গ্লুকোমা এক ধরনের চোখের উচ্চচাপজনিত রোগ। এ রোগ চোখের নীরব ঘাতক হিসেবেও পরিচিত। প্রতিবছর মার্চের ১৩ তারিখ থেকে ১৮ তারিখ পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে পালিত হয় ‘গ্লুকোমা সপ্তাহ’। দিবসটি পালনের উদ্দেশ্য, চোখের এই ভয়াবহ রোগ সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করা। চোখ, চোখের রোগ এবং এ থেকে দূরে থাকার উপায় নিয়ে কথা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) এবং কমিউনিটি অফথালমোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ-এর সঙ্গে। কথা বলেছেন সিনিয়র রিপোর্টার দুলাল হোসেন
আমাদের সময় : গ্লুকোমা কী?
অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ : গ্লুকোমা এক ধরনের চোখের উচ্চচাপজনিত রোগ। এটির আরেক নাম চোখের নীরব ঘাতক। চোখের হাই প্রেসারের নাম অকুলার হাইপার টেনশন। এ ক্ষেত্রে স্বাভাবিক চোখের চাপ ১১-২১ মি.মি. মার্কারির চেয়ে বেশি হলেই অকুলার-হাইপার টেনশন বলে। যদিও অপটিক স্নায়ু বা দৃষ্টি পরিধির (ভিজ্যুয়াল ফিল্ড) কোনো পরিবর্তন নাও হতে পারে। তবে যখনই অপটিক স্নায়ু বা ভিজ্যুয়াল ফিল্ডের ক্ষতি হয় এবং চোখের যদি হাই প্রেসার থাকে, তা হলে তার নামই গ্লুকোমা।
আমাদের সময় : এ রোগ হওয়ার কারণ কী?
অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ : চোখের অবস্থান ঠিক রাখতে সিলিয়ারি এপিথিয়াম থেকে যদি পানি জাতীয় প্রত্যক্ষ নিঃসরণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয় তা হলে এ রোগ হতে পারে। পরোক্ষ নিঃসরণ ২০ স্বাভাবিক। যদি কোনো কারণে (ওষুধের মাধ্যমে) এর চেয়ে কম হয়, তা হলে গ্লুকোমা হয়। যদি ট্রাবিকুলাম, কর্নিও স্কে¬রাল মেসওয়ার্ক, স্মেস ক্যানাল ইত্যাদি কোনো পথে প্রতিবন্ধকতা হয়, তা হলে গ্লুকোমা হয়।
আমাদের সময় : এ রোগ কাদের হতে পারে?
অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ : যে কোনো বয়সী মানুষের গ্লুকোমা হতে পারে। জন্মের সময় বেশ বড় চোখ এবং উচ্চ চক্ষুচাপ নিয়ে জন্ম গ্রহণ করলে একে বলে জন্মগত উচ্চ চক্ষুচাপ। তরুণ বয়সেও এ রোগ হতে পারে, যার নাম জুভেনাইল গ্লুকোমা। তবে বেশিরভাগ গ্লুকোমা রোগ ৪০ বছরের পর হয়। এটি গ্লুকোমার প্রাথমিক অবস্থা। এ ছাড়া পারিবারিকভাবে যাদের এ রোগ আছে, যারা মাইনাস পাওয়ার চশমা পরেন, যাদের ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ আছে, তাদেরও এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আরেকটি সেকেন্ডারি গ্লুকোমা, এটি সাধারণত এক চোখে হয়। আঘাতজনিত কারণে এবং ঘন ঘন চোখ লাল বা প্রদাহজনিত কারণেও গ্লুকোমা হতে পারে।
আমাদের সময় : এ রোগ হয়েছে কিনা, বোঝার বা জানার উপায় কী?
অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ : চোখের প্রেসার যন্ত্র টনোমিটার দিয়ে বোঝা যায়। ১১-২১ মি.মি.-এর বেশি হলে গ্লুকোমা অফথালমোসকোপ দিয়ে অপটিক স্নায়ুর পরিবর্তন হয়েছে কিনা, দেখা। দৃষ্টি পরিধি বা ভিজ্যুয়াল ফিল্ড দেখার যন্ত্র পেরিমিটার/এনালাইসার (হামফ্রে বা অক্টোপাস দিয়ে)। চোখের কোণ সরু কিনা, দেখে বোঝা যায় চোখ গ্লুকোমায় আক্রান্ত কিনা। নির্দিষ্ট করে বললেÑ
শিশুর গ্লুকোমা আছে কিনা, তা জানতে শিশুর চোখের কিছু বিষয় খেয়াল করতে হবে। যেমনÑ বড় বড় চোখ, সাদা কর্নিয়া, চোখ দিয়ে সারাক্ষণ পানি পড়া এবং আলোর দিকে তাকাতে না পারা, চোখের অস্বাভাবিক নড়াচড়া ইত্যাদি। এ লক্ষণগুলো দেখতে পেলে দ্রুত চক্ষুরোগের ডাক্তারকে চোখ দেখাতে হবে।
বড়দের ক্ষেত্রে গ্লুকোমার উপসর্গ চেনা একটু কষ্টকর। অনেক ক্ষেত্রেই রোগী এ রোগের কোনো লক্ষণ ধরতে পারে না। চশমা পরিবর্তনের সময় কিংবা চোখ পরীক্ষার সময় হঠাৎ করে চিকিৎসক এ রোগ নির্ণয় করে থাকেন। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে যে লক্ষণগুলো প্রকাশ পায় তা হলোÑ হঠাৎ চোখে প্রচ- ব্যথা হয়ে দৃষ্টিশক্তি কমে যায়। একই সঙ্গে প্রচ- মাথাব্যথা ও বমি বমি ভাব থাকে। সব সময় চোখ ও মাথায় হালকা ব্যথা থাকা এবং ক্রমে দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া। ব্যথা ছাড়াই উভয় চোখের দৃষ্টিশক্তি ক্রমে কমে যাওয়া। মাঝে মধ্যে দৃষ্টি সীমানার যে কোনো একপাশে অদৃশ্য হয়ে যায়। ঘন ঘন চশমার পাওয়ার পরিবর্তন হওয়া। মৃদু আলোয় কাজ করলে চোখে ব্যথা অনুভূত হওয়া। চোখে ঝাপসা দেখা বা আলোর চারপাশে রংধনুর মতো দেখা।
আমাদের সময় : চোখের উচ্চচাপ কত ধরনের হয়ে থাকে?
অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ : দুধরনের হয়ে থাকে। এর একটি জন্মগত অর্থাৎ গ্লুকোমা বা বুথথালমোস। আরেকটি হলোÑ একোয়ার্ড বা জন্ম-পরবর্তী সংশ্লিষ্টতা। এর মধ্যেÑ
প্রাইমারি : চোখের কোণ ছোট হওয়া। কোণ থাকা সিম্পল গ্লুকোমা বা ক্রনিক গ্লুকোমা।
সেকেন্ডারি : চোখের অন্য রোগের কারণে ইউভিয়াইটিস, কর্নিয়ায় ক্ষত, চোখের টিউমার, ভিট্রাসে বা অ্যাসিতে রক্ত জমা, ছানি রোগের অপারেশন না করা ইত্যাদি।
আমাদের সময় : এ রোগের চিকিৎসা কী?
অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ : চোখের ওষুধ (অবশ্যই চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শমতো), যেমনÑ পাইলো ড্রপ, টিমো ড্রপ, ল্যাটোনো প্রস্ট, প্রস্টাগামিন, আলফাগান, বেটাগান; খাওয়ার বড়ি, যেমনÑ এসিমক্স, ইলেকট্রো-কে; ট্রাবিকুলোপ্লাস্টি অর্থাৎ লেজার; অস্ত্রপাচার, অর্থাৎ আইরিসে ছিদ্র করা, ট্রাবিকুলেক্টমি/ট্রাবিকুলেক্টটিম, সিজ বা ফিল্টারিং অপারেশন ইত্যাদি। সেকেন্ডারি গ্লুকোমার কারণগুলো দূর করা। যেমনÑ ছানি রোগ দীর্ঘদিন অপারেশন না করালে, ছানি অপারেশনের পরে ইউভিয়াটিস বা কর্নিয়ার ক্ষত চিকিৎসা ইত্যাদি।
সবাইকে চোখের এ জটিল রোগ সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে এবং রোগ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, গ্লুকোমা অত্যন্ত জটিল একটি রোগ। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী অসংখ্য মানুষ অন্ধত্ব বরণ করে। কাজেই সবাইকে এ রোগের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানতে হবে এবং অন্যকে জানাতে হবে।
আমাদের সময় : আপনাকে ধন্যবাদ।
অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ : আপনাকেও ধন্যবাদ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন