প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তরাজ্য সফরে তার অনুষ্ঠানস্থলের আশেপাশে বিএনপির প্রতিবাদ কর্মসূচিতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে হিন্দু ধর্মকে জড়িয়ে আপত্তিকর স্লোগান দিয়ে সামাজিক মাধ্যমে তোলপাড় চলছে বেশ কিছুদিন ধরেই। সাম্প্রতিক ইতিহাসে বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলের দেশের বা বিদেশের শাখার পক্ষ থেকে এই ধরনের বক্তব্য নজিরবিহীন।
এ বিষয়ে ভিডিও চিত্র থাকলেও বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য দেয়া হয়নি। যদিও দলের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা ঢাকাটাইমসকে বলেছেন, এসব স্লোগান তাদের নেতা-কর্মীরা দিতে পারেন না, তাদের ওপর দায় দেয়া হচ্ছে।
কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগ দিতে ১৬ থেকে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে অবস্থান করেন প্রধানমন্ত্রী। আর তার এই সফরকে ঘিরে প্রতিবাদমুখর ছিল বিএনপি। বেশ কিছু কর্মসূচির ছবি এবং ভিডিও ছড়িয়েছে ফেসবুকে।
এর মধ্যে একটি ভিডিওতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে হিন্দু দেবতার নাম জড়িয়ে স্লোগান দিতে দেখা যায় যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এম এ মালেকের নেতৃত্বে সেখানকার নেতাকর্মীদেরকে।
খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার দাবির ব্যানার নিয়ে দাঁড়ানো ওই সমাবেশে উগ্র সাম্প্রদায়িক স্লোগান দেয়ার পর যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি মালেক সেখানে একজন গণমাধ্যমকর্মীকে সাক্ষাৎকারও দেন। সেই ছবিও আছে গণমাধ্যমে।
ভিডিওটিতে দেখা যায় বিএনপির নেতা কর্মীরা তুমুল উৎসাহের সঙ্গে স্লোগান দিচ্ছে ‘হরে কৃষ্ণ, হরে রাম! শেখ হাসিনার বাপের নাম...!!!’।
এই ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানোর পর পর তীব্র সমালোচনা উঠেছে। কবির চৌধুরী তন্ময় নামে আরও একজন ভিডিওটি শেয়ার দিয়ে লিখেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরকালে লন্ডন বিএনপির সমাবেশের ছোট্ট এই ভিডিওটিতে অনেক বড় বার্তা পাবেন। ভিডিওটি ফেসবুকে তুলে ধরার ইচ্ছে না থাকা সত্বেও ইনবক্সে ভাই-বোন, বন্ধুদের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত আপনাদের কাছে প্রশ্ন, বিএনপির চেয়ে আর কতবড় মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক দল বাংলাদেশে আছে...?’
অঞ্জয় দেব চৌধুরী নামে আরও একজন ভিডিওটি শেয়ার দিয়ে লিখেছেন, ‘তলে তলে সাম্প্রদায়িকতা পোষা বিএনপি প্রকাশ্যে এতো নির্লজ্জভাবে তার সাম্প্রদায়িকরূপের প্রকাশ ঘটিয়েছে যে এরা বাংলাদেশের একটা বড় রাজনৈতিক দল ভাবতেও ঘেন্না হচ্ছে।’
পাকিস্তান আমলে রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার ছিল এক স্বাভাবিক ঘটনা। তবে সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে এই ধরনের সাম্প্রদায়িক স্লোগান দেখা যায়নি।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের স্লোগানের ব্যবহার সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদের সরাসরি লংঘন। আর ঘটনাটি দেশের বাইরে হলেও যেহেতু ওই দেশের বিএনপি এই কাজ করেছে, তার দায় দলের কেন্দ্রকেই নিতে হবে।
সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ১. সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, ২. রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দান, ৩. রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার এবং ৪. বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তার উপর নিপীড়ন – বিলোপ করা হবে।
অর্থাৎ সংবিধানের এই অনুচ্ছেদের এক এবং তিন উপ অনুচ্ছেদের লংঘন হয়েছে। এ বিষয়ে বিএনপির কাছে ব্যাখ্যা দাবি করা উচিত বলে মনে করেন চাইলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কৌঁসুলি তুরিন আফরোজ।
এই আইনজীবী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘লন্ডনে যে সাম্প্রদায়িক স্লোগান দেয়া হয়েছে, আমাদের সংবিধান অনুযায়ী এই দল থাকতে পারে না। যারা সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কানি দেয় তাদের এ দেশে রাজনীতি করার অধিকার দেয়নি আমাদের সংবিধানে।’
‘বিএনপি আন্ডারগ্রাউন্ড সন্ত্রাসী দলের মতো করছে। যারা এই ধরনের কর্মকাণ্ড করেছে, বিএনপি বলছে তারা আমাদের নয়। তাহলে আপনারা প্রতিবাদ করছেন না কেন? প্রতিবাদ না করে এটাকে প্রচ্ছন্ন সমর্থন করছে।’
তুরিন আফরোজ বলেন, ‘আসলে এরা বিদেশের মাটিতে বিএনপির ক্ষতি করছে। এটা একটা বাজে প্র্যাকটিস, এতে বিএনপিরই ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।’
এই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় যুক্তরাজ্য সরকারেরও সমালোচনা করেন তুরিন আফরোজ। বলেন, ‘গণতন্ত্রের পূণ্যভুমিতে (যুক্তরাজ্য) বারবার এ ধরনের কর্মকাণ্ড দেখছি। সেখানে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার চর্চা হয়েছে, আমাদের মিশনে আক্রমণ করা হচ্ছে, এতে ভিয়েনা কনভেনশনের লঙ্ঘন হচ্ছে। তারা এই ধরনের কর্মকাণ্ডকে আশ্রয় প্রচ্ছয় দিচ্ছে। এমনকি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকেও তারা আশ্রয় দিচ্ছে।’
বেসরকারি সংগঠন সুশানের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এটা যদি হয়ে থাকে তবে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এই রকমটা আমাদের কারও কাম্য নয়। বাংলাদেশ একটা অসাম্প্রদায়িক দেশ। এখানে ধর্ম নিরপেক্ষতা আমাদের সংবিধানের অঙ্গীকার। সেখানে বিএনপির মতো দলের কাছ থেকে এ ধরনের স্লোগান কাম্য নয়।’
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু দাবি করেন, বিএনপির নেতা-কর্মীরা এই কাজ করতেই পারে না। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘সামনে নির্বাচন। এ কারণে বর্তমান সরকার বিএনপিকে একটি সাম্প্রদায়িক দল হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করছে। আর তাদের অনুগত কিছু মিডিয়া কর্মীরা আছেন, তারা এটাকে সামনে আনছেন। কিন্তু বিএনপির একটি নির্ভেজাল অসাম্প্রদায়িক দল।’
বিএনপি এই কাজ না করলে কে করেছে-এমন প্রশ্নে দুদু বলেন, ‘এ দলটি পাঁচ ছয় বার এ দেশ পরিচালনা করেছে গণমানুষের ভোটে। বিএনপিকে আগামী নির্বাচনের বাইরে রাখার পরিকল্পনা করেছে এ সরকার। যারা গায়ের জোরে ক্ষমতায় থাকতে চায়, তারাই এ ধরনের ঘটনার অবতারণা করতে পারে।’
দুদু বলেন, ‘বিএনপি নির্বাচনের আগে তসবিহ হাতে বিভিন্ন জায়গায় ছবি লাগায় না। ছবি যারা দেয় তারাই বিএনপিকে সাম্প্রদায়িক দল বলে প্রচার করতে চায়।’
‘লন্ডনে যেটা হয়েছে, সেটা নিয়ে বলতে চাই, তারেক রহমান সাহেব যেমন ওখানে থাকেন, ঠিক তেমনি তার ছোট বোন শেখ রেহানাও সেখানে থাকেন। তাহলে শুধু বিএনপিকে দায়ী করছেন কেন? অন্য কেউ তো সেখানে থাকে, তারাও তো করতে পারে। শুধু অনুমানের ভিত্তিতে এজনকে দায়ী করা যাবে না।’
ঢাকাটাইমস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন