ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাম শুনলেই চোখে ভাসে কঠোর পরিশ্রম আর সাধনায় চান্স পাওয়া কিছু শিক্ষার্থীর মুখ। দেশের শ্রেষ্ঠ এ বিদ্যাপীঠে চান্স পেতে যেমন দরকার এসএসসি ও এইচএসসিতে ভালো ফল, ঠিক তেমনি দরকার হয় ভর্তি পরীক্ষায় চমকপ্রদ পারফরমেন্স। প্রতিবছর এখানে ভর্তি হওয়ার জন্য আবেদন করে লাখ লাখ শিক্ষার্থী। মুষ্টিমেয় কিছু শিক্ষার্থীই কেবল পাস নম্বর তুলতে পারে। কখনো কখনো এ পাসের হার হয় মাত্র দুই থেকে তিন ভাগ; কিন্তু সেই ক্যাম্পাসেই নামেমাত্র রেজাল্ট নিয়ে পাস করেও ভর্তি হওয়া যায় সান্ধ্যকালীন কোর্সে। মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে সহজে সার্টিফিকেট পেতে শিক্ষার্থীরাও ভিড় জমাচ্ছে এই কোর্সগুলোয়। আর শিক্ষকরাও নিয়মিত শিক্ষার্থীদের ক্লাস-পরীক্ষা ও ফলে ঢিলেমি করলেও সান্ধ্যকালীন ক্ষেত্রে আগ্রহটা অনেক বেশি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ২০ থেকে পঁচিশটি বিভাগে চালু রয়েছে সান্ধ্যকালীন কোর্স। চালুর জন্য প্রচেষ্টায় রয়েছে আরও বেশ কয়েকটি বিভাগ। বলতে গেলে পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন নিয়মিত শিক্ষার্থীদের চেয়ে সান্ধ্যকালীন শিক্ষার্থীদের দাপট। শিক্ষকরাও অনেকটা দায়িত্বশীল এ সান্ধ্যকালীন শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে। নিয়মিত শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে নিয়মিত ক্লাস না নিলেও সান্ধ্যকালীনের ক্ষেত্রে প্রত্যেক শিক্ষকই নিয়মিত। এ ছাড়া নিয়মিত শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে ফল প্রকাশে গড়িমসি দেখা যায়। কখনো এই ফল প্রকাশের জন্য অপেক্ষা করতে হয় এক বছর পর্যন্তও; কিন্তু সান্ধ্যকালীন কোনো কোনো কোর্সে বছরে তিনবার ভর্তি করা হয় শিক্ষার্থীদের। এ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন যেমন প্রবীণ শিক্ষকরা, ঠিক তেমনি সবসময়ই প্রতিবাদে সরব ছিলেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা; কিন্তু প্রশাসনের এসবের দিকে কর্ণপাত নেই। তারা এরপরেও নতুন নতুন বিভাগে সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু করে অর্থের দিকেই ঝুঁকছে। যদিও শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময় এসব সান্ধ্যকালীন কোর্সের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও প্রতিবাদ করেছেন। বেশ কয়েকটি বিভাগে এসব আন্দোলনের কারণে সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু করতে ব্যার্থ হয় কর্তৃপক্ষ।
সান্ধ্যকালীন কোর্সের ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ। বছরে কেবল একবার নয়, প্রতিবছর মার্চ, জুলাই, নভেম্বরÑ এই তিন সেশনে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয় এই অনুষদে। ভর্তি পরীক্ষার স্বচ্ছতা নিয়েও বিভিন্ন সময় প্রশ্ন উঠেছে। এ ছাড়া ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট (আইবিএ) পেশাজীবীদের জন্য এক বছরের এক্সিকিউটিভ এমবিএ, অ্যাকাউন্টিং ও ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগে দুই বছর মেয়াদি মাস্টার্স অব প্রফেশনাল অ্যাকাউন্টিং (এমপিএ) কোর্সেও ভর্তি করা হয়। পপুলেশন সায়েন্স বিভাগে দুই বছর মেয়াদি মাস্টার্স অব পপুলেশন সায়েন্স প্রোগ্রাম, তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগে দুই বছর মেয়াদি ইভিনিং, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) এক বছর/দুই বছর মেয়াদি সান্ধ্যকালীন এমএড, সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ইভিনিং মাস্টার্স প্রোগ্রাম, ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের মাস্টার্স অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধীনে মাস্টার্স ইন গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (এমজিএস), অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধীনে দুই বছর মেয়াদি মাস্টার্স কোর্স। টেলিভিশন ও ফিল্ম স্টাডিজ বিভাগে মাস্টার্স অব সোশ্যাল সায়েন্স ইন টেলিভিশন অ্যান্ড ফিল্ম স্টাডিজ, কমিউনিকেশন ডিসঅর্ডার বিভাগে দুই বছরের প্রোফেশনাল এমএসএস ইন স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিতে (পিএমএসএলটি) ভর্তি করা হয়।
ইনস্টিটিউট অব এনার্জিতে এমএস ইন রিনিউয়েবল এনার্জি টেকনোলজি, ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজিতে (আইআইটি)। একই ইনস্টিটিউট থেকে মাস্টার্স অব সায়েন্স ইন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে তিন সেমিস্টারের মাস্টার্স কোর্সে ভর্তি করা হয়। বায়োমেডিক্যাল ফিজিকস অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগেও চালু রয়েছে মাস্টার্স কোর্স। সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে রয়েছে এমএস ইন ওশানোগ্রাফি ডিগ্রি। এছাড়াও রয়েছে মাস্টার্স ইন জাপানিস স্টাডিস সেন্টারে মাস্টার্স প্রোগ্রাম। এর বাইরে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের অধীনে বেশ কয়েকটি ভাষা শিক্ষার কোর্স রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছেÑ মানসম্মত শিক্ষা না দিয়েই অর্থের বিনিময়ে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে ডিগ্রির সার্টিফিকেট। ফলে শিক্ষার বাণিজ্যিক কার্যক্রমে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ক্রমেই সান্ধ্যকালীন কোর্সে আসক্ত হয়ে পড়ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে সান্ধ্যকালীন কোর্সের মান নিয়ে কড়া সমালোচনা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্যরা। সান্ধ্য কোর্সের মাধ্যমে শুধু ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল ও অর্থলাভের আশায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অসংখ্য নিম্নমানের গ্র্যাজুয়েট তৈরি করছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের সর্বশেষ অনুষ্ঠেয় অধিবেশনে সান্ধ্যকালীন কোর্সের বিষয়ে ব্যাপক সমালোচনা করেন সিনেট সদস্যরা। এ সময় সান্ধ্যকালীন কোর্সগুলোর বিষয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দীন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) বাণিজ্যিকভাবে চালু হওয়া সান্ধ্যকালীন কোর্সে নিম্নমানের গ্র্যাজুয়েট তৈরির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদাহানি ঘটছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। এ সময় তিনি বলেন, আমাদের এ প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৭৩ অধ্যাদেশের সুযোগ নিয়ে কিছু ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক, কম মেধাসম্পন্ন শিক্ষক একাডেমিক লিডার বনে যাচ্ছেন। তারাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবসাকেন্দ্রে পরিণত করে ব্যক্তিগতভাবে ব্যাপক অর্থ আয় করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাওনাটুকুও যথাযথ দিচ্ছেন না। ব্যয়ের ক্ষেত্রেও তারা সরকারি বিধিবিধান মানছেন না। এ প্রবণতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাকি ৯৫ ভাগ শিক্ষক, কর্মকর্তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং নিম্নমানের ব্যাপক গ্র্যাজুয়েট তৈরির কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদাহানি ঘটছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম রক্ষায় এ ব্যাধি সংক্রামিত হওয়ার আগে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হচ্ছে জ্ঞান সৃষ্টি ও বিতরণ। অর্থবিহীন নামে-বেনামে অসংখ্য সান্ধ্যকালীন মাস্টার্স প্রোগ্রাম খোলা, কখনো কখনো নামমাত্র বা ভর্তি পরীক্ষা ছাড়া নিম্নমানের ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করা হচ্ছে। তবে আশার বিষয় হচ্ছেÑ কয়েকটি মাত্র ইনস্টিটিউট এবং বিভাগ এ ধরনের শিক্ষা-বাণিজ্যে জড়িত, যা আমাদের মোট বিভাগের ১০ ভাগের বেশি নয়। তবে এ ব্যাধি সংক্রমিত হচ্ছে।
এদিকে সান্ধ্যকালীন কোর্সে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা কোর্স ভেদে ৭০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেন। তবে তাদের বিপুল ব্যয়ে শিক্ষা অর্জন হয় সামান্যই। কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো সংবলিত সার্টিফিকেটই অর্জন বলে মত দেন অনেক শিক্ষার্থী।
সান্ধ্য কোর্সের নিয়ম অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট বিভাগের শিক্ষকরাই এই কোর্স পরিচালনা করেন। ফলে ক্লাসে ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা থাকে। সান্ধ্যকালীন কয়েক শিক্ষার্থী অভিযোগ করেন, চার ঘণ্টা বা তিন ঘণ্টা ক্লাস নেওয়ার কথা থাকলেও এক থেকে দেড় ঘণ্টা ক্লাস নেন শিক্ষকরা। অনেক সময় সিলেবাস শেষ করতে না পারলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক তার মতো করেই পরীক্ষার প্রশ্ন করেন। এতে করে ভালো রেজাল্টসহ সার্টিফিকেট পেলেও গুণগত শিক্ষা অর্জন হয় না।
ইভিনিং এমবিএর শিক্ষার্থী ইফফাত আরা রাইন আমাদের সময়কে বলেন, একটি সার্টিফিকেটই পাওয়া যায় সান্ধ্যকালীন কোর্সে। স্যারদের ইচ্ছেমতো ক্লাস-পরীক্ষা। ফলে তাদের মতোই নম্বর দেন। তিনি বলেন, টাকা দিয়ে পড়াশোনা করছি। তাই নম্বর দিতে কার্পণ্য করেন না শিক্ষকরা; কিন্তু আমরা কী শিখলাম সেটাই প্রশ্ন।
এ বিষয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, আমরা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের মান বৃদ্ধির দিকে নজর দিচ্ছি। বৈশ্বিক মানদ-ে আরও শক্ত অবস্থান নিতে চাই। সান্ধ্যকালীন কোর্সগুলো নিয়ে এখনো চিন্তাভাবনা করা হয়নি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান ক্ষুণœ হয়, এমন কোনো কিছুই থাকবে না। সবকিছুই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে বলে মত দেন তিনি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন