জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি র্যাগিংয়ের শিকার এক শিক্ষার্থীর মানসিক ভারসাম্য হারানোর ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি পালিত হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসির অনুসারি আওয়ামীপন্থী শিক্ষক ও সিনেট সদস্যরা এ কর্মসূচি পালন করেন। সোমবার একই দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি।
এসব কর্মসূচিতে ৯টি আবাসিক হলের প্রভোস্ট-আবাসিক শিক্ষক ও প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা শিক্ষকদের নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে।
কর্মসূচিগুলোতে র্যাগিং বন্ধ না হওয়ার জন্য প্রশাসনকে সরাসরি দোষারোপ করেছেন তারা। অথচ এই শিক্ষকরাই দায়িত্ব পালন করছেন প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে।
এমন পরিস্থিতিতে ক্যাম্পাসে প্রশ্ন উঠেছে- নিজেরাই যখন প্রশাসনের দায়িত্বে আছেন, তখন কাকে তারা এই র্যা গিং বন্ধ করতে বলছেন?
জানা গেছে, র্যা গিং বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসূচিতে অংশ নেন ফজিলাতুন্নেসা হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক মো. শাহেদুর রশিদ। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সভাপতি, সিন্ডিকেট ও সিনেট সদস্য।
ছিলেন শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রভোস্ট। শেখ হাসিনা হলের প্রভোস্ট হিসেবে দায়িত্বরত শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ফরিদ আহমদও ছিলেন। আরও অংশ নে সিনেট সদস্য ও ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হোসনে আরা। যিনি খালেদা জিয়া হলের প্রভোস্ট হিসেবেও দায়িত্বরত আছেন।
সোমবার র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে শিক্ষক সমিতির ডাকা সংবাদ সম্মেলনে এই চার শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন। সেখানে নিজেদের দায়িত্ব পালন করা নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে কেউই সদুত্তর দিতে পারেননি।
আপনারা প্রত্যেকেই প্রশাসনের দায়িত্বে আছেন। র্যা গিংয়ের শাস্তির দাবিতে প্রতিবাদও জানাচ্ছেন প্রশাসনের বিরুদ্ধে। এই প্রশাসন তাহলে কারা- এমন প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রভোস্ট ও শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘হল প্রশাসনের একার পক্ষে র্যা গিং বন্ধ করা সম্ভব নয়। তাই আমরা সবাইকে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।’
একই প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক মো. শাহেদুর রশিদ বলেন, ‘আসলে প্রতিবছর নবীনদের আসার আগে হল প্রভোস্টদের নিয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বসা হয়। সেখানে বিভিন্ন নির্দেশনা আসে। এবার সেটা করা হয়নি।’
দু’জন গোজামিল দিয়ে জবাব দেয়ার চেষ্টা করলেও বাকি দু‘জন ছিলেন নিশ্চুপ। ফলে সংবাদ সম্মেলনেই এ নিয়ে বেশ বিব্রত হন শিক্ষকেরা।
এছাড়া সোমবার র্যাগিং বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের প্রভোস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক অসিত বরণ পাল, মীর মোশাররফ হোসেন হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক, গাণিতিক ও পদার্থ বিষয়ক অনুষদের ডিন অধ্যাপক অজিত কুমার মজুমদার, সুফিয়া কামাল হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক এস এম বদিয়ার রহমান, ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান ও গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক মো. খবির উদ্দিন, ফার্মেসি বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক সুকল্যাণ কুমার কুন্ডু, সালাম-বরকত হলের ওয়ার্ডেন খন্দকার শামীম আহমেদ, আল বেরুনী হলের সহকারী আবাসিক শিক্ষক দেবাশীষ সাহা প্রমুখ।
শিক্ষকদের এই আন্দোলন সম্পর্কে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অধ্যাপক পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘বিষয়টি খুবই হাস্যকর। যারা নিজেরাই প্রশাসনে আছেন, তারাই আবার প্রশাসনকে দোষারোপ করছেন। র্যাগিং বন্ধের দায়িত্ব তো উনাদেরই। দায়িত্ব পালন না করে আন্দোলন করছেন কোন মুখে?’
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, হল প্রশাসনের নিষ্ক্রীয়তাই র্যাগিং বন্ধ না হওয়ার প্রধান কারণ। আবাসিক হলগুলোতেই র্যাগিং হয় সবচেয়ে বেশি।
সোমবার শিক্ষক-শিক্ষার্থী ঐক্যমঞ্চের ব্যানারে ডাকা সংবাদ সম্মেলনে অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ বলেন, ‘প্রশাসনের ছত্রছায়ায় অনেক অছাত্র হলে সিট দখল করে আছে। এর ফলে সিট সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। যার ফসল গণরুম। এই গণরুমেই পরিচালিত হয় র্যাগিং নামক অপসংস্কৃতি।’
এ সময় সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক নাসিম আখতার হোসাইনও র্যাগিং বন্ধ না হওয়ার জন্য আবাসিক হলগুলোতে প্রশাসনের দায়িত্বের অবহেলাকে দায়ী করেন।
গত বছরের নভেম্বরে পরিবর্তন ডটকমের চালানো এক জরিপে দেখা গেছে, ৭৩ শতাংশ আবাসিক শিক্ষার্থী হলে দায়িত্বরত শিক্ষকদের চিনেন না। দায়িত্ব পালন করেন না বলেই শিক্ষকদের তারা চিনেন না বলে জরিপে মতামত দেন শিক্ষার্থীরা।
জানতে চাইলে ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘প্রশাসন মানে তো কেবল ভিসি নন। এটা তো একটা বডি। প্রশাসনের বিভিন্ন পদে থাকা ব্যক্তিরা যার যার দায়িত্ব ঠিকমত পালন না করলে তো ভিসি চাইলেও পরিবর্তন হবে না।’
তিনি প্রশাসনের বিভিন্ন পদে থাকা ব্যক্তিদের নিজেদের দায়িত্ব যথাযথ পালন করারও আহ্বান জানান।
র্যাগিং নিয়ে অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম বলেন, ‘হল প্রশাসন সত্যিকার অর্থে দায়িত্ব নিলে র্যাগিং করার সাহস কোনো শিক্ষার্থীর হতো না। প্রতিটা হলে আট-দশজন শিক্ষক প্রভোস্ট, ওয়ার্ডেন, হাউজ টিউটর রয়েছেন। একমাত্র তারাই পারবেন এই র্যা গিং বন্ধ করতে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন