রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) এবং রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে (রুয়েট) ঘিরে গড়ে উঠা ইয়াবা ব্যবসা চক্রের ৪৪ জনকে শনাক্ত করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের মাদক অধিশাখা। যা প্রধানমন্ত্রীর দফতর হয়ে চলতি মাসের শুরুতে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের দফতরে পৌঁছেছে। একই কপি রাবি ও রুয়েট কর্তৃপক্ষকেও পাঠানো হয়েছে। ওই তালিকায় রয়েছেন রাবির ছয় শিক্ষক, আট কর্মকর্তা-কর্মচারী, ১১ জন ছাত্রলীগ নেতা, তিনজন সাবেক ছাত্রদল নেতা ও ছয়জন সাধারণ শিক্ষার্থী।
.
অপরদিকে, রাবির পার্শ্ববর্তী রুয়েটের এক শিক্ষক, দুই ছাত্রী, সাতজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম উঠে এসেছে গোপন ওই তালিকায়। এ ছাড়া রাজশাহী অঞ্চলভুক্ত পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পাবিপ্রবি) চারজন কর্মকর্তার নামও ইয়াবা চক্রের তালিকায় উঠে এসেছে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে যাচাই-বাছাই শেষে ওই তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। যার সঙ্গে পাঁচটি মন্তব্য ও চক্র নিয়ন্ত্রণে চারটি সুপারিশ জুড়ে দেয়া হয়েছে। ওই প্রতিবেদন ও তালিকার কপি এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।
তালিকাভুক্ত ছয় শিক্ষক হলেন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সেলিম রেজা নিউটন, ড. মুসতাক আহমেদ, আইবিএ’র সহযোগী অধ্যাপক মোহা. হাছানাত আলী, লোক প্রশাসন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক স্বপ্নীল রহমান, মৃৎশিল্প ও ভাস্কর্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. আব্দুস সালাম, চিত্রকলা প্রাচ্যকলা ও ছাপচিত্র বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. আমিরুল ইসলাম।
তালিকভুক্ত রাবি ছাত্রলীগের ১১ নেতা হলেন, আখতারুল ইসলাম আসিফ (ক্রপ সায়েন্স বিভাগ), আবু খায়ের মোস্তফা রিনেট (ম্যানেজমেন্ট বিভাগ), তাওশিক তাজ (বাংলা বিভাগ), রবিউল আউয়াল মিল্টন (দর্শন বিভাগ), এরশাদুর রহমান রিফাত (মাস্টার্স, ফিন্যান্স বিভাগ), সাইফুল ইসলাম বিজয় (আইন বিভাগ) শরিফুল ইসলাম সাদ্দাম (ড্রপ আউট, লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ), অনিক মাহমদু বনি (রাষ্ট্রবিজ্ঞান), এস এম আবু হানজালা (ফোকলোর), মুশফিক তাহমিদ তন্ময় (ফোকলোর) ও রেজওয়ানুল হক হৃদয়।
প্রতিবেদনে ইয়াবা চক্র প্রসঙ্গে বলা হয়, ‘সম্প্রতি ক্যাম্পাসে গুটি কয়েক শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মচারী, বহিরাগত ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অসৎ সদস্য এবং ভাসমান দোকানপাটের অসৎ ব্যবসায়ীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আবাসিক হল এবং ক্যাম্পাসে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক সরবারহে সহযোগিতা করছে। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাদক গ্রহণের প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। তারা পড়ালেখায় আগ্রহ হারাচ্ছে এবং অনেকে অকালে তাদের শিক্ষাজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে অসামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। এতে একদিকে যেমন মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীর অভাব অনুভূত হচ্ছে, অপরদিকে জাতি মেধাশূন্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া মাদকাসক্ত এসব ছাত্র-ছাত্রী মাদকের অর্থের যোগান দিতে গিয়ে পড়ালেখা থেকে বিচ্যুত হয়ে ক্যাম্পাস ও ক্যাম্পাসের বাইরে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও দখলবাজি করে সামাজিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করছে।’
যদিও গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সেলিম রেজা নিউটন বলেন, ‘আজকে উছিলা মাদক, কাল হয়তো অন্য কিছু হবে। মুক্ত ক্যাম্পাসকে নষ্ট করে কোনো মঙ্গলের দিকে আমরা যেতে পারব না। ব্যক্তিগতভাবে আমার নাম ইয়াবা চক্রে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে বলতে পারি, লেখাপড়া, শিক্ষকতা ছাড়া আমি তেমন কোনো কাজই করি না। একটু-আধটু কবিতা ও গান করি, ফলে এটা হাস্যকরও বটে। আবার খুব চিন্তারও বটে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাভারে কারা কাজ করছেন, তারা সব কিছু ঠিকঠাক করছেন কি না? মনে হয়, কোথাও একটু গোলমাল আছে।’
ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মো. আবুল কাশেম বলেন, ‘মাদকাসক্ত শিক্ষক যিনি, তার পক্ষে কোনো ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক বা শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রণোদনামূলক কাজ করার ক্ষমতা রাখা সম্ভব না। কারণ সমাজের কাছে তিনিও মাদকাসক্ত হিসেবে পরিচিতি পান। তাকে কেউ মান্য করে না, সম্মান করে না। প্রশাসন ও কর্তৃপক্ষের উচিত, বিশাল যে বিশ্ববিদ্যালয় সেখানে মাদকের সাপ্লাই বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া। জড়িতদেরকে শক্ত হাতে মোকাবেলা করা উচিত হবে।’
এ নিয়ে রাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম. আব্দুস সোবহান বলেন, ‘সত্যিকার অর্থে এটি গভীর পরিতাপের বিষয়, খুবই উদ্বেগজনক। শিক্ষকরা যখন এই অনৈতিক কাজে জড়ায়, তাদের কাছে যারা শিক্ষা গ্রহণ করে; তারা অনৈতিক কাজে জড়াবে এটা খুব স্বাভাবিক। এর বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন দারকার। বিশ্ববিদ্যালয়েও একটি আইন আছে, নৈতিকতার জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। আমি মনে করি, সেটি নেয়ার সময় এসেছে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন