শ্যোন অর্থ দেখানো, আর অ্যারেস্ট হলো গ্রেফতার। শ্যোন অ্যারেস্ট মানে গ্রেফতার দেখানো। ফৌজদারি কার্যিবিধি ও পুলিশ রেগুলেশন অ্যাক্ট অনুযায়ী, এক মামলায় কারাগারে থাকা অবস্থায় আসামিকে দুই বা ততোধিক মামলায় গ্রেফতার দেখানো। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় আপিল বিভাগ থেকে জামিন হওয়ার পরও কারামুক্ত হতে পারছেন না খালেদা জিয়া। কারণ তিনটি মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এ মামলাগুলোতে তিনি জামিন না পেলে কারামুক্ত হতে পারবেন না।
বিএনপির চেয়ারপারসনের আইনজীবীদের ভাষ্য, খালেদা জিয়ার জামিন দিতে হবে, নইলে খারিজ করা হোক আবেদন। কিন্তু এটি না করে শুনানির জন্য দীর্ঘ সময় অতিবাহিত দুরভিসন্ধিমূলক। এ জন্য তারা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন।
জানতে চাইলে খালেদা জিয়ার আইনজীবী মাসুদ রানা বলেন, ‘বিচারিক আদালতে এ মামলাগুলো বিচারাধীন শুনানির জন্য রাখা হয়েছে। আমরা এ মামলাগুলোতে জামিন চেয়েছি। কোর্ট জামিন দেননি, আবার আমাদের আবেদন খারিজও করেননি। মামলাগুলো শুনানির জন্য লম্বা সময় নিয়েছেন আদালত, কিন্তু কেন? এ বিষয়গুলোকে সামনে রেখেই আমরা হাইকোর্টে এসেছি ম্যাডামের (খালেদা জিয়ার) জামিনের জন্য।
আমাদের সন্দেহ হচ্ছে, এ মামলাগুলোতে আদালত জামিন না দিয়ে জামিনের প্রক্রিয়া বিলম্ব করছে। এখানে পরোক্ষভাবে সরকারের হাত রয়েছে। এ জন্য আমরা বিচারিক আদালতের আদেশের বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য হাইকোর্টে এসেছি। দেখি হাইকোর্ট কী অদেশ দেন।’
জানতে চাইলে খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন প্রিয়.কমকে বলেন, ‘তিনটি মামলায় ম্যাডামকে শ্যোন দেখানো আছে। আমরা এগুলোতে জামিন চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেছি। আশা করছি আদালত আমাদের আবেদন শুনানি করে জামিন মঞ্জুর করবেন।’
খালেদা জিয়ার আরেক আইনজীবী অ্যাডভোকেট ফারুক হোসেন প্রিয়.কমকে বলেন, ‘শ্যোন অ্যারেস্ট দেখিয়ে কারাগারে রাখা হয়েছে ম্যাডামকে (খালেদা জিয়াকে)। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৬টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। তিনটি বাদে সকল মামলাতেই ম্যাডাম জামিনে আছেন। তিনটি মামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানোর কারণে তিনি কারামুক্ত হচ্ছেন না।’
শ্যোন অ্যারেস্ট কী জানতে চাইলে ফারুক হোসেন বলেন, ‘একজন আসামির বিরুদ্ধে অনেক মামলা দায়ের করা থাকলেও আসামিকে যেকোনো একটি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে আটক রাখা হয়। পরবর্তীতে সেই আসামিকে গ্রেফতার করতে চাইলে আদালতে প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ) আবেদন করেন অন্য মামলাগুলো গ্রেফতার দেখাতে। আদালত আবেদন দেখে আসামিকে প্রয়োজন মনে করলে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখায়।’
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় গত ১৬ মে আপিল বিভাগ খালেদা জিয়াকে জামিন দিলেও তিনি কারামুক্ত হতে পারছেন না তিনটি মামলায় গ্রেফতার দেখানোর কারণে। সেই তিন মামলায় জামিন চেয়ে আলাদাভাবে জামিন আবেদন করেছেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা।
২০ মে, রবিবার দুপুর ১২টায় বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি জে বি এম হাসানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চে এ আবেদন করা হয়।
এর আগে বেলা সোয়া ১১টায় এ বিষয়ে দায়ের করা এক আবেদনের শুনানির পরে কুমিল্লায় দুটি ও নড়াইলে একটি মামলায় খালেদা জিয়াকে জামিন আবেদনের অনুমতি দেন একই বেঞ্চ।
আদালতে খালেদা জিয়ার পক্ষে শুনানি করেন খন্দকার মাহবুব হোসেন। সঙ্গে ছিলেন ব্যারিস্টার একেএম এহসানুর রহমান।
খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার দেখানো মামলাগুলোর বিবরণ
২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের হায়দার পুলের চৌদ্দগ্রামে একটি কাভার্ডভ্যানে অগ্নিসংযোগ ও আশপাশের বেশ কিছু গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। পরে এই ঘটনায় ২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি চৌদ্দগ্রাম থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) বিশেষ ক্ষমতা আইনে নাশকতার অভিযোগে মামলা করেন।
২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এই মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল করা হয় আদালতে। এতে খালেদা জিয়াকে উসকানিদাতা হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়। এ মামলায় এফআইআরে খালেদা জিয়ার নাম ছিল না। পরবর্তী সময়ে তার নাম যোগ করা হয়েছে। খালেদা জিয়াসহ মোট ৩২ জনকে আসামি করা হয়েছে এ মামলায়।
মামলাটি বর্তমানে কুমিল্লার বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১-এ বিচারাধীন। ২০১৭ সালের ৯ অক্টোবর এ মামলায় অভিযোগ আমলে নেয় আদালত।
পরে চলতি বছরের ২৩ এপ্রিল এ মামলায় জামিন চেয়ে আবেদন করেন খালেদা জিয়া। কিন্তু আদালত আবেদন শুনানি করে জামিন বা খারিজ কোনটির আদেশ দেননি। পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ৭ জুন দিন ধার্য রেখেছে। এ জন্য সংক্ষুব্ধ হয়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা হাইকোর্টে গিয়েছেন।
যেসব যুক্তি দেখিয়েছেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা।
১৩টি যুক্তিতে আইনজীবীরা বলেছেন, এ মামলার এফআইআরে খালেদা জিয়ার নাম নেই, ঘটনাস্থলেও তিনি ছিলেন না। তিনি অসুস্থ। এ মামলার অন্য আসামিরা জামিনে আছেন। তার বয়স ৭৩ বছর। মামলায় তার বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, হয়রানি করার উদ্দেশ্যে এই মামলা করা হয়েছে। এ মামলার অন্য আসামিরা জামিনে আছেন।
হত্যার অভিযোগে কুমিল্লায় আরেক মামলা
২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে একটি বাসে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করা হয়। এই ঘটনায় সাতজন যাত্রী মারা যায় এবং আরও ২৫ থেকে ২৬ জন গুরুতর আহত হয়।
এ ঘটনায় পরের দিন ৩ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৩টায় চৌদ্দগ্রাম থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) নুরুজ্জামান ৫৬ জনের বিরুদ্ধে বাদী হয়ে মামলা করেন। পরে এ মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেওয়া হয়েছে।
বিচারকালে দায়রা আদালতে খালেদা জিয়ার জামিন চেয়ে আবেদন করা হয়। সেই জামিন আবেদনের পরবর্তী শুনানির জন্য ৭ জুন দিন ধার্য রাখা হয়েছে।
গত ৫ এপ্রিল এ মামলায় খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার দেখানো হয়। তাই ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৮ ধারায় হাইকোর্টে জামিন চেয়ে আবেদন করা হয়েছে।
এ মামলায় আইনজীবীরা যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন, মামলার তিন আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। কিন্তু তাদের কেউ জবানবন্দীতে খালেদা জিয়ার নাম উল্লেখ করেননি। এ ছাড়াও খালেদা জিয়া অসুস্থ, বয়স্ক ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী। এ বিবেচনায় তাকে জামিন দেওয়া হোক।
মানহানির অভিযোগে নড়াইলে মামলা
২০১৫ সালের ২১ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন খালেদা জিয়া। এ ঘটনায় একই বছরের ২৪ ডিসেম্বর খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নড়াইলে মানহানির মামলা করা হয়। স্থানীয় এক মুক্তিযোদ্ধার সন্তান মো. রায়হান ফারুকি ইমাম বাদী হয়ে মামলাটি করেন।
নড়াইলের মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতে মামলাটি বিচারাধীন। এ মামলায় চলতি বছরের ১৬ এপ্রিল খালেদা জিয়ার জামিন চেয়ে তার আইনজীবীরা আবেদন করেন। কিন্তু বিচারক বাদীর উপস্থিতিতে জামিন শুনানির জন্য ৮ এপ্রিল শুনানির পরবর্তী দিন ধার্য করেছিলেন। এরপর নির্ধারিত দিনে শুনানি নিয়ে পুনরায় জামিন শুনানির জন্য আগামী ২৫ মে দিন ধার্য রেখেছেন আদালত। এ অবস্থায় চলমান মামলায় খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা তার জামিন চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন।
জামিন চেয়ে আইনজীবীরা যুক্তি দেখিয়েছেন দণ্ডবিধির ৫০০, ৫০১ ও ৫০২ ধারা অনুযায়ী। এর অধীনে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়। কিন্তু এই তিন ধারার মামলাই জামিনযোগ্য। তা ছাড়াও খালেদা জিয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বয়স্ক। তাই এসব যুক্তিতে এ মামলায় জামিন চেয়েছেন তার আইনজীবীরা।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে গত ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন বকশীবাজারের অস্থায়ী আদালতের বিচারক ড. আকতারুজ্জামান।
মামলার অপর আসামি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ পাঁচ আসামিকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেয় আদালত।
রায় ঘোষণার পর থেকেই পুরান ঢাকার নাজিমুউদ্দিন রোডের কারাগারে রয়েছেন খালেদা জিয়া।
প্রিয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন