খুলনা ও গাজীপুরসহ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনগুলোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের বড় শহরগুলোর এই নির্বাচনকে নিজেদের জন্য ‘কেস স্টাডি’ হিসেবে নিয়েছে দলটি। এই নির্বাচনগুলো দেখেই জাতীয় নির্বাচনে আগে নিজেদের পক্ষে-বিপক্ষে জনমত, দলের অভ্যান্তরীণ ঐক্য ও বিরোধের চিত্র এবং মাঠ প্রশাসনের সার্বিক অবস্থা বুঝতে চায় তারা। আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণী নেতাদের মতে, সিটি নির্বাচন তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অতীতের মতো বিএনপি এবারো সিটি নির্বাচনগুলোতেও অংশ নেবে। সেখানে নৌকার প্রার্থীরা পরাজিত হলে দলের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। আবার নির্বাচন নিয়ে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি হলে তার দায়ও এড়াতে পারবেন না তারা। ফলে কোনো ধরনের বিতর্ক ছাড়াই এই নির্বাচনগুলোতে জয়ের পাশাপাশি মাঠের সার্বিক পরিস্থিতিও বুঝতে চায় তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে নিজেদের জন্য ‘কেস স্টাডি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী মানবকণ্ঠকে বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এই নির্বাচনকে আমি মনে করি আমাদের জন্য একটা কেস স্টাডি। এখানে আমাদের জনমত জরিপে যারা এগিয়েছিলেন মনোনয়ন বোর্ড তাদেরই দলীয় মনোনয়ন দিয়েছে। দলকে ঐক্যবদ্ধ করে তারা যেন বিজয়ী হতে পারে সেই লক্ষ্যে নিরসলভাবে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের টার্গেট নির্বাচন যেন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের জুন-জুলাইয়ে রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশাল ও গাজীপুর সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই নির্বাচনের সবগুলোতেই আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা পরাজিত হয়। দশম নির্বাচনের আগে যা বিরোধী পক্ষের সমালোচনায় বড় ‘সংযুক্তি’ হিসেবে কাজ করেছিল। সর্বশেষ গতবছর নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনের জয় পেলেও পরে কুমিল্লা ও রংপুর দুই সিটিতেই বিএনপি ও জাতীয় পার্টির প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন নৌকা প্রতীকের প্রার্থী। এই পরাজয়ের পর দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল আওয়ামী লীগ। এরপর সেখানকার অভ্যান্তরীণ কোন্দল নিরসনে নেয়া হয়েছিল একাধিক উদ্যোগ।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের এক সাংগঠনিক সম্পাদক মানবকণ্ঠকে বলেন, সামনে জাতীয় নির্বাচন। এর আগেই হচ্ছে সিটি নির্বাচন। এটা আমাদের জন্য একদিকে যেমন চ্যালেঞ্জ্য অন্যদিকে তেমনি একটা বড় সুযোগও। চ্যালেঞ্জ হলো- সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী হওয়া। আর সুযোগ হলোÑ এই নির্বাচন থেকে নির্বাচনী মাঠের বাস্তব চিত্র দেখে ভুল-ভ্রান্তি সংশোধন করে জাতীয় নির্বাচনের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেয়া।
এদিকে নিয়ম অনুযায়ী আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই এই পাঁচ সিটিতে নির্বাচন করতে হবে। সে হিসেবে মে মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়ে জুলাইয়ের মধ্যে দেশের বড় ৫টি শহরের এই ভোট অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে ১৫ মে ভোটের দিন নির্ধারণ করে গাজীপুর ও খুলনা সিটি নির্বাচনের তফসিলও ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। এই নির্বাচনে গাজীপুরে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম এবং খুলনায় সাবেক মেয়র তালুকদার আবদুল খালেককে দলীয় মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। তারা দু’জনই দলের একক প্রার্থী। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিকরাও এই দুই সিটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছে। দলের কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারাও ইতিমধ্যে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ শুরু করেছেন। কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে নির্বাচনী কমিটিও।
এ বিষয়ে খুলনা সিটি নির্বাচনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেকের প্রধান সমন্বয়কারী আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য এসএম কামাল হোসেন মানবকণ্ঠকে বলেন, আওয়ামী লীগ নির্বাচনমুখি দল। সব নির্বাচনই আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমরা মনে করি সুন্দর ও বাসযোগ্য শহর গড়ে তোলার লক্ষ্যে খুলনা সিটি নির্বাচনে মানুষ নৌকায় ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেককে বিজয়ী করবে। নৌকায় ভোট দিলে মানুষ ভালো থাকে, শান্তিতে থাকে। আর ধানের শীষে ভোট দেয়ার কারণে খুলনায় সাংবাদিক ও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল। আর আওয়ামী লীগে ভোট দিয়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়ন হয়েছে।
আওয়ামী লীগ নেতাদের মতে, স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলেও দলীয় প্রতীকের এই নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের ভোটের প্রচারণায় বড় ভূমিকা রাখবে। সেই সঙ্গে সিটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দলের সাংগঠনিক অবস্থা, ভোটের হিসাব, প্রশাসনসহ মাঠ কর্মকর্তাদের অবস্থান সম্পর্কে স্পস্ট ধারণা পাওয়া যাবে। এ ছাড়া যে কোনো মূল্যে এই নির্বাচনকে বিতর্ক মুক্ত রাখতে চায় আওয়ামী লীগ। কারণ জাতীয় নির্বাচনের আগের এই নির্বাচনে যে কোনো ধরনের বিতর্ক হলে তা সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। সেক্ষেত্রে বিএনপিসহ বিরোধী পক্ষ এ নিয়ে মাঠ ঘোলা করার সুযোগ খুঁজতে পারে। তাই এই নির্বাচনে সুষ্ঠু ও অবাধ ভোটের মাধ্যমে বিজয়ের বিকল্প নেই ক্ষমতাসীদের সামনে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর একাধিক সদস্য মানবকণ্ঠকে বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে এই নির্বাচন অবশ্যই আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমেই জয় চাই। সামনে আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ জাতীয় নির্বাচন। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অনেক আগে থেকে আমরা প্রস্তুতি শুরু করেছি। দলের অভ্যান্তরীণ অনেক সমস্যা চিহ্নিত করে তার সমাধানও করেছি। আরো যে সমস্যাগুলো আছে সেগুলোও সমাধানের চেষ্টা চলছে। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়েও আমরা অনেক কিছু বুঝতে পারব। অনেক সমস্যা সম্পর্কে বাস্তব ধারণা পাওয়া যাবে। মোট কথা নির্বাচনী মাঠের অবস্থা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে এই সিটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। যা জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতিতে অনেক সাহায্য করবে।
এদিকে বিগত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনগুলোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এবং ইতিমধ্যে অনুষ্ঠিত তিন সিটি নির্বাচনের ফলাফলের বিষয়টিকে মাথায় রেখেই ব্যাপক প্রস্তুতি শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। ইতিমধ্যে দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিলেট, বরিশাল, রাজশাহী ও খুলনায় জনসভায়ও করেছেন। এসব জনসভায় জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি সিটি কর্পোরেশনসহ সব স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নৌকার জন্য ভোট চেয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
এদিকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জাতীয় নির্বাচনের আগে সিটি নির্বাচনকে ‘সেমিফাইনাল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। গাজীপুর ও খুলনা সিটি নির্বাচনের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ এখন পুরোপুরি নির্বাচনের মুডে। গাজীপুর ও খুলনা এই দুই সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন মানে, ওই দুই ডিভিশনের সব ভোটাররা এর সঙ্গে জড়িয়ে যাবে। এরপর আরো ৫ সিটির নির্বাচন। সেমিফাইনাল চলছে। এখন আর আন্দোলনে কাজ হবে না।
মানবক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন