়া প্রকাশ্যে বিএনপির কাডাররা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর হামলা করে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে সিলেট, চট্টগ্রাম ও কুমিলস্নায়ও নিহতের সংখ্যা কম নয়। এ ছাড়া কিছু কিছু এলাকায় এমপির কারণে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ঘরছাড়া। এর মধ্যে এগিয়ে শার্শা, হাতিয়া ও রূপগঞ্জ। এর পরের অবস্থান নাটোরের গুরম্নদাশপুর। এ ছাড়া অসংখ্য এলাকা রয়েছে যেখানে এমপি ও মনোনয়নপ্রত্যাশীরা মারমুখী অবস্থানে রয়েছে। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে যেকোনো সময় বড় ধরনের সহিংসতা হতে পারে। আবার এমন কিছু এলাকা রয়েছে, যেখানে এমপির ভয়ে কেউ কিছু বলতেই পারে না।
এ অবস্থায় বিভিন্ন স্ত্মরের নেতাকর্মীদের অভ্যন্ত্মরীণ কোন্দল নিরসনে রীতিমতো নাভিশ্বাস উঠেছে তৃণমূল সফরে থাকা আওয়ামী লীগের ১৫ টিমের প্রতিনিধিদের। বিশেষ করে মন্ত্রী-এমপি অথবা কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে তৃণমূলের দ্বন্দ্ব মেটাতে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাদের। কিছু এলাকায় নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা সফররত টিমের ওপর নানাভাবে প্রভাব খাটাচ্ছেন ও তাদের ম্যানেজ করার চেষ্টা করছেন। এমন পরিস্থিতিতে অনেক জেলায় নেতাকর্মীদের দূরত্ব না কমিয়ে শুধু কর্মী সম্মেলন করেই ফিরতে হয়েছে তাদের।
সাংগঠনিক সফরে দলীয় কোন্দল নিরসন ছাড়াও আগামী নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থী বাছাই, প্রতিপক্ষের প্রার্থীর ব্যাপারে বিস্ত্মারিত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহসহ ১২টি এজেন্ডা নিয়ে কাজ করছে টিমগুলো। কিন্তু কোনো কোনো স্থানে কোন্দলের কারণে এসব কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারছে না টিমগুলো।
এরকম পরিস্থিতিতে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা বিতর্কিতদের তালিকা করার নির্দেশ দেয়ায় বেশামাল হয়ে পড়েন বিতর্কিত এমপিরা। ঢাকায় এসে কেন্দ্রীয় নেতাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন তারা। যেখাবেই হোক কেন্দ্রীয় নেতাদের ম্যানেজ করতে চাচ্ছেন।
তবে এমপিদের প্রতিপক্ষরাও থেমে নেই। তারাও কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত দিয়ে এমপিদের কু-কর্ম তুলে ধরছেন। এসব বিষয়ে কথা হলে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ, নোয়াখালীর হাতিয়া, নাটোরের গুরম্নদাশপুর, যশোরের আওয়ামী লীগ নেতারা যায়যায়দিনকে বলেন, নিজ দলের যেসব এমপির হাতে নেতাকর্মীদের রক্ত ঝরেছে, ঘরছাড়া হতে হয়েছে, তাদের কোনো ছাড় নয়। কেন্দ্রীয় সংগঠন তাদের তলব করলে এমপিদের সব কু-কর্মের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে তারা বৈঠকে উপস্থিত হবেন।
কোন্দল নিরসনের বিষয়ে গঠিত কমিটির প্রধান ও দলের সভাপতিম-লীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ বলেন, '৭ এপ্রিল থেকে সারাদেশের দলীয় কোন্দলের কারণ অনুসন্ধান করতে কাজ করছে কমিটি। প্রথম দিনে আট বিভাগের দায়িত্বে থাকা দলের সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সারাদেশের সবচেয়ে বেশি কোন্দলপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে ওইসব এলাকার নেতাদের ঢাকায় তলব করা হয়েছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে কোন্দল মীমাংসার চেষ্টার পাশাপাশি তাদের থেকে তথ্য সংগ্রহ করছে কমিটি। ওইসব তথ্য পর্যালোচনা করে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে কমিটি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে রিপোর্ট জমা দেবে।
কমিটির অন্য সদস্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবউল আলম হানিফ বলেন, 'দ্বন্দ্ব-কোন্দল অনুসন্ধানে আমরা কাজ শুরম্ন করেছি। আশা করছি, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন তৈরি করে দলীয়প্রধান শেখ হাসিনার কাছে জমা দিতে পারব।'
দলের সভাপতিম-লীর সদস্য পীযূষ কান্ত্মি ভট্টাচার্য যায়যায়দিনকে বলেন, সব সমস্যার সমাধান করেই আগামী নির্বাচনে গ্রহণযোগ্য প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়া হবে। নির্বাচনের সময় কোনো বিশৃঙ্খলা হবে না। দলের প্রার্থীর জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন