পাঁচ দিন হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ফিন্যান্স বিভাগের ২২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী তরুণ হোসেন আত্মহত্যা করেছেন। ১৪ ফেব্রুয়ারি হাজারীবাগের একটি নির্মাণাধীন ভবনের ৬ তলা থেকে লাফ দিয়ে তরুণের আত্মহত্যার পর কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমে অনুমানের ভিত্তিতে আত্মহত্যার কারণ হিসেবে আর্থিক সংকট, তরুণের গায়ের রং, বন্ধুদের হাসি তামাশা, গণরুমের জীবন নিয়ে বিষণ্নতায় ভোগাকে দায়ী করা হয়। স্যার এ এফ রহমান হলে তরুণের সঙ্গে একই কক্ষে থাকা সহপাঠী, হলের বড় ভাই, একই বিভাগে পড়া বন্ধুবান্ধব এবং ফিন্যান্স বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থীর অবশ্য দাবি, তাকে বিষণ্নতা এবং চরম হতাশার দিকে ঠেলে দেয়ার জন্য ফিন্যান্স বিভাগ দায় এড়াতে পারে না। তবে, ওই বিভাগ থেকে ব্যক্তিগতভাবে কমপক্ষে একজন শিক্ষকের সহায়তা ও সমর্থন পেয়েছেন তরুণ হোসেন।
তরুণের বন্ধু ছিল না, তার গায়ের রং নিয়ে হাসি-ঠাট্টা হতো এবং আর্থিক সংকটে বিষণ্নতায় ভুগতো এমন কারণগুলোকে নাকচ করে এ এফ রহমান হলে তরুণের সঙ্গে একই কক্ষে দুই বছর থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফিন্যান্স বিভাগের ২২তম ব্যাচেরই এক শিক্ষার্থী বলেন: তরুণকে ফিন্যান্স বিভাগের মোশাররফ স্যার আর্থিক সহায়তা দিতেন, আমরা বইপত্র কেনার ব্যাপারে সাহায্য করতাম, তরুণের ভাই টাকা দিতো এবং আত্মহত্যার কয়েকদিন আগেই সে হাজারীবাগে একটি টিউশনিও পেয়েছিলো। সে আসলে সব সময় ওই কোর্সে ফেল করা নিয়ে ভাবতো।
তরুণকে কাছ থেকে দেখা,পরিচিতদের ভাষ্যমতে ফিন্যান্স বিভাগে প্রথম বর্ষের বিজনেস ম্যাথ-১ নামের একটি কোর্সে পর পর দুইবার ফেল করায় তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় ভুগতো সে। ফিন্যান্স বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থীর দাবি, এই কোর্সের একজন শিক্ষককের আচরণ সহযোগিতামূলক নয়; বরং অনেক ক্ষেত্রে আতঙ্কিত করার মতো।
তাই তরুণের আত্মহত্যার পর তার সহপাঠী এবং ফিন্যান্স বিভাগের অন্য ব্যাচের কয়েকজন বিভাগের অতি কঠোর এবং অসহযোগিতামূলক আচরণ নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। এসব স্ট্যাটাসের কারণে কোর্সের শিক্ষক পাল্টা এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে ফিন্যান্স বিভাগকে দায়ী করার সমালোচনা করেন। নিজের ওই স্ট্যাটাসের একটি কমেন্টে বিভাগকে দায়ী করে লেখা শিক্ষার্থীদের ‘সাপ’ বলে আখ্যায়িত করে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়ার হুমকিও দেন তিনি।
একজন শিক্ষক এমন আচরণ করতে পারেন কিনা, এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলে ফিন্যান্স বিভাগের কয়েকজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষার্থী ক্লাসরুমে ওই শিক্ষকের আচরণ এবং ফেসবুকে পেশাগত মর্যাদার সাথে সাংঘর্ষিক আচরণের নজীর হিসেবে পহেলা ফাল্গুন নিয়ে তার একটি স্ট্যাটাস এবং কমেন্টের স্ক্রিনশট তুলে ধরেন।
শিক্ষার্থীদের পহেলা ফাল্গুন নিয়ে আগ্রহকে কটাক্ষ করে লেখা ওই শিক্ষকের স্ট্যাটাস
স্ট্যাটাসের কমেন্টে ফাল্গুনে ক্লাস হবে কিনা জানতে চেয়ে ফোন করলে কী হবে তার জবাবে ওই শিক্ষকের মন্তব্য
এই স্ক্রিনশটগুলো ছাড়াও ক্লাসরুমে ওই শিক্ষকের আচরণ তুলে ধরে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফিন্যান্স বিভাগের ২২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী অর্থাৎ তরুণের আরেক সহপাঠী বলেন: তিনি ক্লাসে রেস্টুরেন্টে খাওয়া, আইবিএ’র শিক্ষার্থীদের তুলনায় আমরা কিছুই না, ইংরেজি বলতে পারি না এমন সব বিষয় নিয়ে হেয় করেন। যেসব শিক্ষার্থী পড়াটা বোঝে না, প্রেজেন্টেশনে ইংরেজি বলতে গিয়ে জড়তা প্রকাশ করে; তিনি তাদেরকে ফিন্যান্স বিভাগে কেন ভর্তি হয়েছে এরকম প্রশ্ন করেন। এমনও বলেছেন যে, এমন শিক্ষার্থীর জায়গা কলাভবনে হওয়া উচিৎ। কোন অ্যাসাইনমেন্ট পেপার কিংবা প্রেজেন্টেশন পছন্দ না হলে তিনি ক্লাসে উপযোগী এবং শিক্ষকসুলভ নয় এমন অকথ্য ভাষা প্রায়ই ব্যবহার করেন। এই শিক্ষক তরুণদের সেকশনে বিজনেস ম্যাথ-১ কোর্সটি পড়িয়েছেন। এই শিক্ষকের কোর্সে তরুণ পর পর দুইবার ফেল করলেও অপেক্ষাকৃত কঠিন বিজনেস ম্যাথ-২ কোর্সে তরুণ ঠিকই পাস করেছিলেন। ওই কোর্সটি নিয়েছিলেন অন্য শিক্ষক।
১৯তম ব্যাচের একজন শিক্ষার্থী বলেন: তার (ম্যাথ-১ এর অালোচিত ওই শিক্ষক) আচরণ রুক্ষ। তরুণ আত্মহত্যা করার পর আমরা সারাদিন থেকে লাশ ওর পরিবারের দায়িত্বে দিয়ে এলাম। অন্যদিকে আমাদের ওই শিক্ষক ফেসবুক পোস্টে চাপ নিতে না পেরে আত্মহত্যা করার সমালোচনায় মুখর হলেন। যেসব শিক্ষার্থী তরুণের মৃত্যুর জন্য বিভাগের কারো কারো অমানবিক আচরণকে দায়ী করেছেন, তাদের তিনি ‘সাপ’ আখ্যায়িত করে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দিলেন।
শিক্ষার্থীদের এসব অভিযোগ সম্পর্কে ওই শিক্ষকের বক্তব্য জানতে চ্যানেল আই অনলাইন থেকে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে বেশ কয়েকবার কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
শুধু ওই কোর্স এবং কোর্সের ওই শিক্ষক নয়, ফিন্যান্সের কয়েকজন শিক্ষার্থীর ভাষ্যমতে: বিভাগের অফিস, শিক্ষার্থীদের মানসিক সহায়তা দেয়ার দায়িত্বে থাকা শিক্ষকের আচরণও সহায়তামূলক নয়; বরং রুক্ষ, অপমানজনক এবং অমানবিক।
তরুণের আত্মহত্যার পর ফিন্যান্স বিভাগের কিছু শিক্ষকের অমানবিক আচরণের কথা ফেসবুকে তুলে ধরেন একজন নারী শিক্ষার্থী।
বিভাগে শিক্ষকদের আচরণ তুলে ধরে নারী শিক্ষার্থীর হতাশা
ফিন্যান্স বিভাগে পড়াশোনার চাপসহ ব্যক্তিগত সমস্যায় ভোগা শিক্ষার্থীদের মানসিক সহায়তার দায়িত্বে আছেন তিন জন শিক্ষক। তবে ফিন্যান্সের কয়েকজন শিক্ষার্থীর অভিযোগ: তারা শিক্ষার্থীদের সহায়তা দেয়ার জন্য নির্ধারিত সময়ে কক্ষেই থাকেন না।
বিভাগের ১৮তম ব্যাচের একজন শিক্ষার্থী মানসিক সহায়তার দায়িত্বে থাকা এক নারী শিক্ষকের মনোভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন: তার কাছে কে মানসিক সহায়তা নিতে যাবে? আমাদের মনে হয় উনার নিজেরই কাউন্সেলিং দরকার। কারণ তিনি বিভিন্ন ব্যাচের ক্লাসে গিয়ে বলেছেন যে, আমরা যে বেতন দিই সেই টাকায় এসব আশা করাটা বাড়তি। কারণ আমরা নাকি ২০-৩০ টাকা দিই। অথচ তিনি ইভিনিং এমবিএ-তে ক্লাস নিয়ে ৮ হাজার টাকা পান।
আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়ার আগে তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় তরুণ এই শিক্ষকের কাছে কোনদিন গিয়েছিলেন কিনা এই প্রশ্নের উত্তর ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থীরা দিতে পারেননি। তবে ১৯তম ব্যাচের একজন শিক্ষার্থী বলেন: তরুণের আত্মহত্যা নিয়ে গণমাধ্যমের কাছে কিছু বলতে নিষেধ করেছিলেন তিনি।
এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ তুলে ধরে ১৮তম ব্যাচের একজন শিক্ষার্থী বলেন: কেউ মানসিক সহায়তার জন্য তার কাছে গেলে তিনি সেটা গোপন না করে উল্টো ক্লাসে সবার সামনে এসে নাম প্রকাশ না করলেও এমন ভাবে ওই শিক্ষার্থীকে নিয়ে কথা বলেন যাতে সবাই বুঝে যেতো আসলে কার সম্পর্কে বলা হচ্ছে!
তিনি যে নির্ধারিত সময়ে নিজের কক্ষে থাকেন না এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে গিয়ে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের মানসিক সহায়তা দেয়ার নির্ধারিত সময়ে তার দরজায় তালা ঝুলছে।
বিকাল ৫টা পর্যন্ত এই কক্ষে শিক্ষার্থীদের সমস্যা শোনার কথা থাকলেও ৪টাতে গিয়ে দেখা যায় তালা ঝুলছে
কুষ্টিয়া জেলা থেকে এইচএসসিতে সেরা ফলাফল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা বিভাগে ভর্তি হওয়া তরুণ হোসেন এখন নেই। তরুণের সহপাঠী, হলের বন্ধু, বড় ভাইদের আক্ষেপ ১৪ তারিখে ছেলেটি আত্মহত্যা করেছে জানার পরও ১৫ তারিখে ফিন্যান্স বিভাগে নবীনবরণ হয়েছে।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, তরুণ হোসেনের আত্মহত্যার কারণ খতিয়ে দেখতে পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হল প্রশাসন।
হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম খান চ্যানেল আই অনলাইনকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। আগামীকালের মধ্যে এই কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
হলের পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠন করা হলেও বিভাগের পক্ষ থেকে শোকবার্তা বা কোন ধরণের প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি।
বিভাগের পক্ষ থেকে তরুণের আত্মহত্যার ব্যাপারে কোন প্রতিক্রিয়া জানানো হবে কিনা, মোবাইল ফোনে জানতে চাইলে বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কিসমাতুল আহসান ক্লাসে আছেন জানিয়ে ফোন কেটে দেন। পরে তার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন