গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে আরেক দফা ঠাণ্ডাযুদ্ধ হয়ে গেলো বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে। এই নির্বাচনে খুলনা ও গাজীপুর উভয় সিটিতে বিএনপি একক প্রার্থী দেবে এবং বাকি শরীকরা তাকে সমর্থন দেবে এমনটাই ছিলো ২০ দলীয় জোটের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু সে সিদ্ধান্তে থেকেও পরে গাজীপুরে আলাদা প্রার্থী দেওয়ার জন্য অনেকটা মরিয়া হয়ে ওঠে জামায়াত। দায়িত্বশীল সূত্রের তথ্য, শেষ পর্যন্ত জোটের প্রধান শরীক দলটিকে ঠেকাতে পারলেও ‘মুচলেকা’ দিতে হয়েছে বিএনপি-কেই।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শীর্ষ নেতাদের সর্বোচ্চ শাস্তি ও আদালতের রায়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধন আটকে থাকার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনের জন্য প্রায় ‘অযোগ্য’ হয়েই রয়েছে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ।
কিন্তু তা সত্ত্বেও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জোটের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে দলীয় প্রার্থী দিয়েছিল জামায়াত। অবশেষে দীর্ঘ দেন-দরবার শেষে বিএনপির কাছ থেকে ‘মুচলেকা’ নিয়ে রোববার প্রার্থী প্রত্যাহার করেছে তারা। প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিএনপি মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার।
ঘটনার সূত্রপাত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরপরই। গত ৩১ মার্চ নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করলে ৭ এপ্রিল শরিকদের নিয়ে বৈঠক করে বিএনপি।
সূত্রমতে, ওই বৈঠকে জোটের সব শরিক বিএনপি মনোনীত প্রার্থীকে সমর্থন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। কিন্তু বৈঠকে উপস্থিত জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য মাওলানা আব্দুল হালিম সাফ জানিয়ে দেন, সমর্থনের ব্যাপারে তার বলার কিছু নেই। এ ব্যাপারে দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যেন বিএনপি আলাপ করে নেয়।
জানা গেছে, ওই বৈঠকের পরের তিন দিন একাধিকবার চেষ্টা করেও জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি বিএনপির শীর্ষ নেতারা। যে মোবাইল ফোন নম্বরগুলোতে আত্মগোপনে থাকা জামায়াত নেতাদের সঙ্গে সচারাচার যোগাযোগ হয়, সে নম্বরগুলোতে বার বার চেষ্টা করেও কাউকে পাওয়া যায়নি।
উপয়ান্তর না দেখে গত ১০ এপ্রিল গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের জন্য প্রার্থী ঘোষণা করে বিএনপি। স্থানীয় বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য হাসানউদ্দিন সরকার গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ২০ দলের মেয়র প্রার্থী মনোনীত হন।
কিন্তু জোটের এই সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে নিজেদের মতো আলাদা প্রার্থী ঘোষণা করে জামায়াত। গাজীপুর জেলা জামায়াতের আমীর অধ্যক্ষ এস এম সানাউল্লাহকে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী ঘোষণা করে দলটি।
গত ১৯ এপ্রিল আবারও ২০ দলীয় জোটের বৈঠক ডাকে বিএনপি। সেই বৈঠকে বিএনপি মনোনীত ২০ দলীয় জোটের প্রার্থী হাসানউদ্দিন সরকারের পক্ষে প্রচার-প্রচারণা চালানোর জন্য দু’টি সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়। ওই বৈঠকে জোটের সব শরিক উপস্থিত থাকলেও জামায়াতের কোনো প্রতিনিধি আসেননি।
জোটসঙ্গী জামায়াত এভাবে বেঁকে বসায় বিপাকে পড়ে বিএনপি। দফায় দফায় চলতে থাকে দেন-দরবার। স্থানীয় পর্যায় তো বটেই, ঢাকায়ও দুই দলের শীর্ষ নেতাদের কয়েক দফা বৈঠক হয়। কিন্তু জামায়াতকে কোনোভাবেই বোঝাতে পারছিল না বিএনপি। অবশেষে শর্ত সাপেক্ষে রোববার প্রার্থী প্রত্যাহারে রাজি হয় জামায়াত।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘হ্যাঁ আমরা জানতে পেরেছি গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী প্রত্যাহার করেছে জামায়াত।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, জামায়াতের দেওয়া শর্তের মধ্যে রয়েছে, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তাদের পছন্দ মতো ৬টি কাউন্সিলর পদ ছেড়ে দিতে হবে এবং সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদ জামায়াতের জন্য ছেড়ে দিতে হবে। সেখানে স্থানীয় জামায়াতের আমীর শিবিরের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট এহসান মাহবুব জুবায়েরকে তারা প্রার্থী দেবে।
জানা গেছে, দলীয় প্রতীক ও ব্যানারে নির্বাচন করার সুযোগ না থাকলেও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে আসন ভাগা-ভাগির মহড়া হিসেবে সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে বেছে নিয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত। তারই অংশ হিসেবে গাজীপুরে বিএনপির প্রার্থীর বিপরীতে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করে তারা।
আসন্ন গাজীপুর ও খুলনা সিটি করপোরেশনসহ বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট— এই ৫ সিটির অন্তত ১টিতে একক মেয়র প্রার্থী দিতে চায় জামায়াত। সে লক্ষ্যেই গাজীপুর সিটিতে স্থানীয় জামায়াতের আমীর এস এম সানাউল্লাহ এবং সিলেট সিটিতে স্থানীয় জামায়াতের আমীর, ছাত্র শিবিরের সাবেক সভাপতি এহসান মাহবুব জুবায়েরকে মেয়র প্রার্থী হিসেবে প্রস্তুত করেছে তারা।
জাতীয় নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠেয় পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অন্তত একটিতে একক মেয়র প্রার্থী দিয়ে ভোটের মাঠে নিজেদের অবস্থান যাচাই করতে চায় জামায়াত। পাশাপাশি জোটের প্রধান দল দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক মিত্র বিএনপির সঙ্গে দর কষাকষির জায়গায়টা ঠিক রাখতে চায়।
অবশ্য এ ব্যাপারে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘গাজীপুরে জামায়াতের প্রার্থী প্রত্যাহারের বিষয়টি ফায়সালা হয়েছে। সিলেটের ব্যাপারে তাদের সঙ্গে কোনো কথা হয়েছে — এমনটি আমার জানা নেই।’
তবে গাজীপুর জামায়াতের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শীর্ষ নেতা সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত নির্বাচনে পাঁচ সিটিতে বিএনপি প্রার্থীর নিরঙ্কুশ বিজয়ে জামায়াত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। জোটের অন্যতম প্রধান শরিক হিসেবে এবার এই পাঁচ সিটির অন্তত একটি আমরা চাইতেই পারি। গাজীপুর ও সিলেটে আমাদের শক্ত প্রার্থী রয়েছে। গাজীপুর ছেড়ে দিলাম। সিলেট আমাদেরকে ছেড়ে দিতে হবে।’
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ২০ দলীয় জোটের সমন্বয় কমিটির সদস্য সচিব লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘পাঁচ সিটির মধ্যে একটি জামায়াত চায় বলে আমরা শুনেছি। আপাতত গাজীপুর ফায়সালা হয়েছে। অন্যগুলোর ব্যাপারে জোটের ফোরামে আলোচনা করে সময় মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
তবে বিএনপি’র একাধিক শীর্ষনেতা সারাবাংলাকে বলেছেন, তারা জামায়াতের এই আচরণকে ‘বেঈমানি’ হিসেবে দেখছেন। জোটের বৈঠকে সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে তাদের একক প্রার্থী দেওয়ার প্রয়াস জোটের ক্ষতি ডেকে আনবে বলেন মনে করেন তারা।
সারাবাংলা
পাঠক মন্তব্য
Biased reporting. Jamaat is now a popular political party. It has the right to give its own candidates. If BNP behaves like this I think it will be better for Jamaat to leave the jote.
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন