আশির দশক থেকে মূলত দেশে জোটের রাজনীতি শুরু হয়। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল জোটবদ্ধভাবে পুরো আশির দশক জুড়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলন করে। এক সময় তা সফলতা পায়। ইতিহাসের পথ ধরে ‘সফলতার আশায়’বর্তমান সময়েও চলছে জোটের রাজনীতি।
এদিকে, ‘সুযোগ সন্ধানী’নাম সর্বস্ব কিছু দল জোট হয়ে ক্ষমতার স্বাদ পেতে চায়। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে এখনই মোক্ষম সময় হিসেবে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেওয়ার চেষ্টা করছে তারা। ছোট ছোট দলগুলোর সমন্বয়ে জোট করে বৃহত্তর ‘প্লাটফর্মে’সুযোগ বুঝে ঝুঁকে পড়বে তারা। বড় দলগু্লোও তাদের নিজেদের ছায়াতলে রেখে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে চায়।
প্রধান দুই দলের নেতৃত্বাধীন জোটের এমন একাধিক দল রয়েছে যার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এক ব্যক্তি কেন্দ্রীক। কোনো কোনো দল আবার সাইন বোর্ড সর্বস্ব। নেই দলীয় কার্যালয়ও। আবার কোনো কোনো দলের সম্বল শুধু নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন মাত্র। দেশ ও জাতির কল্যাণের চেয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলই হচ্ছে তাদের টার্গেট বলে অভিযোগ রয়েছে। জোটবদ্ধ হয়ে এদের কেউ কেউ সহজেই বনে যাচ্ছেন এমপি কিংবা মন্ত্রী।
গত ৩০ মার্চ চার দলের সমন্বয়ে ‘প্রগতিশীল জোট’নামের একটি নতুন জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটে। জোটের চেয়ারম্যান ও চিফ কো-অর্ডিনেটর করা হয়েছে গণফ্রন্টের চেয়ারম্যান মো. জাকির হোসেনকে। জোটের দলগুলো হলো— গণফ্রন্ট, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল (পিডিপি) ও মুসলিম লীগ।
শুধু তাই নয়, জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে আছে ‘জাতীয় জোট’। নাম সর্বস্ব প্রায় ৫৭টি দল নিয়ে এ জোট গঠন করা হয়। গত বছর এ জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
এ ছাড়া সিপিবি-বাসদ এবং গণতান্ত্রিক বাম মোর্চাসহ কয়েকটি দল নিয়ে বাম রাজনৈতিক দলগুলোরও একটি জোট রয়েছে। বাম জোটভুক্ত দলগুলো হচ্ছে— বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা, বাংলদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী), গণসংহতি আন্দোলন, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন।
বিকল্পধারা সভাপতি অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেৃত্বত্বে চার দল নিয়েও রয়েছে একটি জোট। ‘যুক্তফ্রন্ট' নামে ওই জোট রয়েছে- বিকল্পধারা, জেএসডি, নাগরিক ঐক্য ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ।
বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১৯৯০ সালে সেনাশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ক্ষমতা হস্তান্তরের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে প্রথম রাজনৈতিক জোটে ভোটের রাজনীতি শুরু হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে আট দল। ৭ দলীয় জোট নিয়ে নির্বানের অংশ নেয় বিএনপি। ওই নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করে। কিন্ত ওই নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের জোট না থাকলেও পর্দার আড়ালে সমঝোতার অভিযোগ আছে। যে কারণে কিছু আসনে বিএনপি বা জামায়াত অল্প ভোটের ব্যবধানে আওয়ামী জোটের প্রার্থীকে পরাজিত করে। সরকার গঠনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন না থাকায় পরবর্তীতে জামায়াতের সমর্থন নিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করে।
এরপর ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি একতরফা নির্বাচনে করে। এর আগেই জামায়াত বিএনপির সঙ্গ ত্যাগ করে। ওই বছর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জামায়াতসহ সমমনা কয়েকটি দল যুগপৎ আন্দোলন করে। এক সময় গণআন্দোলনের মুখে ২৬ মার্চ ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরে ৩০ মার্চ খালেদা জিয়ার সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। জামায়াতকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন করলেও ১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ।
২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোটের ব্যানারে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় আওয়ামী লীগ। মহাজোট সরকারের অংশীদার হয় জাপা। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), সাম্যবাদী দল, ওয়ার্কার্স পার্টি, তরিকত ফেডারেশনও মহাজোট সরকারের অংশ হয়। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট রয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অংশ নিয়ে নির্বাচনকে বৈধতা দেয় জাপা। জাতীয় পার্টি বর্তমানে বিরোধী দলের দায়িত্ব পালন করছে।
এদিকে, ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি এবং ইসলামী ঐক্য জোট মিলিত হয়ে চার-দলীয় ঐক্য জোট গঠন করা হয়। কিন্তু কিছু দিন পরই জাতীয় পার্টির একটি অংশ এরশাদের নেতৃত্বে জোট থেকে বের হয়ে যায়। কিন্তু নাজিউর রহমান মঞ্জুর নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একটি অংশটি জোটে থেকে যায়। পরবর্তীতে বিএনপির নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশ নেয় চারদলীয় জোট। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে চারদলীয় জোট। মন্ত্রিসভায়ও স্থান পায় জামায়াতের দুই নেতা। চারদলীয় জোট বর্তমানে রূপ নিয়েছে ২০ দলীয় জোটে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী ড. মিজানুর রহমান শেলী পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘নতুন নতুন জোট করে রাজনীতির প্রধান দুই পক্ষ (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) থেকে সুবিধা আদায় করে নেওয়ার জন্য। একটা দল বানিয়ে জোটে যোগ দিলে নির্বাচনী বৈতরণীতে অনেক সময় আসন লাভ করা যায়। ছোট ছোট দলের সদস্যরা বড় দলের সঙ্গে মিলে তাদের প্রতীকে নির্বাচনে জয়ী হয়ে মন্ত্রীও হয়েছেন। যেহেতু এমনটা সুযোগ রয়েছে, তাই এটা অনেকেই নিতে চায়।’
তিনি বলেন, ‘যখন সংগঠিত রাজনীতি না থাকে তখন এমনটা হয়ে থাকে। ফলে হালুয়া-রুটি ভাগের রাজনীতিতে নিজেদের উন্নয়ন হতে পারে, দেশের কোনো উন্নয়ন হবে না।’
গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘আসলে রাজনৈতিক জোট বাঁধতেই পারে। তবে দলের সংখ্যা বৃদ্ধি করে কোনো লাভ হবে না। এতে রাজনীতিতে কোনো প্রভাব পড়বে না। নাম বেচা-কেনা হতে পারে, কিন্তু তাতে খুব বেশি লাভ হবে না।’
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘শুধু জোট গঠনে রাজনৈতিক গণগত পরিবর্তন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যেখানে গুণের অভাব, মানের অভাব পড়েছে; সেই জায়গাটা চিহ্নিত করে এগুতে হবে। রাজনৈতিক গুণগত পরিবর্তন হতে হলে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হবে, তার বিকল্প নেই।’
তিনি বলেন, ‘যারাই জোট করছেন তারা গণতন্ত্রের লড়াইকে সামনে নিয়ে যদি জোট করতেন তাহলে সত্যিই ওয়েলকাম জানানো হতো। এ রকম হচ্ছে বলে দেখছি না। বড় দল সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটাই বাস্তবায়ন করছে। আর ছোট দলগুলো তাদের পেছনে পেছনে হাঁটছে। এটা ঠিক, ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা মনে করতে পারেন, ‘আমি ক্ষমতা পেয়েছি, মন্ত্রী হয়েছি; রাজনীতি করা সার্থক হয়েছে’। তাতে রাজনীতির কিছু আসে যায় না।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন