‘আমার স্বাক্ষর জাল করে নার্স নিয়োগ পরীক্ষায় ব্যবহার করেছেন ভিসি। শুধু তা-ই নয়, আমার স্বাক্ষর জাল করে ও আমার অগোচরে আমার দপ্তরের কাগজ ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারনেটের কাজে ব্যবহৃত প্রায় ৫ কোটি টাকার মালামাল ক্রয় প্রক্রিয়া শুরু করেন ভিসি।
এর মাধ্যমে তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ লোপাটের অপচেষ্টা করেছিলেন। যখনই আমি এসব বুঝতে পেরে কথা বলতে শুরু করি, তখনই ভিসি ও তার গ্রুপের রোষানলে পড়তে হয় আমাকে। ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহৃত রেডিওথেরাপির মেশিন ক্রয়ের মাধ্যমেও ভিসি ৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অপচেষ্টা করেছিলেন’।
বৃহস্পতিবার সকাল ৯টার দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) এর প্রো-ভিসি (শিক্ষা) ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ক্রয় কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এএসএম জাকারিয়া স্বপন, নিজ কার্যালয়ে আমাদের সময় ডটকমের কাছে এসব অভিযোগ করেন।
তিনি বলেন, প্রো-ভিসি (শিক্ষা) হিসেবে আমি এই চেয়ারের জন্য, এটা অর্ডার হয় ২০১৬ সালের ২১ এপ্রিল। আমি এই চেয়ারে বসে অফিস করা শুরু করি ২৩ এপ্রিল। ২৬ এপ্রিল আমার দপ্তর থেকে ওই ৫ কোটি টাকার মালামাল ক্রয়ের জন্য দরপত্র মূল্যায়ন প্রতিবেদন ও চুক্তি প্রদানের সুপারিশ যায় ভিসির কাছে। অথচ এটা আমি জানিই না। এ কাজের ওয়ার্ক অর্ডার হয় ২০১৬ সালেরই ১৫ মে। তখন আমি জানতে পারি যে, এই টেন্ডার নিয়ে যা করা হচ্ছে, সব আমার অগোচরে। আমার নাম, সাক্ষরসহ আমার দপ্তরের সবকিছু জাল করে ব্যবহার করা হয়েছে।
আরও জানলাম, এক্সপ্রেস সিস্টেমস লিমিটেড নামের যে প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হচ্ছিল, সে প্রতিষ্ঠান ভিসির আত্মীয়, এখানে ভিসির আর্থিক স্বার্থ আছে। এই দরপত্রে অংশগ্রহণকারী হিসেবে এক্সপ্রেস সিস্টেমস লিমিটেড তৃতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা। এটা জানার পর আমি দরপত্র প্রক্রিয়ার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি জোরালোভাবে। কেননা, এটা পিপিআর বিরোধী। আমি ভিসিকে বলি, দরপত্র প্রক্রিয়ায় যে যে অনিয়ম হয়েছে, তা নিয়ে একটি তদন্ত করে দোষীকে খুঁজে বের করা হোক। কিন্তু ভিসি তা করেননি। টানা দুই মাস ভিসি আমাকে চাপাচাপি করেছে এই কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য।
বৃহস্পতিবার একটি জাতীয় দৈনিকে বিএসএমএমইউ নিয়ে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে- একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে লিনিয়ার অ্যাক্সেলেটর মেশিনের সর্বাধুনিক মডেলের পরিবর্তে পুরনো মডেলের মেশিন ক্রয়ের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। মেশিনের দামও আন্তর্জাতিক মূল্যের তুলনায় পাঁচ কোটি টাকা বেশি। ওই মেশিন ক্রয় কমিটির প্রধান ছিলেন উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. এ এস এম জাকারিয়া। অভিযোগ রয়েছে, ডা. জাকারিয়া পুরনো মডেলের ওই মেশিন ক্রয়ের পক্ষে ছিলেন।
এ প্রসঙ্গে জাকারিয়া স্বপন আমাদের সময় ডটকমকে বলেন, ক্রয়ের পক্ষে থাকব দূরের কথা, সুপারিশ করার ক্ষমতা থাকা স্বত্বেও সুপারিশটাই করলাম না। আমি বলেছি, রেডিওথেরাপির সবচেয়ে পাওয়ার ফুল মেশিন আনতে হবে এই ইউনিভার্সিটিতে। তিন এনার্জির মেশিন। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ক্রয় কমিটিসহ এই মেশিন ক্রয় প্রক্রিয়ায় সাতটি কমিটি জড়িত। কমিটির সদস্যরা দেশ বরেণ্য ক্যান্সার চিকিৎসক, কেনাকাটায় অভিজ্ঞ, বিএসএমএমইউ’র বাইরেরও কিছু ব্যক্তি আছেন এসব কমিটিতে। গত ২৩ মার্চ এই মেশিন ক্রয়ের মূল নথি আমার দপ্তরে আসে। ২৮ মার্চ কেন্দ্রীয় ক্রয় কমিটি সব সদস্যদের নিয়ে মেশিন ক্রয়ের বিষয়ে বৈঠক করা হয়। গত ৫এপ্রিল দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির প্রতিবেদন ও পরবর্তী সিদ্ধান্তের জন্য নথি অগ্রবর্তী করা হয় ভিসির কাছে। অগ্রবর্তী করেছি, সুপারিশ বা চাপাচাপি বা নিতেই হবে- এমন কিছু নয়। আমি তো সিদ্ধান্ত নেয়া বা দেয়ার ক্ষমতা রাখি না।
বৃহস্পতিবার জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরে ভিসি কামরুল হাসানকে উদ্ধৃত করে বলা হয়- ওই মেশিন ক্রয়ে অনিয়মের ষড়যন্ত্র আঁচ করতে পেরে তা স্থগিত করা হয়েছে। পাঁচ কোটি টাকা বাঁচিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জাকারিয়া স্বপন বলেন, এই মেশিন ক্রয়ে কামরুল হাসান খান পূর্ববর্তী প্রশাসন ২২ কোটি টাকা প্রাক্কলন করে। এটা কামরুল হাসান খান অনুমোদন দেন। আমি তো টাকার অনুমোদন দেইনি। সে ক্ষমতাই তো আমার নেই। তাহলে তিনি কীভাবে বলেন, পাঁচ কোটি টাকা বাঁচিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি ২২ কোটি টাকার অনুমোদন দিয়ে ৫ কোটি টাকা বাঁচালেন? ভিসিই তো সেই পাঁচ কোটি টাকা আত্মসাৎ করতে চেয়েছিলেন।
জাকারিয়া স্বপন বেশ জোর দিয়ে বলেন, জুডিশিয়াল ইনকোয়েরি বা সিআইডি দিয়ে এই অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্ত করলে তা অবশ্যই প্রমাণ হবে।
নার্স নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে তিনি বলেন, বিএসএমএমইউর নিয়োগ, পদোন্নতি, পদন্নোয়ন নীতিমালা অনুযায়ী নার্স নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়নি। কোনো কোনো বোর্ড গঠন করা হয়নি। এটা না করেই লিখিত পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়েছে, তখন আমি দেশের বাইরে। মৌখিক পরীক্ষাও গ্রহণ করা হলো। প্রথম দিনের মৌখিক পরীক্ষায় ভিসি আমাকে মোবাইলে কল করে ডেকে নেন। লিখিত পরীক্ষায় যেসব প্রশ্ন দেয়া হয়, সেসব প্রশ্ন থেকে আমি পরীক্ষার্থীদের প্রশ্ন করি, একটা প্রশ্নের উত্তরও লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণরা দিতে পারেননি। পরীক্ষা গ্রহণে অনিয়ম বুঝতে পেরে আমি দুইদিন মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে বাকি ছয়দিন যাইনি। কিন্তু আমার সাক্ষর জাল করে আমাকে মৌখিক পরীক্ষায় উপস্থিত দেখানো হয়েছে ওই ৬দিন।
জাকারিয়া স্বপন বলেন, এই অনিয়ম নিয়ে গণমাধ্যমগুলো সরব হবার পর ভিসি বৈঠক ডাকেন, কী করা যায় তা নিয়ে। সেখানে আমাকে শারিরীক-মানসিকভাবে লাঞ্ছিত করেন ভিসি ও প্রক্টর। এটা নিয়ে তদন্ত করা হয়। কিন্তু তদন্তে সত্য গোপন করা হয়েছে। এজন্য আমি এখনও শঙ্কিত আমার নিরাপত্তা নিয়ে। এটা পুর্নতদন্ত করা জরুরি। আমার নিরাপত্তার বিষয়ে আমি আইনগত পথে যাব, এছাড়া উপায় নেই।আস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন