উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদঅনুমোদন না থাকার পরও ‘বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ’ নামে একটি সংগঠনের কমিটি ঘোষণা করে গোপনে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগ রয়েছে, স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী দেশকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে গোপনে তৎপরতা বাড়িয়েছেন। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করে সংগঠনের নেতারা বলছেন, তারা নিঃস্বার্থভাবে ছাত্রদের কল্যাণেই একটি প্ল্যাটফর্ম দাঁড় করাচ্ছে। যা কখনোই রাজনৈতিক নয়। এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, যদি কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে চায় এবং দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়, তাহলে ছাত্রত্ব বাতিলসহ তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিশ্বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ধানমন্ডি ক্যাম্পাসে গত ৩ নভেম্বর কাউন্সিলের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়টির ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী শাকিল মাহমুদ নীলকে সভাপতি, বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী আব্দুল কাইয়ুমকে সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলা বিভাগের অন্য শিক্ষার্থী দিদারুল আলমকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে এই সংগঠনের কমিটি ঘোষণা করা হয়। বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী দিদারুল আলম সাংগঠনিক সম্পাদক, ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী আরিফ হোসেন প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আব্দুল জলিল সহ-সভপতি, সমাজতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী মো. আজিজুল হক সহ-সভাপতি, আইন বিভাগের শাহারুল ইসলাম আইন সম্পাদক, আইন বিভাগের আল আমিন তরুণ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়।
কমিটি ঘোষণার আগে কাউন্সিলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিত থাকার জন্য একটি বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করেন আব্দুল কাইয়ুম। কাউন্সিলটি অনুষ্ঠিত হয় ধানমন্ডি ক্যাম্পাসের ৯০২ বড় হল রুমে। কাউন্সিলের পর গত ১০ নভেম্বর এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নির্বাহী পদপ্রাপ্তদের এক সাধারণ সভায় ডাকা হয়।
এরপর ৮ ডিসেম্বর আবারও একটি সভার আয়োজন করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করেন সংগঠনের সিনিয়র দুই নেতা। সেখানে মুন্না ও ওয়াহিদকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সেলিম রেজাকে অর্থ সম্পাদক, তোফাজ্জল হোসেন আরিফকে আঞ্চলিক কেন্দ্র বিষয়ক সম্পাদক, মাহিম আনামকে সমাজ কল্যাণ সম্পাদক, রাহাত আরা আল্পনাকে ছাত্রী বিষয়ক সম্পাদক, আইনুল হককে শিক্ষা ও পাঠচক্র বিষয়ক সম্পাদক, রুবেল আহমেদকে যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক, রোকেয়া আখতারকে সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক, শাহেদ জলিলকে গ্রন্থ ও প্রকাশনা সম্পাদক, রনি শেখ ও জাবির চৌধুরীকে সহ- সম্পাদক নির্বাচিত দেওয়া হয়।
কাউন্সিলে আয়োজনের ঘোষণা
নাম প্রকাশ না করার শর্তে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা ক্যাম্পাসেই প্রতি সপ্তাহে গোপনে মিটিংয়ের আয়োজন করছেন। ক্যাম্পাসের বাইরেও সংগঠিত হচ্ছেন। তাদের সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে এগিয়ে নিতে নিজেদের মধ্যে আলোচনা অব্যাহত রেখেছেন। নেতা-কর্মীরা সংগঠনের কাজে সক্রিয় কিনা, তাও নজরদারি করা হচ্ছে। কারও কর্মকাণ্ড সন্তোষজনক না হলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকিও দেওয়া হচ্ছে।’
বিশ্ববিদ্যালয়টির একাধিক শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, সংগঠনটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছাত্রকল্যাণেই নির্ধারণ করা হয়েছে বলা হলেও কর্মকাণ্ড স্বাধীনতাবিরোধীদের পক্ষে। তাদের বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘সভাপতি শাকিল মাহমুদ নীলসহ বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি জামায়াত-শিবিরের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। তাদের ফেসবুক টাইমলাইন ঘেঁটেও এর অসংখ্যা প্রমাণ মিলেছে। বাঁশের কেল্লাসহ স্বাধীনতাবিরোধীদের পক্ষের বেশ কিছু ফেসবুক পেজের ফলোয়ার এই নীল। তিনি স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি জামায়াত-শিবিবের পক্ষের বিভিন্ন পোস্ট তার নিজের ফেসবুক টাইমলাইনে শেয়ারও করেছেন। অন্যদিকে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দেশের জন্য অবদান রেখেছেন, এমন প্রশংসামূলক একাধিক পোস্ট নিজের ফেসবুক টাইমলাইনে শেয়ার করেছেন। এছাড়া দেশের বর্তমান সরকার ও প্রশাসনকে সমালোচনা করেও একাধিক পোস্ট দিয়েছেন নিজের টাইমলাইনে। ফেসবুকে এসব পোস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যদের নজরে এসেছে বুঝতে পেরে নীল পরবর্তী সময়ে তার সেসব পোস্ট মুছে দিয়েছেন। ছাত্রলীগের প্রোফাইল সম্পন্ন নিজের ছবি নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে ব্যবহার করেছেন।’
এই বিষয়ে জানতে চাইলে শাকিল মাহমুদ নীল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ ধরনের কোনও ঘটনার সঙ্গে আমি জড়িত নই। এগুলো আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার।’
ইনঅ্যাক্টিভ কর্মীদের হুমকি দিয়ে সংগঠনটির একটি জরুরি নোটিশ
বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে এই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও পরে তারা ওই কমিটি থেকে বের হয়ে এসেছেন বলে দাবি করেন। এমনই একজন আইন বিভাগের শিক্ষার্থী আল আমিন তরুণ। তাকে সংগঠনে যুক্ত করে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদ দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি সংগঠনটি থেকে বের হয়ে এসেছে দাবি করে বলেন, ‘সংগঠনটির শুরুর দিকে আমাকে কয়েকজন কর্মী বলেন, ছাত্রদের কল্যাণে একটি সংগঠন দাঁড় করাচ্ছি। আপনাকে আমরা সদস্য হিসেবে নিতে চাই। আমিও একদিন কিছু সময়ের জন্য মিটিংয়ে যাই। পরে ওইদিনই নেতাকর্মীরা বলেন, আমাকে সদস্য নয়, একটি পদ দেওয়া হবে। ওই দিনই আমাকে আইন বিষয়ক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদ দেওয়া হয়। আমার সঙ্গে আমার বিভাগের আরও এক বড় ভাইকেও পদ দেওয়া হয়। কিন্তু ওই দিনই আমি জানতে পারি, এই ধরনের সংগঠনের কোনও অনুমোদন নেই। আমি সংগঠনের ওই মিটিংয়ে থেকেও বুঝেছি, তাদের উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীদের পক্ষে মনে হলেও আচরণ ও কথাবার্তা সরকারবিরোধী। বুঝতে পেরেই আমি ও আমার বিভাগের সেই বড় ভাই এখান থেকে বের হয়ে আসি। এটা সংগঠনের একজনকে ফোন করে জানাই, আমি আর এই সংগঠনের সঙ্গে নেই।’
এদিকে, এই ধরনের অবৈধ কর্মকাণ্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীর নজরে এলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানান তারা। তখনই সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা নিজেরাই তাদের এই সংগঠনকে গত ৩১ ডিসেম্বর বাতিল ঘোষণা করেন। অথচ ঠিক তার পরদিনই সংগঠনের ব্যানার নিয়ে ক্যাম্পাসে গিয়ে ছবি তোলেন সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা। এরপর গত ১২ জানুয়ারি সংগঠনটি আবারও একটি সাধারণ সভার আয়োজন করে।
অনুমতি না থাকার পরও সংগঠন করার বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগঠনটির সভাপতি শাকিল মাহমুদ নীল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘আসলেই ‘উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ’ নামটি ব্যবহার করে ভুল হয়েছে। আমরা এখন বুঝতে পেরেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে এই নামের সংগঠনের কোনও অনুমতি নেই। তবে আমাদের উদ্দেশ্য মূলত ছাত্র কল্যাণের। এ কারণে এখন নামটি পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখন নাম দেওয়া হবে ‘উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র কল্যাণ পরিষদ।’’
স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগের বিষয়ে শাকিল মাহমুদ নীল বলেন, ‘মানুষ অনেক সময় ভুল পথে যায়, ভুল করে। পরে সংশোধনও করে নেয়। এছাড়া সোশাল মিডিয়া দিয়ে একজন মানুষকে বিচার করা তো ঠিক নয়। তার সম্পর্কে ভালোভাবে খোঁজ নিতে হবে, জানতে হবে, দেখতে হবে। তারপরই বোঝা যাবে তিনি কী।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এই সংগঠনটি শুরু করার পর অনেক কথা কানে এসেছে। অনেক শিক্ষার্থী বাইরে বলে বেড়াচ্ছেন, আমরা নাকি সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু আমাদের তো এমন কোনও উদ্দেশ্য নেই। এছাড়া কোনও ব্যক্তিগত স্বার্থও নেই। আমরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক অবহেলিত। ঠিকমতো ক্লাস পাই না, সময়মতো রেজাল্ট পাই না। একসময় আজিমপুর গার্লস স্কুলে গিয়েও আমরা ক্লাস করেছি। ফলে শুধু আমরাই নই, এরপরও যারা আসবে, তাদের যেন কষ্ট করতে না হয়, কোনও সমস্যায় না পড়তে হয়, যেন আমাদের দাবিগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে তুলে ধরতে পারি এবং দাবি পূরণ করাতে পারি, সেদিক ভেবেই আমরা একটি প্ল্যাটফর্ম দাঁড় করানোর চেষ্টা করছি। এর বেশি কিছুই নয়। এতে আমার কোনও ব্যক্তিগত স্বার্থ নেই। তাই এই সংগঠনের কেউ যদি আমাকে সভাপতি হিসেবে মানতে না চান, তাহলে সংগঠন ছেড়ে আমি চলে যাবো।’
সাধারণ সভার নোটিশ
বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুমোদনহীন ছাত্র সংগঠনের কর্মকাণ্ড বিষয়ে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আরিফা রুমা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে এমন কোনও সংগঠনের অনুমতি নেই। আমার কাছেও অভিযোগ এসেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র এ ধরনের কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। শুনেছি, সংগঠনটি মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধী মতাদর্শের। অথচ সরকার দলীয় বলে পরিচয় দিচ্ছে। ফেসবুকে সেটা প্রচারও করছে। যদি এমনটি করেই থাকে তাহলে অবশ্যই তাদের ছাত্রত্ব বাতিল হবে।’
বিশ্ববিদ্যালয়টির রেজিস্ট্রার আবুল হোসাইন আহমেদ ভূইয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন আইনেই আছে ছাত্র সংসদ থাকতে হবে কিন্তু উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কোনও আইন বা বিধান নেই। শুধু তাই নয়, কোনও ধরনের ছাত্র সংগঠনেরই বিধান নেই। ফলে কেউ যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে এমন কোনও অবৈধ ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কর্মকাণ্ড চালায়, তাহলে তদন্ত সাপেক্ষে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো।’
এদিকে বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে রেগুলার বয়সের কোনও শিক্ষার্থী পড়েন না। তাদের পড়াশোনার জন্য কোনও নির্দিষ্ট বয়সের সীমারেখা নেই। ফলে সেখানে ছাত্রলীগের কোনও সংগঠন বা কর্মকাণ্ডকে অনুমোদন দেওয়া হয় না। তবে কেউ যদি ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে সুবিধা নিতে চায়, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন