অধিভুক্ত সাত কলেজ নিয়ে আপত্তি, ঢাকসু নির্বাচন, শিক্ষকদের মধ্যকার বিরোধ ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের নানামুখি আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বেশ কিছুদিন ধরে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। এসব ইসু্যতে আজ ভিসির কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি থাকায় চলমান পরিস্থিতি আরও বেগতিক হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে।
গত ১৫ই জানুয়ারি ৭ কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেয়া শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগের হামলা ও নারী শিক্ষার্থীদের ওপর যৌন হেনস্থা এবং একদিন পর প্রক্টরের কার্যালয়ের সামনের গেট ভেঙে শিক্ষার্থীদের ভেতরে প্রবেশ নিয়ে দুটি পৃথক তদন্ত্ম কমিটি গঠন করে প্রশাসন। ৪৮ ঘন্টার মধ্যে তদন্ত্ম কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে দায়ীদের বিরম্নদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দিলেও সে সময় পার হয়ে গেছে দুই দিন আগেই। তারপরও দায়ীদের বিরম্নদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় আজ আবারও ভিসির কার্যালয় ঘেরাওয়ের ঘোষণা দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, উপাচার্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা না বলে ছাত্রলীগ দিয়ে শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালায়। যদিও উপাচার্য ছাত্রলীগ দিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর হামলার কথা অস্বীকার করেছেন। আজকের অবস্থানে ফের যদি ছাত্রলীগ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে তবে তা পরিস্থিতিকে আরও বেগতিক দিকে ঠেলে দেবে বলেই মনে করছে শিক্ষার্থীরা। বিষয়টি নিয়ে ক্যাম্পাসে উত্তেজনা রয়েছে।
অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শান্ত্ম করতে ৭ কলেজের শিক্ষার্থীদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয়পত্র দেয়া হবে না বলে যে ঘোষণা উপাচার্য দিয়েছেন তাতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে ওই সব কলেজের শিক্ষার্থীরা। দ্রম্নত বিভিন্ন বর্ষের পরীক্ষা গ্রহণ, ফলাফল প্রকাশ, ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্নসহ আরও বেশ কিছু দাবিতে এসব কলেজের শিক্ষার্থীরাও শান্ত্মিপূর্ণভাবে নতুন কর্মসূচি পালনের কথা জানিয়েছে। সাত কলেজের ফেসবুক গ্রম্নপে সবাইকে শান্ত্মিপূর্ণ কর্মসূচি নিয়ে চিন্ত্মাভাবনা করার আহ্বান জানিয়ে একাধিক পোস্ট দেয়া হয়েছে।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বেশ কয়েকটি ঘটনা প্রশাসন যেভাবে মোকাবেলা করেছে, বিশেষ করে প্রক্টরের বিষয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র অসন্ত্মোষ সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি করা হয়েছে। জানা গেছে, বিভিন্ন পক্ষে বিভক্ত শিক্ষকদেরও একটি অংশ এ দাবিতে ইন্ধন জোগাচ্ছে।
আগামী ছয় মাসের মধ্যে ঢাকসু নির্বাচন দেয়ার যে নির্দেশ দেশের সর্বোচ্চ আদালত দিয়েছে, তাও প্রশাসনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলেই মনে করছে কর্তৃপক্ষ। আদালতের এ আদেশের পর সাধারণ শিক্ষার্থীরাও ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে বেশ সোচ্চার হয়ে উঠেছে। বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলো এ দাবিতে আন্দোলন করছে। তবে নির্বাচনের বছরে এ ধরনের বাধ্যতামূলক আদেশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের মন্ত্মব্য করা থেকে বিরত থাকছে।
ছাত্র সংসদ নির্বাচন, তদন্ত্ম কমিটির রিপোর্ট, শিক্ষার্থীদের নতুন কর্মসূচি, ছাত্রলীগ ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিরোধসহ বেশ কিছু বিষয়ে সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে জানতে চাইলে কোনো বিষয়েই সুস্পষ্ট জবাব দিতে রাজি হননি উপাচার্য প্রফেসর আখতারম্নজ্জামান। তিনি প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে সুস্পষ্ট বক্তব্যের মধ্যে যেটুকু বলেন, তা হলো, 'আন্দোলন করা সবার গণতান্ত্রিক অধিকার। তবে অন্যের অধিকার হরণ করে কোনো আন্দোলন করা যাবে না।'
এর অর্থ কী এই দাঁড়ায় যে, পথ বন্ধ করে আন্দোলনের চেষ্টা হলে আবারও শিক্ষার্থীদের উপর হামলা হবে এমন প্রশ্নের উত্তরে উপাচার্য প্রতিবেদককে চা খেতে বলেন। এভাবেই ঘুরিয়ে পেচিয়ে কোনো প্রশ্নেরই সঠিক উত্তর দেননি তিনি।
ঢাকসু নির্বাচন প্রসঙ্গে এর আগে উপাচার্য জানান, আদালতের আদেশের কপি হাতে পেলে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবেন। আদালতের আদেশের কপি হাতে পেয়েছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ভিসি বলেন, 'এটি অন্য দপ্তরে খোঁজ নিতে হবে। আমি কাজে ব্যস্ত্ম থাকায় এ বিষয়টি দেখার সুযোগ পাইনি।'
ভিসির এমন অবস্থান নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থী ও বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলো ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। তারা জানায়, সমস্যাকে ফেস না করে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা আরও বড় সমস্যার জন্ম দেবে। বাংলাদেশ ছাত্র ফ্রন্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সালমান সিদ্দীকি এ বিষয়ে যায়যায়দিনকে বলেন, 'উপাচার্য সকল শিক্ষার্থীর। তিনি কোনো বিশেষ দলের উপাচার্য হতে পারেন না। কিন্তু সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বিভিন্ন বিষয়ে স্যারের আচরণ আমাদের ভীষণভাবে ব্যথিত করেছে। তিনি নিজে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা না বলে ছাত্রলীগকে ডেকে এনেছেন। সাধারণ শিক্ষার্থী ও মেয়েদের হেনস্থার সুযোগ করে দিয়েছেন। তার রম্নমে নিয়ে ছাত্রলীগ আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীকে মারধর করল। আর তিনি কোনো ব্যবস্থা নিলেন না! এটা কিভাবে সম্ভব! তিনি আমাদের অভিভাবক! ভাবতে অবাক লাগছে।'
সালমান আরও বলেন, 'তদন্ত্ম কমিটির নামে নাটকের মঞ্চায়ন করা হচ্ছে। যেখানে ছাত্রদের কোনো প্রতিনিধি নেই। অজ্ঞাতনামা মামলার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ভয় দেখানো হচ্ছে। যারা সহিংসতা করল তাদের বিরম্নদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীকে আদালতে পাঠানো হলো। হলে হলে সীট বাতিলের ভয় দেখানো হচ্ছে। এর আগেও তো আমরা প্রক্টর দেখেছি। বর্তমান সময়ের প্রক্টরের মতো আচরণ তো তাদের করতে দেখিনি। সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রক্টরের পদত্যাগের যে দাবি করছে আমরা তার সঙ্গে একমত। আমরাও তার পদত্যাগ চাই। তা না হলে পরবর্তী পরিস্থিতির জন্য প্রশাসনকেই দায়ী থাকতে হবে।'
আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের সুরও অনেকটা একই রকম। ইমতিয়াজ নামের একজন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী বলেন, 'এই প্রশাসন আমাদের নয়। এটি ছাত্রলীগের প্রশাসন। এ প্রশাসনকে আমরা মানি না। প্রক্টরকে পতত্যাগ করতে হবে। আদালতের নির্দেশমতো ঢাকসু নির্বাচন দিতে হবে। মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করে প্রকৃত অপরাধীদের বিরম্নদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে এ আন্দোলনের পর আরও কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে।'
তুলি নামের একজন বলেন, 'সাত কলেজ নিয়ে যে ধরনের হ য ব র ল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত। এসব শিক্ষার্থীর জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট করা হচ্ছে। তারা এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাপাসিটি ৪০ হাজার শিক্ষার্থীর ব্যবস্থাপনার। তার উপর কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই তুলে দেয়া হয়েছে আরও দুই লাখ। যা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। গত একমাস ধরে দেখছি সাত কলেজের প্রথমবর্ষে ভর্তির ভাইভা নিচ্ছে তো নিচ্ছেই। শেষ হচ্ছে না। শিক্ষকরা ভাইভায় ব্যস্ত্ম থাকায় আমাদের ক্লাস নিতে পারছেন না। আরও অনেক সমস্যা হচ্ছে। ওইসব কলেজের শিক্ষার্থীরাও পিছিয়ে পড়ছে। এ কারণেই আমরা ওইসব কলেজের অধিভুক্তি বাতিল চাইছি এবং এটি করতেও হবে। না হলে আমাদের শিক্ষার বারোটা বাজবে।'
ব্যবসা শিক্ষা অনুষদের ডিন শিবলী রম্নবায়েতুল ইসলাম এ বিষয়ে যায়যায়দিনকে বলেন, 'সকলেই আমাদের সমালোচনা করছে। কিন্তু সরকারের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের আদেশে এটা করা হয়েছে। এখানে আমাদের কোনো হাত নেই। এটি বাতিলও আমরা করতে পারি না। আদেশটি কোন পর্যায় থেকে এসেছে তা না দেখে শুধু সমালোচনা করলে পক্ষপাতিত্ব হবে। এই যে সাত কলেজের প্রায় দুই লাখ শিক্ষার্থী আমাদের উপর দেয়া হলো, এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন বাড়তি কর্মচারী বা শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়নি। আমাদের পরিশ্রম কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। কিন্তু আমরা এর জন্য একটি পয়সাও বাড়তি পাচ্ছি না। চাইও না। নিজেদের শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করা প্রতিটি শিক্ষকের জন্য আনন্দের। কিন্তু আমরাও তো মানুষ। আমাদেরও তো পরিশ্রমের একটি সীমা আছে। রাত দিন পরিশ্রম করে প্রশংসা না পেয়ে সমালোচনাই আমাদের প্রাপ্য হলো।'
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন