সকালে পরীক্ষা। বাসা থেকে পরীক্ষা কেন্দ্রের দূরত্ব অনুয়ায়ী রওনা দিলো পরীক্ষার্থী। হাতে বই। সারা পথ বইয়ের পাতায় চোখ তার। সঙ্গে অভিভাবক। পড়তে পড়তেই পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছানো। সেখানে শেষবারের মতো বইয়ের পাতায় চোখ বুলিয়ে নেওয়া। শেষমেষ বুকে ফুঁ দিয়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে ঢোকা।
সেইদিন এখন আর নেই। যেমন এবারের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা চলাকালে নিয়মিত দেখা যাচ্ছে বিপরীত দৃশ্য। শুনুন আজিজ খন্দকার নামের এক অভিভাবকের মুখে, ‘আমাদের সন্তানরা পরীক্ষার কেন্দ্রে প্রবেশের আগে বইয়ের পরিবর্তে চায় স্মার্টফোন। কখন উত্তরসহ প্রশ্ন পাওয়া যাবে সেজন্য তাদের মধ্যে অস্থিরতা। তাদের চোখেমুখে চিন্তার ছাপ আছে ঠিকই, কিন্তু তা প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাক পাওয়া গেলো কিনা তা নিয়ে।’
রাজধানীর মোহাম্মদপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে শনিবার (১০ ফেব্রুয়ারি) গণিত পরীক্ষা শুরুর পরপরই এই অভিভাবক হতাশার সুরে বাংলা ট্রিবিউনের কাছে নিজের অভিজ্ঞতা জানাচ্ছিলেন। তার কথায়, ‘আমার ছেলে পরীক্ষার আগের দিন রাতে মোবাইল ফোন নিয়ে বসে। একটু পড়ে, একটু স্মার্টফোন দেখে; এভাবেই কাটে তার সারারাত। আগের পাঁচটি পরীক্ষায়ও একই কাণ্ড ঘটেছে। আমি এত রাগারাগি করি, কিন্তু কিছুতেই সে কথা শোনে না। তাছাড়া সে তো বাচ্চা। তাকে যখনই বকাঝকা করি, পড়াশোনা বাদ দিয়ে রেগে বসে থাকে। তখন আর কিছু করার থাকে না।’
শনিবার (১০ ফেব্রুয়ারি) গণিত পরীক্ষা শুরুর আগে সকাল ৯টার দিকে রাজধানীর দুটি পরীক্ষা কেন্দ্রের সামনে অবস্থান নেন বাংলা ট্রিবিউনের দুই প্রতিবেদক। ওই দুটি কেন্দ্রের আশপাশে বইয়ের পরিবর্তে স্মার্টফোন নিয়ে কয়েকজন পরীক্ষার্থীকে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনের একটি গলিতে কয়েক ভাগে জটলা বেঁধে ছিল কয়েকজন পরীক্ষার্থী। কাছে যেতেই দেখা যায় তাদের মধ্যমণি হলো মোবাইল ফোন! একটি ফোনেই আটকে আছে অন্তত ৫ থেকে ৭ জন পরীক্ষার্থীর দৃষ্টি। এভাবে আলাদা আলাদা কয়েকটি দল জটলা বেঁধে ফেসবুকে পাওয়া প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে। একজন পরীক্ষার্থীকে উচ্ছ্বসিত হয়ে অন্য পরীক্ষার্থীকে বলতে শোনা গেলো, ‘পেয়েছি! পেয়েছি! দ্রুত বই বের কর।’ এ সময় ওই পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে কয়েকজন অভিভাবককেও ছিলেন। এক অভিভাবক উচ্ছ্বসিত পরীক্ষার্থীকে বললেন, ‘সাবধান, তোমরা এসব কী করছো? হট্টগোল কোরো না। মাথা ঠাণ্ডা করে দেখো।’
অন্যদিকে মোহাম্মদপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনেও দেখা যায় একই চিত্র। সেখানে জটলা বেঁধে কয়েকজন পরীক্ষার্থী মোবাইল ফোনে প্রশ্ন দেখছিলেন। অভিভাবক আজিজ খন্দকারের সঙ্গে কথা হলো এই বিদ্যালয়ের সামনে। তিনি বলেছেন, ‘গত কয়েকদিন ধরেই এমন চিত্র দেখছি। এক্ষেত্রে আমার কিছুই বলার নেই। আমরা কী বলবো? প্রশ্ন পাওয়া যায় ইন্টারনেটে। পরীক্ষার্থীদের নিষেধ করলেই তো সমস্যা বাড়ে। তখন তারা পড়াশোনা বাদ দিয়ে দেয়। আমরা কী করবো? আমরা অসহায়। সরকার তো প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে পারছে না। প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানো গেলেই কিন্তু সমাধান হয়ে যায়।’
এদিকে অভিভাবক রাবেয়া বানুর অভিযোগ— ‘নিয়ম অনুযায়ী পরীক্ষার্থীদের সাড়ে ৯টার মধ্যে কেন্দ্রে ঢুকতে হবে। কিন্তু সেটা মানা হচ্ছে না ঠিকমতো। অনেকেই প্রশ্ন দেখতে গিয়ে দেরি করে কেন্দ্রে আসছে। কিন্তু কেন্দ্রে এসে তারা অজুহাত দেখিয়ে বলে, জ্যামে আটকে ছিলাম।’
পাশে থাকা কয়েকজন অভিভাবক রাবেয়া বানুর এই অভিযোগের প্রতিবাদ জানান। তাদের বক্তব্য, ‘পরীক্ষার ৩০ মিনিট আগে কেন্দ্রে আসার নিয়ম করা উচিত হয়নি। আমরা দূর থেকে আসি। রাস্তায় জ্যাম থাকে। পারলে প্রশ্নফাঁস ঠেকাক সরকার। আমাদের শুধু শুধু কষ্ট দেওয়ার মানে কী?’
শনিবার দুপুর ১টায় পরীক্ষা শেষ হলে একে একে বের হতে থাকেন পরীক্ষার্থীরা। লালমাটিয়া গার্লস স্কুলের এক পরীক্ষার্থী বললো, ‘সকালে প্রশ্ন পেয়েছিলাম। সেটাই পরীক্ষায়ও এসেছে। গত পাঁচ দিনের মতো আজকের প্রশ্নও হুবহু মিলে গেছে।’ এই প্রশ্ন আগে কোথায় পেয়েছো জানতে চায় বাংলা ট্রিবিউন। ওই পরীক্ষার্থীর উত্তর, ‘হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপে। প্রথম কয়েকদিন টাকা দিয়ে নিছিলাম। এখন আর টাকা দেওয়া লাগে না। ফ্রিতেই পাই।’ কত টাকা দিয়েছিলে প্রশ্ন করলে জানা গেলো, ৩০০ টাকা।
এর আগে শনিবার সকাল ৮টা ৫৯ মিনিটে হোয়াটসঅ্যাপের ‘SSC ফ্রি প্রশ্নের দুকান’ নামের একটি গ্রুপে গণিতের বহুনির্বচনি অভীক্ষার ‘খ’ সেট প্রশ্ন পাওয়া যায়। এর সঙ্গে ছিল হাতে লেখা উত্তরপত্র। এ সময় ‘ফারহান আদনান’ নামে একটি আইডি থেকে প্রশ্নপত্র ও উত্তর দেওয়া হয় গ্রুপে।
এরপর ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্নপত্রটি ছড়িয়ে পড়ে। পরীক্ষা শেষে পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে পাওয়া প্রশ্নের সঙ্গে এর হুবহু মিল দেখা গেছে।
ধানমন্ডি গর্ভমেন্ট বয়েজ স্কুলের এক পরীক্ষার্থীর কাছে প্রশ্ন চেয়ে পাওয়া গেলো। তখন সে হতাশ হয়ে বললো, ‘পরীক্ষা ভালো হয়নি।’ পাশের অন্য পরীক্ষার্থী হতবাক হয়ে বলে, “ও মাই গড, তোর ‘খ’ সেট প্রশ্ন পড়েছে। আমি তো এটাই খুঁজছিলাম। আমার কপালটাই খারাপ, আমার ‘ঘ’ সেট পড়েছে।”
‘খ’ সেট কেন চাচ্ছিলে জানতে চাইলে বাংলা ট্রিবিউনকে ওই পরীক্ষার্থী বলেছে, “সকালে আমি ‘খ’ সেটের প্রশ্ন ও উত্তর পেয়েছিলাম। তবে ‘ঘ’ সেট প্রশ্ন পড়লেও ‘খ’ সেট লিখে সব উত্তর দিয়ে এসেছি। সুতরায় সবই সঠিক হবে।”
পাশের আরেক ছাত্রী বাংলা ট্রিবিউনকে বলে, ‘আমিও প্রশ্ন পেয়েছিলাম। বন্ধুরা পেয়ে সকালে পাঠিয়ে দিয়েছে। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ৯টার মধ্যে মেসেঞ্জারে বা হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্ন ও উত্তরের ছবি চলে আসে আমাদের হাতে। আজকের প্রশ্ন পেয়েছি ৯টা ১০ মিনিটে।’
এদিকে মতিঝিলের পিঅ্যান্ডটি স্কুল কেন্দ্রের সামনে থেকে এক অভিভাবক বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিবেদককে শনিবার সকাল সাড়ে ৯টায় ফোন করে বলেছেন, ‘ভাই, এখানে প্রশ্নফাঁসের স্বর্গরাজ্য চলছে। পরীক্ষার্থীরা মোবাইল ফোনে প্রশ্ন দেখছে। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিভাবকরাও প্রশ্ন দেখতে উঠেপড়ে লেগেছেন। এই পরিবেশ আমার আর ভালো লাগছে না। এ কোন যুগে এসে পড়লাম!’
আজিমপুর সরকারি গার্লস স্কুলেও একই চিত্র। সেখানে শনিবার সকাল সাড়ে ৯টার পরেও কয়েকজন পরীক্ষার্থীকে কেন্দ্রে ঢুকতে দেখা গেছে। স্কুলের সামনে প্রকাশ্যেই মোবাইল ফোনে প্রশ্ন দেখার মহড়া চলে। এ নিয়ে অভিভাবকরা রীতিমতো ক্ষুব্ধ। তাদের ভাষ্য, ‘প্রতিদিন আর এসব দেখতে ভালো লাগে না। আমাদের সন্তানরা তো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আমরা কাকে বলবো এসব কথা। তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় থাকতে হচ্ছে।’
আজিমপুর সরকারি গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ হাসিবুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “আমাদের কাছে নির্দেশনা আছে সাড়ে ৯টার মধ্যে কেন্দ্রে আসতে হবে। আমরা সেভাবেই কাজ করছি। কিন্তু দু’একজন অনেকদূর থেকে এলে তাদের তো আর ফিরিয়ে দিতে পারি না। ফিরিয়ে দিলেও তো সমস্যা। কী করার আছে বলেন? তারপরও স্কুল ফটকে দায়িত্বরত পুলিশকে বলা আছে, যারা দেরি করে আসবে তাদের ভালোভাবে চেকআপ করতে হবে। পরীক্ষার কক্ষেও ওইসব শিক্ষার্থীর ওপর নজর রাখার জন্য দায়িত্বরত শিক্ষককে বলা আছে।”
কেন্দ্রের সামনেই মোবাইল ফোনে প্রশ্ন দেখা প্রসঙ্গে হাসিবুর রহমানের মন্তব্য, ‘আমি সকাল ৯টার দিকে হেঁটে বাসা থেকে স্কুলে আসি। কই, আমার চোখে তো এমন কিছু পড়েনি। তারপরও এ ধরনের ঘটনা দেখলেই যেন ধরে ফেলে সেই বিষয়ে পুলিশ প্রশাসনকে বলা রয়েছে।’
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে একটি কমিটি কাজ করছে। এ বিষয়টি তদারকিতে মন্ত্রণালয়সহ আমরাও আছি।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন