ভারতকে নতুন সম্পর্কের বার্তা দেয়া বিএনপি আসলে কী করতে চাইছে সেদিকে নজর রাখছে আওয়ামী লীগ। একইভাবে বিএনপির ‘বার্তায়’ ভারতের মনোভাব কী, সেটিও জানার চেষ্টা করছে ক্ষমতাসীন দল।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ভারত সফরে বিএনপি বলেছে, ক্ষমতায় গেলে তারা ভারতবিরোধী কিছু করবে না। কিন্তু এর আগে ভারতের সার্বভৌমত্ববিরোধী কী কী করেছিল তা এখনও বলেনি। সেটাও বলা উচিত। আর নতুন সম্পর্ক বলতে কী বোঝায় তাও পরিষ্কার করা উচিত।’
বাংলাদেশে মূলধারার রাজনীতিতে ভারতবিরোধী বক্তব্য দিয়ে মাঠ গরম রাখার ‘নীতি’ বিএনপি সেই জন্মলগ্ন থেকে চালিয়ে আসছে। তবে আওয়ামী লীগ মনে করে, বিএনপি ওপরে ওপরে ভারতবিরোধী দলেও তাদের এই বিরোধিতা কেবল বক্তব্যকেন্দ্রিক। ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বার্থ আদায়ে দলটি কখনও কিছু করতে পারেনি, করার চেষ্টাও করেনি।
ভারতের সঙ্গে স্থল সীমানা চুক্তি বাস্তবায়ন করে ছিটমহল বিনিময়, জলসীমানা নির্ধারণ, অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন, সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা, বাংলাদেশি পণ্যের ওপর অশুল্ক বাঁধাসহ নানা সমস্যা ভারতের সঙ্গে ছিল দেশের জন্মলগ্ন থেকেই।
এর মধ্যে গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি সই হয়েছে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর। আর ছিটমহল বিনিময় ও জলসীমা নির্ধারণ হয়েছে সরকারের বর্তমান আমলে। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি করতেও জোর চেষ্টা চালাচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার।
এর বাইরে সীমান্তে হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার ক্ষেত্রে ভারতের প্রতিশ্রুতি আদায় করেছে আওয়ামী লীগ সরকারই। আর প্রায় প্রতি বছর কমছে হত্যার সংখ্যা। চলতি বছরের সাড়ে পাঁচ মাসে সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর গুলিতে কোনো বাংলাদেশি নিহতের ঘটনা ঘটেনি।
আবার বর্তমান সরকারের আমলে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি, দুই দেশের যৌথ মালিকানায় বিদ্যুৎকেন্দ্র করা, বাংলাদেশের জন্য ভারতের অনুদান ও বড় অংকের ঋণ, ভারতীয় স্যাটেলাইট বিনামূল্যে বাংলাদেশের ব্যবহারের সুযোগ পাওয়া গেছে। তবে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সই না হওয়াটা দুই দেশের সম্পর্কে ‘কাঁটা’ হয়ে রয়েছে।
বরাবর ভারতবিরোধী মেঠো বক্তব্য দেয়া বিএনপি অবশ্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রতিবেশী দেশটির বিষয়ে তুলনামূলক নমনীয় বক্তব্য দিচ্ছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ঢাকা-কলকাতা রুটে বাস চালুর পর টানা ৭২ ঘণ্টার হরতালও দিয়েছিল বিএনপি।
পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফেরাতে অস্ত্র তুলে নেয়া জনসংহতি সমিতির সঙ্গে চুক্তির পর চট্টগ্রাম থেকে ফেনী পর্যন্ত ভারত হয়ে যাওয়ার দাবি তুলে লংমার্চও করেছিল বিএনপি।
বিএনপির শাসনামলে বাংলাদেশে দেশটির বিচ্ছিন্নতাবাদী বিভিন্ন গোষ্ঠী ও জঙ্গিরা এই দেশে আশ্রয় নিয়ে ভারতে আক্রমণ চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে দেশটির সরকার।
তবে সম্প্রতি বিএনপির তিন নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আবদুল আউয়াল মিণ্টু ও হুমায়ুন কবির অনেকটাই গোপনে ভারত সফর করে এসেছেন। ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য হিন্দুর খবর অনুযায়ী তিন নেতা ভারতের সঙ্গে নতুন সম্পর্কের বার্তা দিয়ে এসেছেন।
বিএনপির ভারতবিরোধী অবস্থানকে ৮০ ও ৯০ দশকের রাজনীতির ‘ভুল’ হিসেবে দেশটির গণমাধ্যমকে বলেছেন হুমায়ুন কবির।
বিএনপির তিন নেতা দেশে ফিরে এই সফর নিয়ে চুপ থাকলেও তুমুল আলোচনা চলছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। বিএনপি ‘নতুন সম্পর্ক’ বলতে ভারতকে কী বার্তা দিতে চেয়েছে সেটি জানা বোঝার চেষ্টা চলছে।
তবে আওয়ামী লীগ নেতারা বিভিন্ন আলোচনা বা গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপানে এ নিয়ে টিপ্পনি কাটছেন বিএনপিকে নিয়ে।
ভারতবিরোধী কট্টর অবস্থান বাংলাদেশে এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে বিএনপিকে জনপ্রিয় করেছে নিঃসন্দেহে। এখন বিএনপি তার অবস্থান পাল্টালে এই মানুষদের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া হয়, সেটিও পর্যবেক্ষণ করতে চায় আওয়ামী লীগ।
ক্ষমতাসীন দল মনে করে, বিএনপি যদি প্রকাশ্যে ভারতবিরোধী অবস্থান ছাড়ে, তাহলে বিএনপির জন্য তা ক্ষতির কারণও হতে পারে। কারণ, ভারতবিরোধী সেই মানুষগুলো তখন বিএনপির পাশে নাও থাকতে পারে।
আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বিএনপির এ ভারত সফর নিয়ে আওয়ামী লীগের কোনো মাথাব্যথা নেই। তবে মানুষের মধ্যে এ নিয়ে প্রশ্ন আছে।’
বিএনপি মনে করে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি তাদের বর্জনের মুখে আওয়ামী লীগের জিতে ক্ষমতায় আসা এবং সরকারের মেয়াদ পূর্তির পেছনে ভারতের সমর্থন আছে।
বিএনপির প্রতিনিধি দল সফরে গিয়ে ভারতের কাছে সরকারের বিরুদ্ধে কিছু অনুযোগ করে এসে তাদের ‘গণতান্ত্রিক’ আন্দোলনে পাশে থাকার আহ্বান জানিয়ে এসেছে বলেও জানিয়েছে দ্য হিন্দু।
আওয়ামী লীগ নেত্রী শাম্মী আহমদ বলছেন, ‘জনগণই ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসাবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। ভারত তো কাউকে ক্ষমতায় বসাতে পারবে না। বিএনপির উচিত জনগণের কাছে যাওয়া।’
ভারত সফর নিয়ে বিএনপির আগে থেকে না জানানো নিয়েও প্রশ্ন আছে ক্ষমতাসীন দলে। খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘তারা পূর্বে যাবে না পশ্চিমে যাবে তার জন্য গোপনীয়তা অবলম্বন করতে হবে কেন? দেশের জনগণের ওপর তাদের আস্থা নেই এজন্য তারা গোপনীয়তা অবলম্বন করেছে।’
‘আমাদের সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে বিশাল প্রতিনিধি দল ভারত সফর করেছে, কয়েকটি তারিখ পরিবর্তন হয়েছে। দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে ফলাও করে খবর ছাপানো হয়েছে। কিন্তু গোপন আর অন্ধকারের রাজনীতি বিএনপি করে। গোপনীয়তার মধ্যে অপরাধবোধ থাকে, ষড়যন্ত্র আর দেশবিরোধী চক্রান্ত থাকে।’
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক বিএনপির অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য ভারতের মতো সভ্য গণতান্ত্রিক দেশ কখনই আস্থায় নেবে না। বিএনপির জন্মই পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এর প্রেসক্রিপশনে। দলটি পরিচালিতও হয় পাকিস্তানের কথামতো।
অবশ্য বিএনপি নেতারা সফরে যাওয়ার আগের মতো ফেরার পরও এ বিষযে চুপ। দলের অন্য জ্যেষ্ঠ নেতারাও এ নিয়ে কিছুই বলছেন না, যেন কোনো কিছুই হয়নি।
(ঢাকাটাইমস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন