একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৪ দলীয় জোট থাকবে নাকি আবার মহাজোট হবে এবং তাদের আসন বণ্টন কেমন হবে তা এখনই চূড়ান্ত করতে চায় না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে ভোটের আগে সমমনা ও শরিকদের সঙ্গে হিসাব-নিকাশ চূড়ান্ত করতে চায় দলটি। এ জন্য এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা চললেও এখনই কাউকে নির্দিষ্ট কোনো আসনের বিষয়ে সবুজ সংকেত দেয়া হচ্ছে না। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের মতে, সমমনা ও শরিকদের সঙ্গে আলোচনা আগে থেকেই শুরু হয়েছে, এখনো চলছে। কিন্তু এখনই কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে না। তাদের সঙ্গে কথা বলছি, পরিবেশ-পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। নির্বাচনের আগে এ বিষয়গুলোতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।
ভোটের আগে জোটের ভাঙাগড়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন নয়। বিশেষ করে নব্বইয়ের দশক ছিল জোট ভাঙাগড়ার অস্থিরতম সময়। আশির দশকে যে জোট ছিল আন্দোলনভিত্তিক, নব্বইয়ে এসে তা নির্বাচনকেন্দ্রীক হতে থাকে। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোটামুটি জোটের মেরুকরণ ঘটে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট সম্প্রসারিত হয়ে মহাজোট গঠিত হয়। ২০০৮ সালে জোটবদ্ধ হয়ে ভোট করে জাতীয় পার্টি ২৭ আসনে জিতে আওয়ামী লীগ সরকারের অংশীদার হয়। তবে ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের ১৮ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে মহাজোট ছাড়ার ঘোষণা দেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। দলের ভাইস চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দেন। পরে অনেক নাটকীয়তার পর রংপুর-৩ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর শপথ নেন এরশাদ। পরে এরশাদকে মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত করা হয়। রওশন এরশাদ বিরোধী দলের নেতা এবং জাতীয় পার্টির কয়েক নেতা মন্ত্রী হন।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দুই ধরনের চিন্তা মাথায় রেখে প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ। যা নির্ভর করছে বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণের ওপর। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে ১৪ দলীয় জোটের সঙ্গে যোগ হতে পারে জাতীয় পার্টিসহ আরো দুই-একটি নতুন দল। তখন আসন ভাগাভাগির হিসাবে দেখা যাবে অনেক পরিবর্তন। আর বিএনপি অংশ না নিলে ১৪ দলীয় জোট এক থেকেই নির্বাচনী মাঠে লড়বে আওয়ামী লীগ। সেক্ষেত্রে জোটের আসন ভাগাভাগিতে দশম নির্বাচনের চেয়ে খুব বেশি পরিবর্তন হওয়ার সম্ভবনা কম। তবে আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করছেন নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে। আর সেটা চিন্তা করেই এখনই সিদ্ধান্ত জানাচ্ছে না তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য মানবকণ্ঠকে বলেন, বিএনপির সামনে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিকল্প নেই। তারা অংশ নেবে এটা ধরে নিয়েই আওয়ামী লীগ প্রস্তুতি নিচ্ছে। অন্যদিকে আমাদের ১৪ দলীয় জোট আছে। শরিকরাও তাদের দাবি দাওয়া তুলে ধরছে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা এখনই কোনো বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে চাই না। আমাদের নেত্রী (আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের বিষয়ে যেমন খোঁজ খবর রাখছেন, তেমনি শরিকদের কে কোথায় আসন চায়, সেখানে তাদের প্রার্থী কতটা শক্তিশালী, সেসব বিষয়েও খোঁজ-খবর রাখছেন। জাতীয় পার্টির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জাতীয় পার্টির সঙ্গে অ্যালায়েন্স করে আমরা তো আগেও নির্বাচন করেছি। ভবিষ্যতেও করতে পারি। কিন্তু সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। নির্বাচনের আগে এই হিসাব-নিকাশ চূড়ান্ত হবে।
এদিকে একাদশ নির্বাচনে ১৪ দলীয় জোট নাকি মহাজোট হবে সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না হলেও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও ইতিমধ্যেই আওয়ামী লীগের কাছে বৃহত্তর রংপুরের ২২টি আসনসহ ৭০টি সংসদীয় আসন ও ১০-১২টি মন্ত্রণালয় দেয়ার দাবি করে রেখেছেন। প্রকাশ্যে তার এমন দাবির পরে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, মন্ত্রিত্ব তখনই ঠিক হবে, যখন আমরা অ্যালায়েন্স হয়ে সরকার গঠন করব। তখন মন্ত্রিত্বের বিষয় আসবে, কে কতটা মন্ত্রণালয় পাবে? কাজেই এ বিষয়টা পরের ব্যাপার। এখন ঠিক করার বিষয় নয়। তাহলে কি আগামী নির্বাচনে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের জোট হচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে কাদের বলেন, জোট হবে না; আমি এই কথা এখন বলতে পারছি না। সেটা তো সময় বলে দেবে?
জোটের অন্য শরিক দলের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির বিষয়ে শিগগিরই আলোচনা শুরু হবে জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, এরশাদ সাহেব জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান। আমি সবিনয়ে বলব, অ্যালায়েন্সে কে কত আসন পাবে, সেটা আমাদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হবে। এটা আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সব সময় ঠিক হয়। প্রকাশ্যে আমরা কে কত সিট দাবি করছি- এটা আমার মনে হয়, না বললেই ভালো।
এদিকে ১৪ দলের অন্য শরিক দলগুলোও আলাদা আলাদাভাবে আসনের দাবি তুলেছে। জোটের বৈঠকে মুখপাত্র এবং আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিমের কাছে এ বিষয়ে একাধিকবার কথাও বলেছেন তারা। এ ছাড়া কয়েকটি দলের শীর্ষ নেতারাও সময় সুযোগ মতো আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছেও নিজেদের আসনের বিষয়ে কথা বলেছেন এবং বলছেন। শরিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারা আওয়ামী লীগের কাছে প্রায় শতাধিক আসন দাবি করবে। এর মধ্যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (ইনু-শিরিন) ৩০, জাসদ (আম্বিয়া-প্রধান) ১৫, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ১৪, ন্যাপ ২০, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) ৬, গণতন্ত্রী পার্টি ১০, জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) ২, সাম্যবাদী দল ৪, গণআজাদী লীগ ১০, তরিকত ফেডারেশন ১০, কমিউনিস্ট কেন্দ্র দুটি। এর বাইরে জোটের এমন কিছু শরিক আছে, যাদের নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন নেই। যেমন- গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, কমিউনিস্ট কেন্দ্র এবং বাসদ।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান মানবকণ্ঠকে বলেন, সারা বিশ্বেই জোট একটি জটিল প্রক্রিয়া। শরিকদের চাওয়া অনেক, কিন্তু জয়লাভ করতে পারে এমন প্রার্থী কম, যা তাদের জরিপে এসেছে। এর পরও বড় দলকেই ছাড় দিতে হয়। এটিকে সূক্ষ্মভাবে সামলাতে হয়। তিনি বলেন, প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই একটি ব্রেকিং পয়েন্ট আছে, যার আগ পর্যন্ত দর কষাকষি চলতেই থাকবে। তবে জোটের রাজনীতিতে দলের সভাপতি শেখ হাসিনা অনেক অভিজ্ঞ। তিনি সঠিক ও দক্ষভাবে তা সামলাবেন
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন