ছাত্রলীগ নেতা আবু সাদাত খান মোশাররফ হত্যাকাণ্ডের দুই বছর পর আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে ভিসিবিহীন টাঙ্গাইলের মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। লোডশেডিংয়ের অজুহাতকে পুঁজি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরসহ শিক্ষকদের ওপর হামলা, গাড়ি ভাঙচুর এমনকি তাদের সেহরি খাবার লুট করেছে ছাত্রলীগ নামধারীরা। ৩৪৫ কোটি টাকার প্রকল্প থেকে চাঁদাবাজির উদ্দেশ্যেই তারা এমনটি করেছে বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, গত ৫ জুন রাত দশটার দিকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের দাবিতে বিশ^বিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হল থেকে মিছিল বের করে প্রশাসনিক ভবনের সামনে এসে বিক্ষোভ করা হয়। এ সময় বিক্ষোভকারীরা শিক্ষকদের একটি গাড়ি ভাঙচুর করে। পরে বিশ^বিদ্যালয়ের অতিথি ভবনের সামনে জড়ো হলে প্রক্টর ড. সিরাজুল ইসলাম বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে পরের দিন মানববন্ধন করার আহ্বান জানান। কিন্তু আন্দোলনকারীরা তাৎক্ষণিক বিদ্যুৎ অফিস ঘেরাওয়ের জন্য দুটি বাসের দাবি জানায়। এ সময় পরিবহন পরিচালক আজিজুল হক রাতের বেলা বাস দিতে অস্বীকৃতি জানালেও তারা জোর করে বাস নিয়ে যান। রাত সাড়ে এগারোটার দিকে তারা বিদ্যুৎ অফিস ঘেরাওয়ের উদ্দেশ্যে শহরের বেবিস্ট্যান্ড এলাকায় গেলে পুলিশি বাধার সম্মুখীন হয়। এরপর বিক্ষুব্ধরা বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফিরে এসে বিশ^বিদ্যালয়ের প্রধান ফটক, দ্বিতীয় ফটক ও প্রশাসনিক ভবনে তালা লাগিয়ে দেয়। এ সুযোগে ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী অতিথি ভবনে শিক্ষকদের ওপর হামলা, লুটপাট এবং শিক্ষকদের একটি গাড়ি ভাঙচুর করে।
এদিকে ঘটনার প্রতিবাদ এবং ভিসি নিয়োগের দাবিতে শিক্ষকরা অনির্দিষ্টকালের ক্লাস বর্জন করে আসছেন। ছাত্রলীগের ত্রাসের রাজনীতির কারণে ঈদের ছুটি ও অনির্দিষ্টকালের ক্লাস বর্জনে ভোগান্তিতে পড়েছেন সাড়ে ৫ হাজার সাধারণ শিক্ষার্থী।
বিশ^বিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. সিরাজুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, প্রচ- গরম ও খেলার সময় লোডশেডিং আমাদেরও কাম্য নয়। কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে ঢুকে কিছু দুষ্কৃতকারী দীর্ঘদিন ধরে শান্ত থাকা ক্যাম্পাসকে হঠাৎ করে উত্তপ্তের চেষ্টা করছে। এ জন্য শিক্ষকরা একদিকে কর্মসূচি পালন করছেন; অন্যদিকে ক্যাম্পাস শান্ত রাখার জন্য সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ‘মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শক্তিশালীকরণ প্রকল্প’ নামে গতবছর ৩৪৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকার একটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদন হয়। জমি অধিগ্রহণ করে ক্যাম্পাস সম্প্রসারণ ও নতুন করে ভবন নির্মাণের জন্য ওই অর্থ বরাদ্দ অনুমোদন পায় টাঙ্গাইলের সন্তোষ এলাকার বিশ্ববিদ্যালয়টি। ইতোমধ্যে ৩ বছর মেয়াদি ওই প্রকল্পের ১১ মাস শেষ হয়ে গেছে। আগামী দুই বছরে প্রকল্পের অর্থ ব্যবহার না হলে ফিরে যাবে। এই সময়ের মধ্যে ছাত্রলীগ পরিচয়ধারীরা চায় তাদের কমিটি হোক। কমিটি হলে তারা প্রকল্প থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদাবাজির সুযোগ পাবে। এ জন্য ক্যাম্পাসের লোডশেডিংয়ের অজুহাত তুলে তারা ভাঙচুর চালিয়েছে এবং শিক্ষকদের ওপর হামলা করেছে। কিন্তু ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয় সম্পূর্ণ রাজনীতি ও ধূমপানমুক্ত ক্যাম্পাস। ছাত্রলীগের কেন্দ্র থেকে সবকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি গঠনের ঘোষণা দেওয়ার পর এ ক্যাম্পাসে কতিপয় ছাত্র পদ-পদবি পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। তাদের পরিকল্পনা ছাত্রলীগের কমিটি হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরসহ অন্যান্য শিক্ষকদের কব্জায় ফেলে কোটি কোটি টাকার উন্নয়ন ও অধিগ্রহণ কাজ বাগিয়ে নিতে পারবেন। এ জন্য হঠাৎ করে ছাত্রলীগ নেতাকর্র্মীরা সরব হয়ে উঠেছেন।
জানা গেছে, গত ৩ মে সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আলাউদ্দিনের চার বছরের চুক্তিভিত্তিক চাকরির মেয়াদ শেষ হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে প্রো-ভিসি ও ট্রেজারের পদ দুটিও শূন্য। সুতরাং ভিসি প্রো-ভিসি নিয়োগ না হলে প্রকল্পের কাজ থেমে যাবে এবং প্রকল্পের অর্থ ফেরত যাবে। আর প্রকল্প থেকে ছাত্রলীগ মোটা অঙ্কের চাঁদাবাজি করতে পারবে না।
অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষকদের ওপর হামলা, আবাসিক হলে সিট দখলসহ এসব ত্রাসের রাজত্বে সজীব তালুকদার ও তাছেকুল আলম তুষার নামে ছাত্রলীগ নামধারী দুটি গ্রুপের প্রভাব রয়েছে।
পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক বলেন, গরম ও খেলার লোডশেডিং আমাদেরও কাম্য নয়। কিন্তু গভীর রাতে হামলা ও লুটপাট হয়েছে। সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আবু সাদাত খান মোশাররফ হত্যাকা-ের দুই বছর পর ক্যাম্পাসে নতুন করে সংঘাত সৃষ্টি করা হচ্ছে। সজীব তালুকদার ও তাছেকুল আলম তুষারের নেতৃত্বে অতিথি ভবনে শিক্ষকদের ওপর হামলা ও লুটপাট চালায় ছাত্রলীগ নামধারী কিছু শিক্ষার্থী। শিক্ষকদের ওপর হামলা ক্যাম্পাস উদ্বোধনের পর এই প্রথম।
টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার মাহবুব আলম আমাদের সময়কে বলেন, ভিসি না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। দলের নাম ভাঙ্গিয়ে একটি চক্র অস্থিরতা সৃষ্টির চক্রান্ত করছে। আমরা সতর্ক আছি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সহায়তা চাওয়া মাত্র নিরাপত্তা দিচ্ছি।
২০১৫ সালের ১৩ মে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাদাত খান মোশাররফকে কুপিয়ে জখম করা হয়। এরপর ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দলবল নিয়ে হামলাকারীরা ক্যাম্পাস ত্যাগ করে। ওই ঘটনার পর দীর্ঘ দুই বছর ধরে অনেকটা শান্ত ছিল সবুজে ঘেরা ওই ক্যাম্পাস।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন