ঈদ মানে খুশি। রমজান শেষে পশ্চিম আকাশের বাঁকা চাঁদ মুসলিমদের মধ্যে সেই বার্তা দেয়। কিন্তু, এবারের ঈদ বিএনপি নেতাদের ‘বিষণ্নতায়’ মোড়া।
দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় কারাগারে। দীর্ঘদিন দেশের বাইরে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান। বাইরে যারা আছেন, তাদেরকেও তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে অজানা ‘আতঙ্ক’।
বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে ঈদুল ফিতর নিয়ে তাদের এমন অভিব্যক্তিই পাওয়া গেছে।
বিএনপি নেতাকর্মীদের দাবি, তাদের আবেগ-অনুভূতির জায়গা হচ্ছে দলীয় প্রধান খালেদা জিয়া। তাকে কারাগারে রেখে ঈদে আনন্দ হবে না।
এরই মধ্যে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন মানবিক কারণে ঈদের আগে নেত্রীকে প্যারোলে মুক্তির দাবির জানিয়েছেন।
প্রতি বছর ঈদের দিন বেলা সাড়ে ১১টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে কূটনীতিকসহ দলীয় নেতাকর্মী ও পেশাজীবীদের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। নেত্রীর সঙ্গে দেখা করে শুভেচ্ছা বিনিময়ের মধ্য দিয়ে ঈদ আনন্দ শুরু হয় বিএনপির নেতাকর্মীদের। এবার আর তা হচ্ছে না। তাই নেত্রীকে কারাগারে রেখে নেতাকর্মীরা বলা চলে ‘বিষণ্নতায়’ ভুগছেন।
তবে নেত্রীর অনুপস্থিতিতে এবার ঈদের নামাজের পরপরই বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবেন দলটির নেতাকর্মীরা।
এরপর দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের নেতৃত্বে দলের সিনিয়র নেতারা পুরানো ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে যাবেন। যেখানে নেত্রী খালেদা জিয়া বন্দি আছেন। তারা চেষ্টা করবেন তার সঙ্গে সাক্ষাতের। এজন্য আগেই কারা কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হবে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেসউইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘ঈদের নামাজের পরপরই জিয়াউর রহমানের মাজারে যাবেন বিএনপির মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতারা। মাজার জিয়ারত শেষে ওখান থেকে মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতা কারা ফটকে যাবেন।’
তিনি বলেন, ‘আসলে নেত্রীর অনুপস্থিতিতে ঈদে কোনো আনন্দ নেই। এজন্য নেত্রী যে কারাগারে আছেন, সেই কারা ফটকের সামনে একটু সময় কাটানো ঈদের সান্ত্বনা।’
খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন তারেক রহমান। অবশ্য তিনি বিভিন্ন মামলায় আসামি হয়ে রাজনৈতিক আশ্রয়ে সপরিবারে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন।
লন্ডনেই সপারিবারে ঈদ করবেন তারেক রহমান। প্রতিবছরই ওখানে অবস্থানরত দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন তিনি। লন্ডনেই রয়েছেন তার ছোট ভাই প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী ও দুই মেয়ে। ওখানেই তারা ঈদ করবেন বলে জানা গেছে।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, লে. জে (অব.) মাহবুবুর রহমান, মির্জা আব্বাস, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, সেলিমা রহমান ঢাকায় ঈদ করবেন বলে পরিবর্তন ডটকমকে জানিয়েছেন।
এ ছাড়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তার নির্বাচনী এলাকা নোয়াখালী, স্থায়ী কমিটির আরেক সিনিয়র সদস্য তরিকুল ইসলাম নিজ এলাকা যশোরে ঈদ করবেন। বরাবরই তিনি যশোরে ঈদ করেন।
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ঈদের দিন সকালে তার নির্বাচনী এলাকা কেরানীগঞ্জের সাধারণ মানুষের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে ঢাকায় জিয়াউর রহমানের সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবেন। এরপর তিনি বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কারা ফটকের সামনে যাবেন বলে জানিয়েছেন।
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ দীর্ঘদিন নিখোঁজ ছিলেন। এরপর তার সন্ধান পাওয়া যায় ভারতে। অনুপ্রবেশের দায়ে সেখানে তার নামে মামলা চলছে। সালাহউদ্দিন জামিনে থাকলেও দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা থাকায় তাকে ভারতেই ঈদ করতে হবে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যানদের মধ্যে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, বেগম সেলিমা রহমান, শওকত মাহমুদ ও ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন ঢাকায় ঈদ করবেন। আলতাফ হোসেন চৌধুরী নিজ এলাকা পটুয়াখালীতে, এম মোর্শেদ খান ও মীর মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন তাদের নির্বাচনী এলাকা চট্টগ্রামে ঈদ করবেন।
ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বরিশালে এবং শামসুজ্জামান দুদু চুয়াডাঙ্গায় ঈদ করবেন। অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খান ঢাকায় ঈদ করে তারপর নিজ নির্বাচনী এলাকা টাঙ্গাইলে যাবেন।
ঢাকার সাবেক মেয়র ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা এ মুহূর্তে চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে আছেন। সপরিবারে তিনি সেখানেই ঈদ করবেন।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী থাকবেন নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। যুগ্ম-মহাসচিব আসলাম চৌধুরীকে কারাগারে ঈদ করতে হচ্ছে। যুগ্ম-মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন ঢাকায়, মজিবুর রহমান সরোয়ার বরিশালে, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ঢাকাতেই ঈদ করবেন। খায়রুল কবির খোকন নরসিংদী ও হারুন-অর রশিদ চাঁপাইনবাবগঞ্জে ঈদ করবেন।
দলের সাংগঠনিক সম্পাদক এমরান সালেহ প্রিন্স ময়মনসিংহ এবং ফরিদপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ফরিদপুরে ঈদ করবেন। সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু নাটোরে ঈদ করবেন। বিলকিস জাহান শিরিন, ডা. সাখাওয়াত হোসেন জীবন নিজ নিজ এলাকায় নেতাকর্মীদের সঙ্গে ঈদ করবেন।
সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকদের মধ্যে শরিফুল আলম, শহিদুল ইসলাম বাবুল, সেলিমুজ্জামান সেলিম, আকন কুদ্দুসুর রহমান ও মাহবুবুর রহমান শামীম তাদের নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় নেতাকর্মীদের সঙ্গে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন।
বিএনপির কারাবন্দি নেতাদের মধ্যে আরও রয়েছেন— বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুস সালাম পিন্টু, বিএনপি নেতা অনিদ্য ইসলাম অমিত, আজিজুল বারি হেলাল, লুৎফুজ্জামান বাবর, হাবীবুর রশিদ হাবীব, যুবদলের সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাহ উদ্দিন টুকু, ছাত্রদলের সভাপতি রাজিব আহসান।
এ ছাড়া বিএনপির চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস কারাগারে আছেন। বিএনপির চেয়ারপারসনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল ঢাকাতেই ঈদ করবেন।
বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি হাবিব-উন নবী খান সোহেল ঢাকাতে নিজ নির্বাচনী এলাকায় ঈদ করবেন। এ ছাড়া ঢাকা মহানগর বিএনপির উত্তরের সভাপতি এমএ কাইয়ুম মালয়েশিয়াতে ঈদ করবেন। একাধিক মামলায় আসামি থাকায় তিনি দেশে ফিরছেন না।
বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের মধ্যে যুবদলের সভাপতি সাইফুল আলম নীরব, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শফিউল বারী বাবু ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েল, ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসানসহ অনেকেই ঢাকায় ঈদ করে নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় যাবেন।
মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাস ও সাধারণ সম্পাদক সুলতানা আহমেদ ঢাকায় ঈদ করবেন বলে পরিবর্তন ডটকমকে জানিয়েছেন।
এদিকে, ঈদের আগে সুলতান সালাহউদ্দিন টুকুকে গ্রেফতারের ঘটনায় বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই অনেকে স্বস্তিতে নেই বলে জানিয়েছেন।
তাদের দাবি, ঈদকে কেন্দ্র করে আগে থেকেই গ্রেফতার ‘বাণিজ্য’ চলছে। আন্দোলনের ভয়ে ঈদের মধ্যে সরকার গ্রেফতার অব্যাহত রাখতে পারে। তাই তারা অনেকেই আত্মগোপনে আছেন।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছে ৩৪টি মামলা। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ২১টি মামলা হয়েছে। মামলার সংখ্যা অনুযায়ী, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে ৮৮টি, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে ৫২টি ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধে ৩৭টি।
তরিকুল ইসলাম ও সালাহউদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে রয়েছে ১৪টি করে মামলা। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে ৯টি করে, নজরুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে ৭টি, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে ৩টি, এমকে আনোয়ার ৩৪টি মামলা মাথায় নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর বিরুদ্ধে ৪৯টি মামলা হয়েছে। চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ৫৪টি, বেগম সারওয়ারী রহমানের বিরুদ্ধে ৬টি, রিয়াজ রহমানের ২টি, এজে মোহাম্মদ আলীর ৬টি, আমানউল্লাহ আমানের বিরুদ্ধে ৯৬টি মামলা রয়েছে। একই অবস্থা কেন্দ্রীয় প্রায় সব এবং তৃণমূল বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নামে একাধিক মামলা রয়েছে।
এ বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘বিএনপির খুব অল্প সংখ্যক নেতাকর্মী পরিবার-পরিজনের সঙ্গে নির্বিঘ্নে ঈদ পালন করতে পারছেন। অধিকাংশ নেতাকর্মীই সরকারের অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার। ঈদের আনন্দ থেকে আমরা সবাই এখন বঞ্চিত।’
তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্রের আপসহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে অসুস্থ অবস্থায় কারাগারে রেখে আমাদের ঈদ কীভাবে আনন্দের হবে? গণতন্ত্রের বিজয় না হওয়া পর্যন্ত দেশের মানুষের ঈদের আনন্দ আসবে না।’
উল্লেখ্য, দুর্নীতি মামলায় গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে রয়েছেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন