চলতি মাসের শুরুতেই কারাগারে খালেদা জিয়া অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এ খবর চাউর হওয়ার পর থেকে বিএনপি ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়টিকে ইস্যু করে রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত রেখেছে; কিন্তু প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি এখনো। এতে বিলম্বিত হচ্ছে ৭২ বছর বয়স্ক দেশের সাবেক এ প্রধানমন্ত্রীর চিকিৎসা।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড পেয়ে গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকার পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে কারান্তরীণ আছেন খালেদা জিয়া। পাঁচ মাসের বেশি সময়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে পরিবারের লোকজন, ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও আইনজীবীদের সাক্ষাৎ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে তবে দলের কোনো নেতাকর্মীকে সে সুযোগ দেওয়া হয়নি। গত ৯ জুন ব্যক্তিগত চিকিৎসকরা খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে ফিরে সংবাদকর্মীদের কাছে দাবি করেন ৫ জুন খালেদা জিয়া মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। সে সময়ের স্মৃতি তিনি মনে করতে পারছেন না। ব্যক্তিগত চিকিৎসকরা ধারণা করছেন ওইদিন তিনি মাইল্ড স্ট্রোক করেছিলেন। ভবিষ্যতে বড় ধরনের স্ট্রোকের ঝুঁকি আছে বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন। যদিও জেল কর্তৃপক্ষ এবং সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে ওইদিন (৫ জুন) রোজা রাখায় তার সুগার নেমে গিয়েছিল। পরে তাকে জুস খাইয়ে স্বাভাবিক করা হয়েছে। ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের বক্তব্যের পর ১০ জুন খালেদা জিয়াকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে নেওয়ার উদ্যোগ নিলে তিনি ওই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে রাজি হননি। এরপর ১২ জুন তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল-সিএমএইচে নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হলে তাতেও তিনি সায় দেননি। বিএনপি নেতা ও খালেদার চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, খালেদা জিয়া ইউনাইটেডে চিকিৎসা নিতে চান।
মূলত কারারুদ্ধ হওয়ার আগে থেকেই বেশ কিছু রোগে ভুগছেন তিনি। গত ২৮ মার্চ কারাগারে তার অসুস্থ হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় বিএনপি খালেদাকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করানোর দাবি জানায়। এমন দাবি নিয়ে নানা নেতিবাচক গুঞ্জন শুরু হলে অবস্থান পাল্টে দলটি প্রাইভেট হাসপাতাল ইউনাইটেডে খালেদার চিকিৎসা করানোর দাবি তোলে। কারাবিধি অনুযায়ী ৭ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে (বিএসএমএমইউ) বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো হয় খালেদার। সে সময় তাকে হাসপাতালেও আনা হয়। তার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ড মত দেয় হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মতো তেমন কিছু হয়নি খালেদার। তার এক মাস পর ২৮ এপ্রিল এক সংবাদ সম্মেলনে খালেদার চিকিৎসকরা দাবি করেন, কারাগারে থাকলে খালেদা জিয়া প্যারালাইজড হয়ে যেতে পারেন, অন্ধ হয়ে যেতে পারেন অথবা তার প্র¯্রাব-পায়খানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
মার্চ মাস থেকেই খালেদার চিকিৎসা ইস্যুতে বিএনপি বেশ সরব হয়ে উঠেছে রাজনীতিতে। নির্বাচনী বছরে খালেদার অসুস্থতা এবং চিকিৎসার ইস্যুটিকে বড় করে তুলছে তারা। খালেদার মুক্তি, নির্বাচনকালীন সরকারের দাবির সঙ্গে খালেদার চিকিৎসার বিষয়টি ঘুরে ফিরে এসেছে রোজার মাসকে ঘিরে চলা দলটির রাজনৈতিক সভা-সমাবেশগুলোতে। এসব সভায় খালেদার চিকিৎসার ব্যাপারে সরকারের অবহেলা, লুকোছাপাÑ ইত্যাদির অভিযোগ তুলে জনগণের সহমর্মিতা আদায়ের চেষ্টা করেছেন বিএনপি নেতারা।
এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনরাও কয়েক কাঠি সরস। তারা বলছেন, খালেদা জিয়া যদি সত্যিই অসুস্থ হতেন তাহলে হাসপাতাল বাছাইয়ে তিনি সময় নষ্ট করতেন না। বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের মতো সর্বোচ্চ চিকিৎসালয়ে তিনি অনাগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এমনকি সারাজীবন যে সামরিক বলয়ে থেকে রাজনীতি করেছেন, যার স্বামী একজন সাবেক সামরিক প্রধান, তিনিই কিনা সিএমএইচের মতো সর্বোচ্চ নিরাপদ হাসপাতালের চিকিৎসায় আস্থা রাখতে পারছেন না! তার এ অবস্থানের পেছনে রাজনৈতিক অভিসন্ধি দেখছেন ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন নেতা।
সর্বশেষ গতকাল সোমবার সচিবালয়ের নিজ দপ্তরে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, বিএনপি নেতারা খালেদার শারীরিক অবস্থা নিয়ে চিন্তিত নন। সে কারণেই তারা সিএমএইচের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে বিএনপি রাজনীতি করছে। সিএমএইচে সরকার তার সুচিকিৎসার কথা বলেছে কিন্তু তারা সেটাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে- তারা খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়ে যত না আগ্রহী, তার চেয়ে বেশি আগ্রহী ঈদের পর আন্দোলনের ইস্যু খুঁজতে। এটা নিয়েই তারা বেশি ব্যস্ত। তিনি প্রশ্ন রাখেন, বাংলাদেশে চিকিৎসার জন্য সিএমএইচেই সবচেয়ে আধুনিক ব্যবস্থা আছে। কিন্তু সামরিক পরিবারের একজন সদস্য হয়েও সেখানে চিকিৎসা নিতে খালেদা জিয়া কেন সংশয় প্রকাশ করেন? কেন তার এখানে শঙ্কা?
একই দিন সচিবালয়ে সাংবাদিকদের কাছে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা তোফায়েল আহমদ বলেছেন, খালেদা জিয়া অসুস্থ কি না, এ নিয়ে দেশবাসীর মধ্যে সংশয় আছে। অসুস্থ হলে কেউ হাসপাতাল পছন্দ করা নিয়ে সময় নষ্ট করতে পারেন না।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী গতকাল নয়াপল্টনের দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ফের দলের অবস্থানের কথা জানিয়েছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন, কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসনের চিকিৎসা নিয়ে সরকার ‘দুরভিসন্ধিমূলক নীলনকশা’ করছে। রিজভী বলেছেন, খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে পানি ঘোলা করার উদ্দেশ্যই হচ্ছে খালেদা জিয়াকে বিনা চিকিৎসায় নিঃশেষ করে দেওয়া। এখানে একগুঁয়েমি দুরভিসন্ধিমূলক এবং সুদূরপ্রসারী নীল নকশা আছে সরকারের।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জেলকোড অনুযায়ী কারাবন্দি খালেদার চিকিৎসা হবে। এ ক্ষেত্রে রোগের ধরন-প্রকরণ, অবস্থা ও গুরুত্ব বুঝে কারা কর্তৃপক্ষ তার চিকিৎসা করাবে। কারা চিকিৎসকদের দিয়ে ভালো চিকিৎসা নিশ্চিত করা না গেলে কারাগারের বাইরে সরকারি হাসপাতালকেই চিকিৎসার জন্য বেছে নেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ চিকিৎসাদানের সক্ষমতার নিক্তিতে হাসপাতাল নির্বাচন করবে তারা। প্রয়োজন পড়লে দেশের যে কোনো প্রাইভেট হাসপাতাল এমনকি বিদেশে চিকিৎসার বিষয়টিও বিবেচনায় রাখে কারা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বিএনপি বারবার ইউনাইটেড হাসপাতালের মতো একটি প্রাইভেট হাসপাতালে খালেদার চিকিৎসা করানোর দাবি জানানোয় ক্ষমতাসীনরা বিষয়টিকে ভালোভাবে নিচ্ছে না। এমনকি সাধারণ মানুষের মাঝে এমন প্রশ্নও ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ হাসপাতাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) চাইতেও কি বেশি সুবিধাসম্পন্ন বা উন্নত ইউনাইটেড হাসপাতাল? কিংবা সিএমইচের চাইতেও কি বেশি নিরাপদ ইউনাইটেড?
রাজনৈতিক মহল বলছে- খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে বিএনপির দু’দুটো ভুল অবস্থান স্পষ্ট হয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। তারা প্রথম দিকে খালেদাকে বিদেশে চিকিৎসা করানোর কথা বলে একটা ভুল করে ফেলেছিলেন। সে অবস্থান রাজনৈতিক কোনো ফায়দা দেবে না বুঝতে পেরে এবং সমালোচনার মুখে রাতারাতি অবস্থান বদল করে ইউনাইটেডে চিকিৎসার দাবি তোলে বিএনপি। পরবর্তীতে সরকারের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের বিকল্প হিসেবে সিএমএইচে চিকিৎসার প্রস্তাব দেওয়ার পরও যখন বিএনপি ঘুরেফিরে ইউনাইটেডেই অনড় থাকছে এতে জনসমক্ষে বিএনপির একগুঁয়েমি ও অভিসন্ধিই প্রকাশ পাচ্ছে, যা দলটির আরেকটি ভুল দৃশ্যমান হচ্ছে মানুষের কাছে। কারণ খালেদার চিকিৎসা নিয়ে রাজনীতি করাটা সাধারণ মানুষ পছন্দ করছেন না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের দাবি অনুযায়ী খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে জনমনে এক ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও রয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা যদি সত্যিই গুরুতর হয় তবে দ্রুততম সময়ে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করাটাই সমীচীন হবে। এ অবস্থায় কোথায় চিকিৎসা হবে এ নিয়ে সরকার এবং বিএনপির রশি টানাটানি খালেদার চিকিৎসা বিলম্বিত করবে এবং যে কোনো আশঙ্কাকেই সত্যি করে তুলবে।
অনেকে তিনবারের নির্বাচিত সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী এবং জনপ্রিয় একজন নেত্রীর শারীরিক অবস্থা ও চিকিৎসা নিয়ে রাজনীতি না করার কথাও বলেছেন। কারাবিধি অনুযায়ী খালেদা জিয়াকে দ্রুত চিকিৎসা করাটাই সঙ্গত বলে মনে করছেন তারা। এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে যেসব যুক্তিতে বিএনপি খালেদার চিকিৎসা করাতে রাজি নয়, সেসব যুক্তি সিএমএইচের ক্ষেত্রে খাটবে না বলেও মত তাদের।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন