অধিকাংশের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা চিকিৎসা পেশা এখন জৌলুস হারাতে বসেছে। চিকিৎসা শাস্ত্রে পড়ার প্রতি যে আকর্ষণ লাখো শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের মধ্যে ছিল, অদূর ভবিষ্যতে সেটাও কেটে যাবে। স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের মতোই এমবিবিএস-বিডিএস ডিগ্রিধারীরাদের অনেককেও বেকার থাকতে হবে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণা প্রতিবেদন এমন তথ্যই জানাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, দেশে চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত চিকিৎসক তৈরি হচ্ছে। আর এই অতিরিক্ত চিকিৎসকই এক সময় স্বাস্থ্য খাতের বোঝায় পরিণত হবে। এমবিবিএস ও বিডিএস পাস করেও নিজ পেশায় কাজ মিলবে না। জীবিকার প্রয়োজনে তাদের অন্য পেশায় কাজ করতে হবে।
এ পরিস্থিতির জন্য চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা সরকারের পরিকল্পনার অভাব ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোকে দায়ী করেছেন। তাদের ভাষ্য- চিকিৎসকের সংখ্যা বৃদ্ধি এক সময় সুখবর মনে হলেও ভবিষ্যতে তা সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। যে পরিমাণ চিকিৎসক প্রতিবছর স্বাস্থ্য খাতে যুক্ত হচ্ছেন, সে তুলনায় কর্মক্ষেত্রের পরিধি বাড়ছে না। যে স্বল্পসংখ্যক চিকিৎসক সরকারি চাকরি থেকে অবসরে যাচ্ছেন, তারাও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। এতে নতুন চিকিৎসকদের কর্মক্ষেত্রে সুযোগ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
বিআইডিএসের গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালেই দেশে চাহিদার তুলনায় ১১ হাজার ৫২৯ জন চিকিৎসক উদ্বৃত্ত ছিলেন। ওই বছর দেশে ১৬ কোটি মানুষের বিপরীতে চিকিৎসকের চাহিদা ছিল ৬৩ হাজার ৩৯৫ জন। জোগান ছিল ৭৪ হাজার ৯২৪।
২০২১ সালে ৬৭ হাজার ২৬৫ চিকিৎসকের চাহিদার বিপরীতে জোগান দাঁড়াবে ১ লাখ ২০ হাজার ৬৬৭ জন। এ হিসাবে ২০২১ সালেই চিকিৎসকের উদ্বৃত্ত সংখ্যা দাঁড়াবে ৫৩ হাজার ৪০২ জন। ২০২৬ সালে ৭১ হাজার ৩৭০ জনের চাহিদার বিপরীতে চিকিৎসকের সংখ্যা দাঁড়াবে ১ লাখ ৯৪ হাজার ৩৩৫। উদ্বৃত্ত চিকিৎসকের সংখ্যা দাঁড়াবে ১ লাখ ২২ হাজার ৯৬৫ জনে।
দেশে বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বিশ্বব্যাংক নিরূপিত এক দশমিক শূন্য এক শতাংশ ধরে বিআইডিএস এই গবেষণা কর্মটি পরিচালনা করে। এতে প্রতি ২ হাজার ৫২২ জনের বিপরীতে একজন করে চিকিৎসক ধরা হয়েছে। ২০১৪ সালের হিসেবে ১০ শতাংশ হারে চিকিৎসক বৃদ্ধি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
বর্তমানে দেশের সরকারি-বেসরকারিভাবে ৯৯টি মেডিকেল কলেজে এবং ১৫টি ডেন্টাল কলেজ এবং ২১টি ডেন্টাল ইউনিট রয়েছে। এগুলোতে প্রতিবছর ১১ হাজার ৪৪২ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পায়।
এ ক্ষেত্রে সরকারের পরিকল্পনাহীনতাকে দায়ী করে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব সমকালকে বলেন, কতসংখ্যক চিকিৎসক প্রয়োজন আর কতসংখ্যক তৈরি করতে হবে- সে সম্পর্কে সরকারের সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই। এ কারণে এমবিবিএস ও বিডিএস পাস করা চিকিৎসকরা এক সময় গলার কাঁটায় পরিণত হবে। এ বিষয়ে সরকারকে জরুরিভিত্তিতে পরিকল্পনা করে রোডম্যাপ করতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশে মানহীন মেডিকেল কলেজ বন্ধ করে দেওয়ার নজির আছে। প্রয়োজনে সে ধরনের সিদ্ধান্তও নিতে হবে। অন্যথায় পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত চিকিৎসকের সংখ্যা ৯৩ হাজার ৭৬৩ জন। তাদের মধ্যে এমবিবিএস ৮৫ হাজার ৬৩৩ জন এবং বিডিএস (ডেন্টাল) ৮ হাজার ১৩০ জন। তবে কত চিকিৎসক অবসরে গেছেন, সে সম্পর্কিত কোনো হিসাব প্রতিষ্ঠানটির কাছে নেই। বর্তমানে প্রতি বছর নতুন করে আরও ১০ হাজারের বেশি চিকিৎসক স্বাস্থ্য খাতে যুক্ত হচ্ছেন। সে তুলনায় নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে না। এমনকি অবসরে যাচ্ছেন মাত্র দুই থেকে আড়াইশ' চিকিৎসক। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, প্রতি বছর গড়ে ৩ শতাংশ চিকিৎসক কর্মক্ষেত্র থেকে চলে যাচ্ছেন। তাদের মধ্যে কেউ অবসরে, কেউ স্বেচ্ছায়, আবার কেউ মৃত্যুবরণ করেন। অবসরে যাওয়া চিকিৎসকরা আবার বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। একইসঙ্গে চিকিৎসকদের বিদেশে চাকরির সুযোগও দিন দিন কমছে। এ কারণে নতুন চিকিৎসকদের কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হওয়ার সুযোগ কমবে। ২০১৬ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বিআইডিএসের গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশেও চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্য সহকারীদের বিদেশে কর্মক্ষেত্রের সুযোগ দিন দিন কমছে। ২০১০ সালে সর্বোচ্চ ৬৮ জন চিকিৎসক বিদেশে চাকরির সুযোগ পেয়েছিলেন। এরপর ২০১৩ সাল পর্যন্ত যথাক্রমে ২৯, ২২ ও ১২ চিকিৎসক বিদেশে চাকরির সুযোগ পেয়েছেন।
এ পরিস্থিতির মধ্যেও প্রতিবছরই মেডিকেল কলেজগুলোতে বিশেষ করে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে আসন বাড়ানো হচ্ছে। এবারও বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো আসন বাড়ানোর আবেদন করেছে। তাদের আবেদন বিবেচনায় নিয়ে ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করেছে। ওই কমিটির সুপারিশের আলোকে আসন বাড়ানো হবে। অভিযোগ আছে, আসনপ্রতি ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা ঘুষ লেনদেন হয়। এই লেনদেনের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও যুক্ত রয়েছেন। বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্নিষ্টরা।
অতিরিক্ত চিকিৎসকরা ভবিষ্যতে দেশের জন্য বোঝায় পরিণত হবেন বলে স্বীকার করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ সমকালকে বলেন, বর্তমানে দেশে যে পরিমাণ চিকিৎসক আছেন, তা চাহিদার তুলনায় কম। তবে প্রতিবছর যে পরিমাণ চিকিৎসক এমবিবিএস ও বিডিএস পাস করছেন, তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা দুরূহ হয়ে পড়বে। সে জন্য নতুন পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। বিদেশি শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশে আনার বিষয়ে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হবে। পড়াশোনা শেষ করে তারা দেশে ফিরে যাবেন। আবার বাংলাদেশের চিকিৎসকরা যাতে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা ও শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিতে পারেন, সরকার সে বিষয়েও উদ্যোগ নেবে। একই সঙ্গে মানহীন মেডিকেল কলেজের বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। প্রয়োজনে ওইসব মেডিকেল কলেজের কার্যক্রম স্থগিত করাও হতে পারে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চিকিৎসা, শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব ফয়েজ আহম্মেদ সমকালকে বলেন, মানহীন বেসরকারি ১২টি মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু আদালতের রায়ে ওইসব মেডিকেল কলেজ আবারও শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অস্বস্তিতে রয়েছে। ওইসব মেডিকেল কলেজের বিষয়ে আইনি লড়াই চালানো হবে।
তিনি বলেন, মেডিকেল শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে সরকার বদ্ধপরিকর। এ জন্য বেশকিছু পদক্ষেপ হাতে নেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে পাস করে বের হওয়া চিকিৎসকদের সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি কীভাবে বিদেশে বিভিন্নভাবে কাজে লাগানো যায়, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে বলেও জানান তিনি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন