নীরব কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়িয়েছে আওয়ামী লীগ। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দলীয় অবস্থান এবং নির্বাচন নিয়ে সরকারের চিন্তাভাবনার বিষয়ে বার্তা দিতেই এ কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছেন ক্ষমতাসীনরা। শুধু দলীয় ব্যক্তিদের দিয়েই নয়, বিভিন্ন মাধ্যমে বাংলাদেশে নিযুক্ত দেশগুলোর রাষ্ট্রদূত এবং বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তিদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা চালাচ্ছে হাইকমান্ড। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে দলের শীর্ষ চার নেতাকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছেন। দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে এসব তথ্য জানা গেছে।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের ওই নেতারা জানান, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার পর থেকেই নানামুখী কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করে বিএনপি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে বিদেশিদের কাছে নিজেদের মতো করে তথ্য উপস্থাপন করছেন দলটির দায়িত্বশীলরা। এ ছাড়া আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচন, নির্বাচনকালীন পরিবেশ নিয়ে কূটনীতিক ও দাতা সংস্থাগুলোরও নানা জিজ্ঞাসা রয়েছে। মূলত এসব বিষয়ের জবাব দেওয়ার পাশাপাশি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের বিভিন্ন কৌশল কূটনীতিকদের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন আওয়ামী লীগের কূটনৈতিক উইং। এ কাজে কয়েক মাস ধরে ব্যস্ত সময় পার করছেন আওয়ামী লীগ সভাপতির বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত
চার নেতা। তারা হলেনÑ দলের সভাপতিম-লীর সদস্য লে. কর্নেল (অব) মুহম্মদ ফারুক খান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপ-কমিটির চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির এবং আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদ। এ চার নেতাকে বিশেষভাবে সহযোগিতা করছেন দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও উপ-দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়–য়া।
সরকারি দলের একাধিক উচ্চ পর্যায়ের সূত্রে জানা গেছে, আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত পরিবর্তন হচ্ছে। গত ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে নতুন রাষ্ট্রদূত হিসেবে ঝাং জুওকে নিয়োগ দিয়েছে চীন। এ ছাড়া অল্প সময়ের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের রাষ্ট্রদূতও পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া স্টিফেনস ব্লুম বার্নিকাট ও ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলার স্থলে নতুন দুজনকে নিয়োগ দিতে যাচ্ছে দেশ দুটির হেডকোয়ার্টার। শুধু তা-ই নয়, আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে অন্য দেশগুলোর দূতাবাসের কর্মপরিধিও বেড়েছে। সামগ্রিক দিক বিবেচনায় নির্বাচনের আগে এই কয়েক মাসে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখবে ক্ষমতাসীনরা।
আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্ট নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, গত দুই মাসে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। তাদের মধ্যে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি, মার্কিন রাষ্ট্রদূত, নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত, জার্মানির রাষ্ট্রদূত, ভারতীয় দূতাবাস ও রাষ্ট্রদূত, চীনের রাষ্ট্রদূত, ফ্রান্স রাষ্ট্রদূত, মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূত, ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক অন্যতম। দলটির নেতারা জানিয়েছেন, কখনো দূতাবাসগুলোয় যাচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতারা, কখনো ওই রাষ্ট্রদূতরা আওয়ামী লীগ নেতাদের বাসায়-অফিসে আসছেন, কখনো তারকা হোটেলে চলছে দ্বিপক্ষীয় আলাপ। এভাবেই প্রতিনিয়ত দুপক্ষের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা চলছে। সম্প্রতি রাজধানীর হোটেল লেক শোরে বাংলাদেশে নিযুক্ত সব দেশের রাষ্ট্রদূতকে ব্রিফ করে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপ-কমিটি। দুদিন আগে জার্মানির রাষ্ট্রদূত নিজেই আওয়ামী লীগের ধানম-ির কার্যালয়ে এসে আড্ডা দিয়ে যান। শুধু তা-ই নয়, গত এক সপ্তাহে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদের সঙ্গে কমপক্ষে ৫ কূটনীতিক বৈঠক করেছেন বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। দলের কূটনৈতিক তৎপরতা বেগবানের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের ধানম-ি কার্যালয়ে নতুন একটি কক্ষও নির্মাণ করা হয়েছে দলের আন্তর্জাতিক সম্পাদকের জন্য।
কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকের আলোচনার বিষয়বস্তু জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য লে. কর্নেল (অব) ফারুক খান আমাদের সময়কে বলেন, মূলত তিন-চারটা কথা তাদের বলি আমরা। প্রথম কথাÑ দেশ আগামী নির্বাচনের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত। নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী। সব দল আগামী নির্বাচনে আসার মতো একটা পরিস্থিতি দেশে সৃষ্টি হয়েছে। দ্বিতীয়Ñ আগামী নির্বাচন তাদের দেশে যেভাবে সংবিধান অনুযায়ী হয়, আমাদের দেশেও একইভাবে হবে। তৃতীয়Ñ তারা অনেক সময় বিএনপির বিষয়ে জানতে চায়, জবাবে আমরা বলি বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক এটা আমরাও চাই; কিন্তু তাদের নির্বাচনে নিয়ে আসার দায়িত্ব আমাদের নয়। নির্বাচন ও নির্বাচনকালে সেনা মোতায়েনের বিষয়ে বিএনপির কোনো বক্তব্য থাকলে তারা সেটি নির্বাচন কমিশনকে বলুক, এই এখতিয়ার কমিশনের আমাদের নয়। আওয়ামী লীগের সাবেক এই আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক বলেন, কূটনীতিকদের আগামী নির্বাচন নিয়ে কোনো অনিশ্চয়তার কারণ আছে বলে আমরা মনে করি না।
জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ডা. দীপু মনি আমাদের সময়কে বলেন, এখানে যেসব বিদেশি রাষ্ট্রদূত আছেন তারা কী ভাবছেন, আমরা কী ভাবছি; তাদের সেই ভাবনায় যদি কোনো ঘাটতি থাকে, সেগুলো আলোচনার মাধ্যমে আমরা সমাধানের চেষ্টা করি। মূলত দলের পররাষ্ট্রনীতিকে এগিয়ে নিতেই আমাদের আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপ-কমিটি কাজ করছে, রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে মতবিনিময় করছে।
একই বিষয়ে দলটির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, দুই ধরনের কূটনীতিতে মনোযোগী আমরা। প্রথমটা হচ্ছেÑ বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছেÑ বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন।
নির্বাচনের প্রাক্কালে কূটনৈতিক তৎপরতার বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল আমাদের সময়কে বলেন, এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেভাবে বঙ্গবন্ধুকন্যার প্রতি রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, তাকে আরও বেগবান করার জন্য এবং আগামী দিনগুলোয় সরকার পরিচালনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অব্যাহত সমর্থন নিশ্চিতের লক্ষ্যে নির্বাচনের প্রাক্কালে কূটনীতিকমহলে আমাদের তৎপরতা বাড়বেÑ এটাই স্বাভাবিক। তবে আমাদের এ তৎপরতা বিএনপির মতো ষড়যন্ত্রের জন্য নয়, স্বাভাবিক ও সুস্থ রাজনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন