সারা দেশের বেশিরভাগ ওষুধের দোকানে এখন অনুমোদনবিহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের পাশাপাশি নকল ও নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। ফলে যে ওষুধ মানুষের প্রাণ বাঁচানোর কথা, সে ওষুধই প্রাণের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে অতি মুনাফালোভীদের কারণে। স্পর্শকাতর ফার্মেসি ব্যবসার জন্য ওষুধপ্রশাসন অধিদপ্তর থেকে লাইসেন্স নিতে হয়। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, দেশে লাইসেন্সধারী ফার্মেসির চেয়ে লাইসেন্সবিহীন ফার্মেসির সংখ্যাই বেশি। উপরন্তু যেগুলোর লাইসেন্স আছে, সেগুলোও মানছে না অধিদপ্তর থেকে বেঁধে দেওয়া শর্তাদি। ফলে ফার্মেসি ব্যবসা এখন হয়ে উঠেছে প্রাণঘাতী।
কিছু ওষুধের মান রক্ষায় সেগুলো নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রাখতে হয়। তাই সব ফার্মেসিতে বিশেষ ফ্রিজ থাকা বাধ্যতামূলক। মুষ্টিমেয় কিছু ফার্মেসিতেই শুধু এমন ফ্রিজ রয়েছে। ফলে এসব ওষুধের মানই শুধু নষ্ট হচ্ছে না, এগুলো সেবনে হিতে বিপরীত হচ্ছে; রোগ নিরাময়ের পরিবর্তে বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি।
এদিকে জনবলের অভাবে ওষুধপ্রশাসন অধিদপ্তর থেকে যথাযথ তদারকি করা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে উদ্বিগ্ন অধিদপ্তর চায় অবৈধ ফার্মেসি বন্ধে অভিযান চালাতে। কিন্তু সরকারের অনুমোদন না থাকায় সেটিও সম্ভব হচ্ছে না।
ওষুধপ্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, দেশীয় ও আমদানিকৃত ওষুধ বিক্রির জন্য সারা দেশে লাইসেন্সধারী ফার্মেসি রয়েছে এক লাখ ২৩ হাজার ৮৩৬টি আর লাইসেন্সবিহীন রয়েছে ১৯ হাজার ২৫৪টি। তবে এই হিসাব স্রেফ কাগুজে। বাস্তবে লাইসেন্সধারীর চেয়ে লাইসেন্সবিহীন ফার্মেসির সংখ্যা বেশি। সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকেও এমন উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে। বৈঠকে বক্তারা ধারণা দেন, দেশে লাইসেন্সবিহীন ফার্মেসির সংখ্যা প্রায় ৭ লাখ হতে পারে।
এসব ফার্মেসির মধ্যে অধিকাংশই ওষুধপ্রশাসন অধিদপ্তরের নজরদারির বাইরে। ২০১৬ সালে ওষুধ প্রশাসনের কর্মকর্তারা ৬১ হাজার ৯৪৫টি ফার্মেসি পরিদর্শন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাদেরই করা মোট ফার্মেসির হিসাবে অর্ধেকের বেশিই থেকে গেছে পরিদর্শনের বাইরে। শুধু তাই নয়, পরিদর্শনকৃত ফার্মেসিগুলোতেও নানা অনিয়ম পাওয়া গেছে। তাদের বিরুদ্ধে জরিমানা ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বললেই চলে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দেওয়া তথ্যমতে, লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ করে দেশের ফার্মেসিগুলোতে দেদার বিক্রি হচ্ছে ফুড সাপ্লিমেন্ট বেশি মুনাফার লোভে।
র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারওয়ার আলম বলেন, লাইসেন্সবিহীন ফার্মেসিতে নকল ও অনুমোদনহীন ওষুধ বেশি বিক্রি হয়। ফার্মেসিগুলোতে ফুড সাপ্লিমেন্ট বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া কুল চেইন মেনটেইন করা হচ্ছে না।
সূত্র জানায়, ড্রাগ লাইসেন্সের শর্তানুযায়ী সাধারণত লঘু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ৩৯টি ওষুধ চিকিৎসকের নির্দেশনা (প্রেসক্রিপশন) ছাড়া বিক্রি করা যাবে। অন্য কোনো ওষুধ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া বিক্রি করা যাবে না। কিন্তু ফার্মেসিগুলো এ নিয়মের কোনো তোয়াক্কাই করে না। এমনকি চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া বিক্রি হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক, প্যাথেডিন ও মরফিন ইনজেকশনসহ অনেক ধরনের ওষুধ। এর মধ্যে মাদকসেবীরা ফার্মেসি থেকে প্যাথেডিন ইনজেশনসহ স্নায়ুকে শিথিল করে দেয় এমন ওষুধ কিনে নিয়ে নেশা করছে। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়েটিকসহ নানা ধরনের ওষুধ সেবনের ফলে অনেকে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসহ নানা সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশেষ করে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের কোর্স সম্পন্ন না করার কারণে এর কার্যকারিতা নষ্ট হচ্ছে। ফলে ওই ব্যক্তি পরে জটিল কোনো রোগে আক্রান্ত হলে এন্টিবায়োটিক ওষুধ আর কাজ করছে না। সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, অ্যান্টিবায়েটিকের অপব্যবহারের ফলে বছরে মারা যাচ্ছে ৭০ হাজার মানুষ। এভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ সালে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ১০ লাখে।
ফার্মেসি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতে যে সংখ্যক জনবল ওষুধপ্রশাসন অধিদপ্তরের থাকা দরকার, তা নেই; অনুমোদিত পদ আছে ৩৭০টি। এর মধ্যে ৮৭টি পদ দীর্ঘদিন ধরে খালি। জনবল সংকটের কারণে দেশের সব ফার্মেসি মনিটরিং করতে পারে না অধিদপ্তর।
অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) মো. গোলাম কিবরিয়া বলেন, দেশের ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিজ অনেক এগিয়েছে। নতুন নতুন প্রোডাক্ট বাজারে আসছে। তাই কাজের পরিধিও ব্যাপক হারে বিস্তৃত হচ্ছে। সেই তুলনায় জনবল বাড়েনি। ফলে কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটছে।
তিনি জানান, জেলা পর্যায়ে অধিদপ্তরের মাত্র একজন করে কর্মকর্তা রয়েছেন। অথচ দেশের একেকটি উপজেলাতেই ফার্মেসি রয়েছে ৩০০ থেকে ৪০০। পুরো জেলার হিসাবে এ সংখ্যাটি দুই সহস্রাধিক। একজন কর্মকর্তার পক্ষে তা মনিটরিং করা অসম্ভব।
পরিচালক বলেন, সব মিলিয়ে আমাদের মোট পরির্দশক রয়েছেন ৬৭ জন (জেলা পর্যায়ে ৫৭ ও হেডকোয়ার্টারে ১০ জন)। এই অল্পসংখ্যক পরির্দশক দিয়ে সারা দেশের এত বিপুলসংখ্যক ফার্মেসি মনিটরিং করা সম্ভব নয়।
তিনি আরও বলেন, ফার্মেসি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে রাখতে ওষুধপ্রশাসন অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটলিয়ন (র্যাব) পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) যৌথ উদ্যোগে অভিযান চালিয়ে থাকে। অভিযানকালে কোটি কোটি টাকার আনরেজিস্টার্ড, ভেজাল, নকল ও নিম্নমানের ওষুধ জব্দ করা হয়। এর পরও ফার্মেসি মালিকদের অনৈতিক ব্যবসা বন্ধ হচ্ছে না।
অধিদপ্তরের আরেক পরিচালক মো. রুহুল আমিন জানান, আইন অনুযায়ী ওষুধ উপাদন, সংরক্ষণ, প্রদর্শন ও বিতরণের জন্য ড্রাগ লাইসেন্স থাকতে হবে। লাইসেন্স ব্যতীত ওষুধ বিক্রি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। লাইসেন্সবিহীন ফার্মেসি সিলগালা করে বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলা আছে। কিন্তু এই আইন অমান্য করে ড্রাগ লাইসেন্স ছাড়া ও ফার্মাসিস্ট ছাড়াই অনেকে ফার্মেসি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এসব ফার্মেসি দ্বারা মানুষ প্রতারিত হচ্ছে; বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি।
ফার্মেসি ব্যবসা নিয়ে করণীয় নির্ধারণে গত ১৮ অক্টোবর বৈঠকে বসেন ওষুধপ্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। সেখানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমও ছিলেন। বৈঠকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি ফার্মেসি বিভাগ, ওষুধ শিল্প সমিতির প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। বৈঠকে ফার্মেসি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণসহ ওষুধ প্রশাসনের কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা করতে জনবল সংকট সমাধান এবং অনুমোদনহীন ফার্মেসি উচ্ছেদের বিষয়টি আলোচনা হয়। এ সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী লাইসেন্সবিহীন ফার্মেসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। যেসব ফার্মেসির লাইসেন্স নেই, সেসব ফার্মেসিকে লাইসেন্স পেতে চার মাসের সময় বেঁধে দেন তিনি। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. আ. ব. ম ফারুক বলেন, দেশে ২১০টি মডেল ফার্মেসি চালু করা হয়েছে। এসব ফার্মেসি চালুর সময় ফার্মাসিস্ট নিয়োগ দেওয়া হলেও অনেকেই পরে ফার্মাসিস্ট বিদায় করে দিয়েছেন। কারণ ফার্মাসিস্টকে বেশি বেতন দিতে হয়। আবার অনেক ফার্মেসি সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত খোলা থাকে, একজন ফার্মাসিস্ট তো এত সময় ডিউটি করতে পারবেন না। ফার্মাসিস্ট না থাকায় রোগীদের কাউন্সেলিং হচ্ছে না। মডেল ফার্মেসিগুলোতে রোগীরা যেন ঠিকমতো কাউন্সেলিং পান সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এসব কার্যক্রম মনিটরিং করতে ওষুধপ্রশাসন অধিদপ্তরকে শক্তিশালী করা দরকার।
বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির সভাপতি মো. সাদেকুর রহমান বলেন, আনরেজিস্টার্ড, মেয়াদোত্তীর্ণ ও নকল ওষুধ বিক্রির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আমাদের বিভিন্ন কার্যক্রম অব্যাহত আছে। নকল, ভেজাল ও আনরেজিস্টার্ড ওষুধ জব্দ করার পর নষ্ট করে ফেলা হয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন