অস্তিত্বহীন 'কাগুজে' শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছেয়ে গেছে সারাদেশ। নামসর্বস্ব এসব প্রতিষ্ঠান জেলা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসের কাগজপত্রে থাকলেও বাস্তবে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। অনেকটা 'কাজির গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই' প্রবাদের মতোই। কীভাবে, কারা ও কী উদ্দেশ্যে এসব ভুয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে, তা নিয়ে এবার খোঁজখবর শুরু করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর-মাউশি। নড়েচড়ে বসেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরও।
সারাদেশে অস্তিত্বহীন ও ভুয়া এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া ভিন্ন ভিন্ন সরকারি দপ্তর থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে শিক্ষা সংশ্নিষ্টদের ধারণা, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজ মিলিয়ে দেড় হাজারের বেশি ভুয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধির ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মূলত কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্য এবং এমপিওভুক্তির মাধ্যমে সরকারি অর্থ লোপাট করতেই ভুয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। এ ছাড়া বৃত্তি ও উপবৃত্তির অর্থও আত্মসাৎ করা হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভুয়া কাগজপত্র দাখিল করে বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ড ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। অনুমোদনের আগে সরকারি পরিদর্শনের সময় অন্যের জমি বা ভবনে সাইনবোর্ড টানিয়ে প্রস্তাবিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখানো হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের আবেদনপত্রের সঙ্গে জমির ভুয়া দলিল এবং ভূমি অফিসের কাগজ জাল করে নামজারির পত্রও দাখিল করা হয়েছে। এভাবে অনুমোদন পেয়েছে শত শত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব চৌধুরী মুফাদ আহমেদ সমকালকে বলেন, কোনো প্রতিষ্ঠান অনুমোদনের আবেদন করার পর জেলা শিক্ষা অফিসাররা কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করেন। সংশ্নিষ্ট শিক্ষা বোর্ডের পরিদর্শক দল সরেজমিনে যাচাই করে আসেন। তাদের প্রতিবেদনে ইতিবাচক মতামত থাকলেই মন্ত্রণালয় থেকে সার্বিক প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে অনুমোদন দেওয়া হয়। এর পরও ভুয়া প্রতিষ্ঠান কীভাবে অনুমোদন পায়, তা বিস্ময়কর। তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন বলে জানান।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, দেশজুড়ে রয়েছে বিপুলসংখ্যক ভুয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়। কেবল কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলায় এমন অস্তিত্বহীন ১৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সন্ধান পেয়েছে অধিদপ্তর। অস্তিত্বহীন এসব প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে অনুসন্ধানে বেশ কিছু কেসস্টাডি পাওয়া গেছে।
২০০৩ সালে রৌমারী উপজেলার ওকড়াকান্দা গ্রামের দারাজ উদ্দিন নামের এক ব্যক্তি ৩৩ শতাংশ জমি 'ওকড়াকান্দা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে'র নামে ওয়াক্ফ করেন। পরবর্তী সময়ে জমিদাতা দারাজ উদ্দিনের মৃত্যু হলে ভাগবাটোয়ারা হয়ে যায় তার পৈতৃক সম্পত্তি। স্কুলে দান করা ওই ৩৩ শতাংশ জমি দারাজ উদ্দিনের ছেলে আবদুস সালামের ভাগে পড়ে। দীর্ঘদিনেও স্কুলের কার্যক্রম চালু না হলে আবদুস সালাম ওই জমির এক অংশে বসতি স্থাপন ও বাকি অংশে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রোপণ করেন। সম্প্রতি ওই স্কুলের নামে মিলন মিয়া, তোহা মিয়া, মনি আক্তার, মিতা পারভীন ও দিশা মনি নামের পাঁচ পরীক্ষার্থী শৌলমারী এমআর উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে পিএসসি পরীক্ষায় অংশ নিলে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। ওই পরীক্ষার্থীরা প্রকৃতপক্ষে এমআর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বলে স্বীকার করেছেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক সাইদুর রহমান। জমির মালিক আবদুস সালাম খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, কে বা কারা গোপনে কাগজ-কলমে 'ওকড়াকান্দা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়'টি বহাল রেখে চলেছেন। আর এ কাজে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেছেন রৌমারী উপজেলা শিক্ষা অফিসের দুর্নীতিবাজ শিক্ষা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
পশ্চিম নওদাবাস বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে রৌমারীর আরেকটি অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণের সুপারিশ করে এর আগে চাকরি হারিয়েছেন এক উপজেলা শিক্ষা অফিসার।
আবার এসব ভুয়া প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা হরহামেশাই পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিতে গিয়ে ধরা খাচ্ছে। গত ২৩ নভেম্বর প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার পঞ্চম দিনে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলায় অস্তিত্বহীন 'মাঠেরপাড় বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়' এর নামে পরীক্ষা দিতে গিয়ে ধরা খায় চার শিক্ষার্থী। তাদের প্রবেশপত্র ঠিক থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি ছিল ভুয়া। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হয়ে ওই চার পরীক্ষার্থী সমাপনী পরীক্ষার চারটি বিষয়ে অংশগ্রহণও করেছে। 'মাঠেরপাড় বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়' নামে ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নাম দেওয়া আছে নিপা মনা নিসার। তবে এ নামে প্রধান শিক্ষক বা বিদ্যালয়ের কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে হাতীবান্ধা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার আবুল কালাম আযাদ সমকালকে বলেন, ওই চারজন ধরা পড়ার পর আমরা সরেজমিন পরিদর্শন করেছি। কিন্তু মাঠেরপাড় বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাইনি।
জানা গেছে, কাগুজে এসব প্রতিষ্ঠানের নামে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করা হচ্ছে। বগুড়া থেকে প্রকাশিত একটি আঞ্চলিক দৈনিকে জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলায় 'আক্কেলপুর মডেল টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিএম কলেজ' নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে গত ৩০ নভেম্বর। বিজ্ঞপ্তিতে প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা লেখা রয়েছে- আক্কেলপুর হাসপাতালের পেছনে। স্থানীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, বাস্তবে ওই নামে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই সেখানে নেই।
ভুয়া প্রতিষ্ঠান থেকে পিছিয়ে নেই রাজধানী ঢাকাও। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, রাজধানীতে পিপলস কলেজ, স্ট্যান্ডার্ড কলেজ, রয়েল কলেজসহ বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছে বলে তাদের নজরে এসেছে। অথচ এগুলোর কোনো অনুমোদন নেই। এ ব্যাপারে তারা খোঁজখবর নিতে শুরু করেছেন বলে জানান তিনি।
তালিকা চেয়েছে মাউশি : সম্প্রতি জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ, দেশীয় সংস্কৃতির বিকাশ, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ, প্রশ্ন ফাঁস ও ঝরে পড়া রোধ করতে সরকারি স্বীকৃতি পাওয়া কিন্তু বাস্তবে অস্তিত্বহীন স্কুল ও কলেজের তথ্যসহ তালিকা চেয়েছে মাউশি। গত ২৮ নভেম্বর চিঠি দিয়ে জেলা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসারদের কাছে এ তালিকা চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি চালু থাকা অনুমোদনহীন ও স্বীকৃতিহীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকাও চাওয়া হয়েছে। মাউশি পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) প্রফেসর মোহাম্মদ শামছুল হুদা এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, সরকারের নিয়মনীতির বাইরে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চলছে কি-না, এসব প্রতিষ্ঠানে মাধ্যমে জঙ্গিবাদ ও বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে চলছে কি-না, তা মনিটরিং করা হবে। সমকাল
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন