চট্টগ্রামে থামছে না ছাত্রলীগ আর যুবলীগের দৌরাত্ম্য। একের পর এক ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের পাশাপাশি অতিষ্ট করে তুলছে নগরবাসীর স্বাভাবিক জীবন। নগরী এবং জেলাতে ব্যক্তি স্বার্থে ব্যবহার হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের এ দুটি সংগঠন। সরকারের ক্ষমতার শেষের দিকে এসে দিন দিন অনেকটাই নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে পড়ছে ছাত্রলীগ-যুবলীগ। দলীয় স্বার্থ বাদ দিয়ে শুধু নিজেদের আখের গোছাতে সংগঠন দুটির নেতারা জড়িয়ে পড়ছেন নানা সংঘাত-সংঘর্ষে। ভাড়াটে হিসেবে ব্যবহার করে দখল নিচ্ছেন বিভিন্ন জনের জায়গা-জমি। গত ৫ বছরে চট্টগ্রামে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের আধিপত্য বিস্তার ও স্বার্থের বলি হয়েছে ২ শিশুসহ অন্তত ১০ জন।
সর্বশেষ গত রবিবার (২২ এপ্রিল) চট্টগ্রামের রহমত গঞ্জে একটি জায়গা দখল নিতে যুবলীগ কর্মীদেরকে দেখা গেছে সশস্ত্র অবস্থায়। সেখানে তাদের আক্রোশের শিকার হয়েছেন গণমাধ্যমকর্মীরাও। ক্যামেরা ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে এক ফটো সাংবাদিকের।
কথিত মালিকানা দাবিদার একটি সিন্ডিকেটের পক্ষে জায়গার দখল নিতে তাদের হামলার শিকার হয়েছে ১০টি পরিবার। এসময় অস্ত্রধারীরা নিজেদেরকে যুবলীগ কর্মী বলেও পরিচয় দেয়। এসময় তারা সেখানে ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে আতঙ্ক সৃষ্টি করে।
দখলে নেতৃত্বে এক যুবলীগ নেতা ব্রেকিংনিউজকে বলেন, ‘আমরা সবাইকে ম্যানেজ করে এখানে এসেছি। এছাড়া গত বছর নগরীর চন্দনপুরা ওয়াকফ স্টেটের এবং ফিরিঙ্গী বাজারে জলিল স্টেটের জায়গা দখল নিতে কাজ করে যুবলীগ। এসময় তারা সেখানে বেশ ভাংচুর করে এবং মহিলাদেরকে মারধরও করে।’
এ সময় স্থানীয় সংবাদকর্মীদের ম্যানেজ করার দায়িত্ব নেন বিকাশ নামের এক ছাত্রলীগ নেতা। বিরোধীয় জায়গাটির অংশিদার দাবিকারী মৃদুল কান্তি দাশ নামের এ ব্যক্তি একাধিক গণমাধ্যমকে কর্মীকে বলেন আপনারা নিউজটি করবেন না। বিকাশ আপনাদের সাথে দেখা করবে।
এছাড়া বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে টেন্ডারবাজি, পরিবহন সেক্টর নিয়ন্ত্রণ, মাদক-জুয়ার আসর ও বসিন্ত নিয়ন্ত্রণ, ফুটপাতের হকার নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হল দখল এবং এলাকায় চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যে ঘটছে একের পর এক সংঘর্ষের ঘটনা।
চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ফরিদ মাহমুদ ব্রেকিংনিউজকে বলেন, ‘যুবলীগের নাম বিক্রি করে যারা দখলবাজি ও টেন্ডারবাজিতে লিপ্ত তারা যুবলীগের কেউ নন। চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগ বর্তমানে ক্লিন ইমেজে কাজ করছে। কেউ যদি যুবলীগের নাম ব্যবহার কওে কোন ধরনের অপকর্ম কওে তাদেও ব্যাপাওে তদন্ত করে প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে। এছাড়া রহমত গঞ্জের জায়গা দখলের সাথে কোন যুবলীগ নেতা জড়িত নন।’
এদিকে সম্প্রতি এক কোচিং সেন্টারের মালিক এবং চট্টগ্রাম বিজ্ঞান কলেজের অধ্যক্ষকে মারধরের ঘটনায় দল থেকে বহিষ্কার হয়েছেন নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি। এ দুটি পৃথক ঘটনায় তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছে।
প্রথম দিকে নগরীতে ছাত্রদের বিভিন্ন অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে সকলের প্রশংসা কুড়ালেও পরবর্তীতে বেশ কয়েকটি বিতর্কিত ঘটনায় সমালোচনার মুখে পড়েন নগর ছাত্রলীগের এ নেতা। এ নিয়ে নগর ছাত্রলীগও বেশ সমালোচিত হয়েছে।
চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু বলেন, ‘লেখাপড়া করে না এমন লোকজনও নিজেকে স্বঘোষিত ছাত্রলীগ দাবি করে নানা অপকর্ম চালাচ্ছে। এমনকি এর আগে নগরীর সিআরবি কলোনিতে সংঘটিত সংঘর্ষে নেতৃত্বদানকারী লিমন ছাত্রলীগের কেউ নন বলেও তিনি দাবি করেন। এ কারণে তার দ্বারা সংঘটিত অপকর্মের দায়ভার ছাত্রলীগ বহন করবে না।’
গত বছর নগরীর আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনিতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ২৭ নম্বর দক্ষিণ আগ্রাবাদ ওয়ার্ডের চসিক কাউন্সিলর এইচএম সোহেল এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ থেকে আড়াই বছর আগে বহিষ্কৃত সাইফুল ইসলাম লিমনের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্রে ঘটনা ঘটে। সশস্ত্র দুই ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্মীর ছবি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। অস্ত্র হাতে থাকা ওই দু’জনের একজন ছিল ডবলমুরিং থানাধীন উত্তর আগ্রাবাদের বাসিন্দা ফয়সল আহমেদ রাজ। সে লিমনের অনুসারী। অপরজন ছিল সুমন ওরফে দাঁতলা সুমন। দক্ষিণ আগ্রাবাদের সিজিএস কলোনির বাসিন্দা সুমন কাউন্সিলর সোহেলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
এর আগে একই বছর ১৭ ও ১৮ অক্টোবর নগরীর কোতোয়ালি থানাধীন আন্দরকিল্লা মোড়ে বহিষ্কৃত ছাত্রলীগ নেতা সাইফুল ইসলাম লিমন ও নগর যুবলীগ নেতা জাবেদুল আলম সুমন গ্রুপের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে আন্দরকিল্লা ও টেরিবাজার এলাকায় যানবাহন এবং দোকানপাট ভাংচুর ও লুটের ঘটনা ঘটে।
চট্টগ্রাম কলেজ ও মহসীন কলেজে শিবিরমুক্ত করে আধিপত্যের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে কলেজ ছাত্রলীগ। এদিকে গত বছরের আগস্ট থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯৫ কোটি টাকার দুই টেন্ডার নিয়ে ক্যাম্পাসে বিবাদমান গ্রুপগুলোর মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হল ও কলা অনুষদ ভবনের সম্প্রসারণের এ দুই টেন্ডার পছন্দের ঠিকাদারকে পাইয়ে দিতে এ সমস্যা সৃষ্টি হয়। জমা দেয়া টেন্ডার পর্যালোচনা করে ২০ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০৫তম সিন্ডিকেট সভায় দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ শুরুর অনুমোদন দেয়া হয়। এতে সাবেক দুই ছাত্রলীগ নেতার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ দুটি পেয়েছে। টেন্ডার বিরোধ নিয়ে সর্বশেষ চবিতে সতীর্থদের হাতে খুন হন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ ইরফান। চট্টগ্রাম রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল সদর দফতরে টেন্ডার বাগিয়ে নেয়াকে কেন্দ্র করে বারবার ঘটছে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের বিবদমান গ্রুপগুলোর মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষ।
২০১৩ সালের ২৪ জানুয়ারি সিআরবি এলাকায় যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর ও সাইফুল ইসলাম লিমনের অনুসারীদের প্রকাশ্যে সংঘর্ষে নিহত হয় সাত বছরের শিশু আরমান এবং সাজু পালিত নামে এক ছাত্রলীগ কর্মী। এর পর বাবরকে যুবলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
গত ৫ বছরে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাসের বলি ৯ জন : চট্টগ্রামে গত ৫ বছরে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাসের বলি হয়েছে দুই শিশুসহ ৯ জন। এর মধ্যে ২০১৬ সালের ২৮ মার্চ চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে কুপিয়ে খুন করা হয় মহানগর ছাত্রলীগ কর্মী ও এমবিএ’র ছাত্র নাসিম আহমেদ সোহেলকে। ২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত হয় ছাত্রলীগ কর্মী তাপস সরকার।
২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেইট এলাকার নিজ বাসায় খুন হন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ সম্পাদক দিয়াজ ইরফান।
২০১২ সালের ১২ জানুয়ারি শাহ আমানত হলে হামলা করে ছাত্রলীগ। এতে শিবিরের শাহ আমানত হল শাখার সাধারণ সম্পাদক মামুন হায়দারকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
একই বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে সংঘর্ষে নিহত হয় শিবির নেতা মাসুদ বিন হাবিব ও মুজাহিদুল ইসলাম। ২০১৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর বায়েজিদ বোস্তামী থানাধীন শেরশাহ এলাকায় খুন হয় যুবলীগ নেতা মেহেদি হাসান বাদল। ২০১৩ সালের ২৪ জানুয়ারি সিআরবি এলাকায় যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর ও সাইফুল ইসলাম লিমনের অনুসারীদের প্রকাশ্যে সংঘর্ষে নিহত হয় সাত বছরের শিশু আরমান এবং সাজু পালিত নামে এক ছাত্রলীগ কর্মী।
২০১৫ সালের ২ জুন পাঁচলাইশ থানার মোহাম্মদপুরে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের ছোড়া গুলিতে আসাদুল মিয়া নামে ১০ বছরের এক শিশুর মাথার খুলি উড়ে যায়। এলাকার একটি দোকানে চাঁদা দাবি করে স্থানীয় ছাত্রলীগ কর্মী বাবু ও সায়েম। তবে চলমান এই দুঃসহ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ চায় নগরবাসী ও ভুক্তভোগীরা।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন