ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির থানা ও ওয়ার্ড কমিটি নিয়ে বিপাকে রয়েছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। কমিটি গঠনে দলের গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করা এবং সিনিয়র নেতাদের পরামর্শকে গুরুত্ব না দেওয়ার বিষয় নিয়ে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কয়েকজন নেতা। তারা বিষয়টি দ্রুত সুরাহার জন্য দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে মহাসচিবকে কথা বলার জন্যও পরামর্শ দিয়েছেন।
নিয়োগ বাণিজ্য আর স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে বিতর্কিত ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটি গঠন করায় কার্যত কমিটিগুলো অচল হয়ে পড়েছে। দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীরা এ কমিটিগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। পদবঞ্চিত পরীক্ষিত নেতাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে ঢাকা মহানগর উত্তর কমিটির ৩০ জন পদধারী নেতাও রাস্তায় নেমেছেন। তারা মহানগর কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পদত্যাগ চাইছেন।
দলের স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য সমকালকে বলেন, ঢাকা মহানগরের গত কমিটি থানা ও ওয়ার্ড কমিটি গঠনের কাজ চূড়ান্ত করেছিল। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে তখন তা ঘোষণা করা হয়নি। তবে বর্তমান কমিটির কাছে সেসব থানা ওয়ার্ড কমিটির তালিকা দেওয়া হয়েছিল। তারা তা আমলে নেয়নি। এ ঘটনা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে জানিয়ে প্রতিকার চাওয়া হয়েছে।
এদিকে ঈদের পরদিন গত রোববার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ঢাকা মহানগরের সাবেক আহ্বায়ক মির্জা আব্বাসের শাহজাহানপুরের বাসায় যান মহানগরের অন্তত ৫০টি থানার নেতাকর্মীরা। তারা তার কাছে থানা-ওয়ার্ড কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন অনিয়মের কথা জানান। মির্জা আব্বাস নেতাকর্মীদের বলেন, তিনি যে কমিটি অনুমোদন দিয়েছেন সেই কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকই থানাগুলোতে সব কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। সেখানে উপস্থিত ঢাকা মহানগর উত্তরের সহসভাপতি আলতাব উদ্দিন মোল্লা জানান, ঢাকা মহানগরের সাবেক আহ্বায়ক মির্জা আব্বাসই থানা কমিটির অনুমোদন দিয়েছিলেন, যেখানে মহানগর কমিটির সদস্যদের স্বাক্ষর ছিল। সেই কমিটি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কাছে জমা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অনিবার্য কারণে তা ঘোষণা করা হয়নি। মির্জা আব্বাস অনুমোদিত ওই কমিটিতে পল্লবী থানা শাখার সভাপতির দায়িত্বে আছেন বলে জানান আলতাব উদ্দিন।
এ সম্পর্কে জানতে ঢাকা মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক আহসানউল্লাহ হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
এদিকে মহানগর উত্তর বিএনপির পদধারী বিদ্রোহী নেতারা এই মর্মে অভিযোগ করেছেন যে, থানা ও ওয়ার্ড কমিটি গঠনে তাদের কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক একক ক্ষমতাবলে কমিটি গঠন করেছেন। এসব কারণে অচিরেই মহানগর কমিটির বিরুদ্ধে অনাস্থা দিয়ে এসব 'পকেট কমিটি'র বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদ জানাবেন।
গতকাল সোমবার সকালে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে দেখা করে ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা আট দফা সংবলিত একটি অভিযোগপত্র তুলে দিয়েছেন। মহাসচিবের উত্তরার বাসায় দেখা করে তারা উত্তর বিএনপির সভাপতি এম এ কাইয়ুম ও সাধারণ সম্পাদক আহসানউল্লাহ হাসানের বিরুদ্ধে কমিটি গঠনে বাণিজ্য, স্বেচ্ছাচারিতা ও পকেট কমিটি করার অভিযোগ তুলে ধরেন। মহাসচিব তাদের অভিযোগ শোনেন এবং দ্রুতই ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন। তিনি তাদের বলেন, বিষয়টি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও জানেন। তিনি তাকে (মহাসচিবকে) এই জটিলতা নিরসনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন।
মহানগর বিএনপির নেতারা জানান, মহাসচিব আজ মঙ্গলবার আবার দেখা করার জন্য তাদের সময় দিয়েছেন। এ সময় তারা কমিটি গঠনে সব অনিয়মের তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে ত্যাগীদের নামের তালিকা হস্তান্তর করবেন।
এ বিষয়ে মহানগর উত্তর বিএনপির সহসভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, কমিটি নিয়ে নানা অনিয়মের কথা তুলে ধরা হয়েছে। মহাসচিব সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন এবং বলেছেন, বিষয়টি তিনি জানেন।
যুগ্ম সম্পাদক শামীম পারভেজ বলেন, তারা কাইয়ুম-হাসানের পদত্যাগ দাবি থেকে সরে আসেননি। তারা মহাসচিবের কাছে দাবিগুলো তুলে ধরেছেন। তিনি সেগুলো সমাধানের কথা বলেছেন।
খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে কঠোর আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। এ জন্য দলকে সাংগঠনিকভাবে আরও শক্তিশালী করার উদ্যোগ হিসেবে রমজান মাসকে 'সাংগঠনিক মাস' হিসেবে ঘোষণা করেছিল দলটি। ওই মাসেই ঘোষণা করা হয় ঢাকা মহানগর বিএনপির উত্তর ও দক্ষিণ শাখার থানা ও ওয়ার্ডের নতুন কমিটি। ৩ জুন ঢাকা মহানগর উত্তরে ২৫টি থানা ও ৫৮টি ওয়ার্ডের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়।
সংকট সমাধানে স্থায়ী কমিটির বৈঠক :বিএনপির বিভিন্ন সাংগঠনিক কমিটি গঠনে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়েছে।
গতকাল সোমবার গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত এ বৈঠক হয়। বৈঠকে স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, মহানগর কমিটির থানা ও ওয়ার্ড কমিটি গঠনে থানা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে পদাধিকার বলে মহানগর বিএনপির সহসভাপতি ও যুগ্ম সম্পাদক করা হয়েছে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তারা মহানগর বিএনপির সদস্য হিসেবে গণ্য হবেন। কিন্তু সংগঠনের সভাপতি এম এ কাইয়ুম ও সাধারণ সম্পাদক আহসানউল্লাহ হাসানের এমন সিদ্ধান্ত গঠনতন্ত্রের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
আরেক সদস্য বলেন, তারেক রহমানের দোহাই দিয়ে তারা এ অপকর্ম করেছেন। কিন্তু বিষয়টি তারেক রহমান অবগত থাকলে এবং তিনি প্রয়োজন মনে করলে স্থায়ী কমিটির বৈঠক ডেকে রেজুলেশনের মাধ্যমে গঠনতন্ত্র সংশোধন করা যেত। কিন্তু স্থায়ী কমিটির অনুমতি ছাড়া এ ধরনের গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন দলের মধ্যে খারাপ নজির সৃষ্টি করবে। তাই দ্রুত এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য মহাসচিবকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন তারা।
এ ছাড়া বৈঠকে দলের সাংগঠনিক অবস্থা, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন, খালেদা জিয়ার মামলা ও চিকিৎসার বিষয়ে আলোচনা করা হয়।
দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়াও বৈঠকে স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন