বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রামে ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ। ষাটের দশকে গড়ে ওঠা বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিসংগ্রামে গৌরবজনক ভূমিকা রয়েছে সংগঠনটির নেতাকর্মীদের। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও রাজপথে লড়াকু ছিলেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। কিন্তু দিন যত গড়িয়েছে ততই ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে নানা অপকর্মের অভিযোগ উঠেছে। নানা সময়ে সংগঠনটির নেতৃত্ব এসব অপকর্মের পেছনে সংগঠনে অনুপ্রবেশকারীদের দায়ী করেছেন।
কর্মী ও সাবেক নেতারাও এ ধরনের অভিযোগ বারবার করেছেন। তাদের সবারই অভিযোগ, ছাত্রলীগকে কলঙ্কিত করার জন্য পরিকল্পিতভাবে জামায়াত-শিবির তাদের মতাদর্শের নেতাকর্মীদের সংগঠনে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব পর্যায়ে অনেকেও শিবিরদের পৃষ্ঠপোষকতাও করছেন। আবার অনেকে নিজ দলের প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে তাকে শিবির বলে দোষারোপও করেছেন। সাবেক নেতা থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের কর্মী সবার মাঝেই বিভিন্ন সময়ে ‘শিবির ফোবিয়া’ কাজ করেছে।
সামনে ১১-১২ মে ছাত্রলীগের সম্মেলন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এরইমধ্যে বলেছেন, ছাত্রলীগকে নতুন মডেলে গড়ে তোলা হবে। তবে পুরানো ধারা থেকে ছাত্রলীগকে কতটা বের করা সম্ভব সে প্রশ্ন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। তারা মনে করছেন সংগঠনে নেতৃত্বের বিকাশে আদর্শ চর্চার বদলে শুধুমাত্র কার দখলে কতজন কর্মী আছেন, এ ভিত্তিতে নেতা নির্বাচনের জন্য এ সমস্যা কাটানো সম্ভব নয়। এ অবস্থায় আগামী ১১-১২ মে সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব আসবে ছাত্রলীগে। নির্বাচনের বছরে এ সম্মেলনকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করছে আওয়ামী লীগও। প্রতিপক্ষকে ঠেকানোর জন্য যেমন শক্তিশালী সংগঠন প্রয়োজন, ঠিক আবার সংগঠনে যদি ভিন্ন মতাদর্শের বিশেষ করে স্বাধীনতাবিরোধী শিবিরের অনুপ্রবেশকারীরা ঢুকে নানা ধরনের নাশকতা শুরু করে তবে দুর্নামের ভাগিদার হতে হবে আওয়ামী লীগকে। তাদের শঙ্কা ভোটের বছরে জনমনে এর তীব্র প্রভাবও পড়বে। সেক্ষেত্রে শিবিরমুক্ত সংগঠন আগামী সম্মেলনে ছাত্রলীগের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
‘ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ইহুদিরা যেমনিভাবে আরব জাতির সঙ্গে মিশে গিয়েছিল, ঠিক তেমনিভাবে ছাত্রলীগকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে ইসলামী ছাত্রশিবির ছাত্রলীগের সঙ্গে মিশে গিয়েছে...।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মেহেদী হাসান এভাবেই ফেসবুকের টাইমলাইনে ছাত্রলীগে শিবিরের অনুপ্রবেশ নিয়ে তার মতামত ব্যক্ত করেন।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিবিরের কার্যক্রম অপ্রকাশ্য হয়ে যায়। মূলত তখন থেকেই তারা ছাত্রলীগে ভিড়ে যেতে শুরু করে। আগামী ১১ ও ১২ মে অনুষ্ঠিতব্য সম্মেলনকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগে শিবির অনুপ্রবেশের আশঙ্কা আরও বেড়ে গেছে। কেননা বিদায়ী কমিটিতে অনেকবার শিবিরের অনুপ্রবেশের বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে।
রাজনীতিতে অবস্থান নাজুক হওয়ায় শিবিরের নেতাকর্মীরা ছাত্রলীগে আশ্রয় নিচ্ছেন বলে বারবার অভিযোগ উঠেছে খোদ ছাত্রলীগের ভেতরেই। আর দল ভারী করতে অনেক ছাত্রলীগ নেতা অনুপ্রবেশকারীদের প্রশ্রয় দিয়েছেন ও এখনো দিয়ে যাচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। তবে ছাত্রলীগে কোনো অনুপ্রবেশকারী নেই বলে দাবি করেছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কয়েকজন শীর্ষ নেতা।
ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে সংগঠনের শাখাগুলোর বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যেই সমালোচনা করেন। অনেকেই সংগঠনে আস্থার সংকট দেখা দেওয়ার কথাও বলেন। এভাবে চললে ‘হাইব্রিড ছাত্রলীগের’ ভিড়ে ‘প্রকৃত ছাত্রলীগ’ খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে বলেও মন্তব্য তাদের। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল হওয়ায় শীর্ষ নেতৃত্বের বিরাগভাজন হওয়ার আশঙ্কায় গণমাধ্যমে সরাসরি বক্তব্য দিতে রাজি হননি ছাত্রলীগের কোনো নেতাকর্মী। তবে সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহে এসব অভিযোগ আরও জোরদার হচ্ছে।
এসব বিষয়ে কথা বলতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি খোলা কাগজকে বলেন, ‘ছাত্রলীগে আগে অনুপ্রবেশকারী ছিল কি না জানি না, তবে এখন কোনো অনুপ্রবেশকারী নেই।’ তৃণমূলের কয়েকজন নেতা খোলা কাগজকে জানিয়েছেন, স্থানীয় এমপি, স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, এমনকি ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপের আশ্রয়ে সংগঠনে অনুপ্রবেশকারীরা প্রভাবশালী হয়েছেন।
ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের অভিযোগ, নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষা চালিয়ে যেতে শিবিরের অনেক নেতাকর্মীই ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। আর ছাত্রলীগে বিভিন্ন গ্রুপ-উপগ্রুপ থাকায় দল ভারী করতে অনেক নেতাই তাদের সুযোগ দিচ্ছেন। ফলে ত্যাগী নেতাকর্মীরা বঞ্চিত হচ্ছেন, আবার অনেক কমিটিতেই ত্যাগী নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে অনুপ্রবেশকারীদের পদ দেওয়ার অভিযোগও নতুন নয়। তবে ভিন্ন চিত্রও রয়েছে। প্রতিপক্ষ গ্রুপকে ফাঁসাতে অনেক সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদেরও শিবিরকর্মী সাজানোর চেষ্টা চলে বলেও জানিয়েছেন কয়েকজন নেতা।
দেশব্যাপী সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা যায়, ছাত্রলীগের আগামী সম্মেলনে শীর্ষ পদপ্রত্যাশী জবি ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে শিবিরসংশ্লিষ্টতার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের কার্যালয় থেকে শিবির ক্যাডার কাউছার নিয়াজ সাইমুনকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। সাইমুন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সর্বশেষ সম্মেলনে কাউন্সিলর ছিলেন। তাকে আটকের পর চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নূরুল আজিম রনি বলেছিলেন, ‘শুধু সাইমুন নয়, সারা দেশে ছাত্রলীগে এ রকম অসংখ্য শিবিরের স্পাই রয়েছে।’ এছাড়াও চট্টগ্রাম কলেজ ও মহসিন কলেজ ছাত্রলীগের নেতারা এম কায়সার নামের এক ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে শিবিরসম্পৃক্ততার অভিযোগ এনে চট্টগ্রামে বিক্ষোভ করেন।
এক সময়ে ছাত্রশিবিরের দুর্গ বলে পরিচিত রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কমিটিতে শিবির অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সংবাদ সম্মেলন করে মনিটরিং টিম গঠন করার ঘোষণা দিয়েছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ। ওই শাখার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাশেদুল ইসলাম রাঞ্জু বলেছিলেন, শিবিরমুক্ত রাবি ছাত্রলীগ গড়তে একটি মনিটরিং টিম গঠন করা হবে। ওই কমিটি সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করবে। তাদের যৌক্তিক ও প্রমাণিত অভিযোগের ভিত্তিতে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রাবি ছাত্রলীগে শিবিরের কোনো জায়গা হবে না। কিন্তু পরবর্তীতে গঠন করা রাবির হল কমিটিগুলোতে শিবিরের একাধিক নেতাকর্মী স্থান পান বলে অভিযোগ ওঠে। একই অভিযোগ ওঠে শাবিপ্রবি ছাত্রলীগের কমিটি গঠনেও।
ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারীদের বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় এমপিরাও সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে অভিযোগ করেছেন। এর মধ্যে ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মামুনের বিরুদ্ধে শিবিরের ক্যাডার ছিলেন বলে অভিযোগ এনে স্থানীয় এমপি ডা. এম আমানউল্লাহ প্রধানমন্ত্রী ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন, যা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
এদিকে ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারীদের উৎপাত নতুন কিছু নয়। এর আগে ২০১০ সালেও দলের কার্যনির্বাহী সভায় ছাত্রলীগের কোনো কোনো কমিটিতে শিবিরকর্মী ঢুকেছে, কারা ঢুকিয়েছে তা তদন্ত করে তার তালিকা তৈরি করতে বলেছিলেন আওয়ামী লীগপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি তখন ছাত্রলীগ নেতাদের সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বলতেন, খাদ্যশস্য উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশ একটি উর্বর দেশ। কিন্তু খাদ্যশস্যের সঙ্গে সঙ্গে আগাছাও জন্মায়। তাই ভালো শস্য উৎপাদনের জন্য আগাছা তুলে ফেলতে হবে।’
বাংলাদেশে আদর্শ বলে কি কিছু আছে : অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী
ছাত্রলীগে শিবির ঢুকছে এতে আতঙ্কটা কেন! আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি তারা কেন জামায়াত-শিবিরকর্মী নিচ্ছে? আওয়ামী লীগে গেলে তো সাত খুন মাফ হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ মুক্তিযোদ্ধা তালিকার মধ্যে কি রাজাকার ঢোকায়নি? জামায়াতে ইসলামীর আদর্শ নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে সবার আদর্শ নিয়ে মাথার ঘামাতে হবে। বাংলাদেশে আদর্শ বলে কিছু কি আছে আদৌ? এটা ঠিক, জামায়াতের আদর্শ আছে- আমরা পছন্দ করি আর না করি।
আওয়ামী লীগ জামায়াতের সঙ্গে বহুবারই আঁতাত করেছে। এটা নতুন কী? এরশাদের সময়ও আঁতাত করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়েও আঁতাত করেছে। জামায়াতের কর্মীরা আওয়ামী লীগে যোগদান করছে তাতে ভয় পাচ্ছে কে- সাধারণ মানুষ? বিএনপির সঙ্গে তো বর্তমানেও জামায়াতের আঁতাত আছেই। পারলে তো তাদের কোলে নিয়ে বসায়!
আসল ভয়টা হচ্ছে- বড় দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ-বিএনপি নিয়ে। এরা ক্ষমতার জন্য যা খুশি তাই করতে পারে। তারা ক্ষমতার জন্য যেটা করার দরকার সেটাই করবে। জামায়াত ঢুকছে, আওয়ামী লীগ নিচ্ছে কেন! আওয়ামী লীগে কেউ গেলে সে মুক্তিযুদ্ধের শক্তি হয়ে যায়। এটা নতুন নয়।
ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ-বিএনপি প্রতিষ্ঠান ভেঙে দেবে, মানুষের বাক-স্বাধীনতা হরণ করবে, গণমাধ্যম স্তব্ধ করে দেবে, গুম-খুন করবে। আওয়ামী লীগের আদর্শটা কী? এ দলের আদর্শ হচ্ছে লুট। এখানে মানুষের ভয় লাগে না! জামায়াত জামায়াত বলে পুরনো বাঁশি বাজালে তো চলবে না। জামায়াত কী করেছে দেশের, স্বাধীনতার পর? যুদ্ধের সময়েই তারা যা করার করেছে। ক্ষতি তো করেছে আওয়ামী লীগ বেশি। তারপর বিএনপিও করেছে। প্রতিষ্ঠান ভেঙে দিয়েছে, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নির্বাচন ঠিকমতো করতে দেয়নি। আওয়ামী লীগের আমলে লুটের রাজত্ব চলছে। তাতে মানুষ আতঙ্কিত হয় না? যদি না হয়, তাহলে আমি বলব, মানুষের চিন্তাশক্তির অভাব আছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন