চলমান এসএসসি পরীক্ষায় ধারাবাহিকভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে বিষয়গুলোর পরীক্ষা বাতিল হচ্ছে না। মোট অংশগ্রহণকারী পরিক্ষার্থীর তুলনায় ফাঁস হওয়ার প্রশ্ন পাওয়া পরিক্ষার্থীর সংখ্যা ‘খুবই কম’ বলে যুক্তি দেখাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা কথিত এক সমীক্ষার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, পরীক্ষা শুরু হওয়ার আধাঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা আগে যেসব প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে তার সুবিধা পেয়েছে ১০ থেকে ১৫ হাজার পরিক্ষার্থী। মোট পরিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০ লাখের বেশি। অভিন্ন প্রশ্নপত্রে হওয়া পরীক্ষা বাতিল হলে সকল শিক্ষার্থীই মানসিক চাপের মধ্যে পড়বে।
আবার এই প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনাকে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্টের ষড়যন্ত্র বলেও দেখছে মন্ত্রণালয়। পরীক্ষা বাতিল হলে ষড়যন্ত্রকারীরাই সফল হবে বলে মনে করেন তারা। এ কারণে পরীক্ষা বাতিলের চেয়ে পরবর্তীতে প্রশ্নপত্র যাতে ফাঁস না হয় সে বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে প্রায় ৩০০ ফোন নম্বর বাতিল হবে কিনা এর সুপারিশ দিতে গঠিত কমিটির হাতে এসে পৌঁছেছে। এসব নম্বরধারীদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ ব্যবস্থা নেবে। পরীক্ষা আইন ও সাইবার অপরাধে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাওশির বেশকিছু কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের পরিক্ষা বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে এর সঙ্গে যুক্তদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে যাতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো ঘটনা না ঘটে।
মন্ত্রণালয়ের দাবি, গত কয়েকদিনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে গঠিত কমিটির দফায় দফায় বৈঠক হয়। ফলে প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত সন্দেহে বেশকিছু ব্যক্তি ধরা পড়েছে।
এদিকে প্রশ্নপত্র ফাঁস মূল্যায়ন কমিটির আহ্বায়ক কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিব মো. আলমগীর পরিবর্তন ডটকমের এ প্রতিবেদকে বলেন, ‘আমরা প্রশ্নপত্র ফাঁসের তথ্য পেয়েছি। এখন পরীক্ষা বাতিল করা হবে কি না সেই সিদ্ধান্ত নেবেন শিক্ষামন্ত্রী। আমাদের কমিটির কাজ হচ্ছে তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করে সুপারিশ করা। আমরা সেটিই করব।’
পরীক্ষা শুরুর আগের দিন আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছিলেন, ‘যখনই কোনো প্রশ্ন ফাঁস হবে, আমরা খবর পেলে সঙ্গে সঙ্গে ওই পরীক্ষা বাতিল ঘোষণা করব।’
তবে চলমান এসএসসির আটটি বিষয়ে পরীক্ষার আগেই সামাজিক মাধ্যমে প্রশ্ন আসার প্রমাণ মিললেও এ পর্যন্ত বাতিল হয়নি একটি পরীক্ষাও।
উল্টো শিক্ষামন্ত্রীর মুখে এখন ভিন্ন সুর। গত সপ্তাহে তিনি গণমাধ্যমকে বলেছেন, ফাঁস হওয়া প্রশ্ন থেকে সুবিধা পাওয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। তার খেসারত সারাদেশের ২০ লক্ষাধিক শিক্ষার্থীর দেয়ার সুযোগ নেই।
অন্যদিকে শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী কাজী কেরামত আলী পরিবর্তন ডটকমকে সাফ জানিয়ে দেন, ‘আমরা আপাতত পরীক্ষা বাতিল নিয়ে ভাবছি না।’
তিনি বলেন, পরীক্ষায় আর যাতে প্রশ্ন ফাঁস না হয় সেজন্যে যারা এসব ঘৃণ্য কাজে জড়িত তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা ওপর জোর দিচ্ছি। দ্বিতীয়ত, প্রশ্ন প্রস্তুত থেকে পরীক্ষার হলরুম পর্যন্ত পৌঁছাতে সব জায়গায় বিশেষ তদারকি বাড়িয়েছি। আশা করছি, এ পরিস্থিত থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে।
প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং জড়িতদের গ্রেফতার করা হলেও পরীক্ষা বাতিল না হওয়া কি সাংঘর্ষিক নয়- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সচিবালয়ে নিজ দফতরে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, ‘এ বিষয়ে কথা বলবেন শিক্ষামন্ত্রী। তবে আপনারাই ইতোমধ্যে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ করেছেন জড়িত সন্দেহে বেশকিছু ব্যক্তি ধরা পড়েছে।’
ফাঁস হওয়া বিষয়ের পরীক্ষা বাতিল প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ছে। আমি জানি না এটা বড় কোনো ষড়যন্ত্র কিনা। তিনি পুরো জাতিকে মূর্খ করে ছাড়বেন যাতে আমরা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সম্বন্ধে কোনো ধারণাই না থাকে। এতে করে একটা দেশকে শাসন করতে সুবিধা হয়।’
তিনি বলেন, ‘জাতিকে মূর্খ রাখতে পারলে তারা কিছু বুঝবে না। প্রতিবাদ করার জ্ঞানও অর্জন করতে পারবে না। আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষই তো রাজনৈতিক ব্যবস্থাটাই বোঝে না। আমি অনেকের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি।’
ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘আমি আমেরিকায় ১৮ বছর ছিলাম। সেখানেই আমার ছেলে-মেয়েরা বড় হয়েছে। সেখানে ৯ম শ্রেণি থেকে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত মোট পাঁচবার আমেরিকার ইতিহাস এবং সরকার বিষয়ে পড়ানো হয়।’
সরকারের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘আর আমার দেশের অবস্থা দেখুন। আপনি (সরকার) তো জাতি শিক্ষিত করতে চান না। আমরা কী বলবো বলেন? এই যে দেখুন রাস্তাঘাটে বসন্ত উৎসব করছে। কী করছে তারা?’
‘অথচ আমরাও যখন ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি, তখন আমাদের ক্লাসের পর লাইব্রেরিতে যেতে হতো। তখন ফটোকপি সিস্টেম ছিল না, বই পড়ে খাতায় নোট নিতে হতো। আর এ ছেলেমেয়েগুলো এরকম রাস্তায় রাস্তায় হই হই করে কেন? ওরা তো পড়লেখা করে না। এ কারণেই প্রশ্ন ফাঁসের মহোৎসব চলছে। আর এটা বন্ধ না করে তাতে সহায়তা করছে সরকার’ যোগ করেন এই শিক্ষাবিদ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন