রোববার রাতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মো. আখতারুজ্জামানের বাসভবনে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা।
রাত ১টার দিকে এ হামলা চালানো হয় বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক মো. সোহেল রানা।
হামলার সময়ে উপাচার্যের বাসভবনে এ শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন। সোমবার দুপুরে যুগান্তরের কাছে তিনি ঘটনার বিবরণ তুলে ধরেন।
অধ্যাপক সোহেল রানা বলেন, রোববার কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল রাতে আমি ভিসির বাসভবনেই ছিলাম। রাত ১টার দিকে ভিসির সঙ্গে কথা বলছিলাম। এ সময় বাইরে হঠাৎ জয়-বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান শোনা যায়।
তিনি বলেন, কিছু বুঝে ওঠার আগেই বেশ কিছু যুবক লোহার রড ও লাঠি নিয়ে ভিসির বাসভবনে ঢুকে ঘরের দরজা, জানালা, গেস্টরুম, মিটিংরুম, আলমারি, রান্নাঘর, লাইট, ফ্যানসহ অন্যান্য আসবাবপত্র ভাঙচুর করে। এ ছাড়া বাইরে অবস্থানরত দুটি প্রাইভেটকারও ভাঙচুর করে তারা।
এ মনোবিজ্ঞান অধ্যাপক বলেন, হামলাকারীরা শুধু ভাঙচুর করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা ভিসিকে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল ও লাঞ্ছিত করে।
হামলাকারীদের কাউকে চিনতে পেরেছেন কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক সোহেল রানা বলেন, আমি এতটুকু নিশ্চিত যে হামলাকারীদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছিলো না। ছিলো বহিরাগতরা।
হামলার সময় উপাচার্যের বাসভবনের রান্নাঘরে অবস্থান করছিলেন নিরাপত্তারক্ষী হাসান।
যুগান্তরের কাছে ঘটনা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমি রান্নাঘরে চা তৈরি করছিলাম। এ সময় প্রায় ২৫ বছর বয়সী দুজন যুবক রান্নাঘরে ঢুকে আমাকে বেদম প্রহার করে আমার মোবাইল ও মানিব্যাগ কেড়ে নেয়। পরে আমি তাদের কাছ থেকে পালিয়ে দেয়াল টপকে বের হয়ে যাই।
সেখানে কি হয়েছিল, এমন প্রশ্নের জবাবে হাসান বলেন, সেখানে শুধু ভাঙচুরের শব্দ শোনা গেছে।
এদিকে সোমবার এক প্রেসি ব্রিফিংয়ে উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান বলেন, আমার বাসায় যারা এসেছিল তারা মুখোশ পরে এসছিল। লাশের রাজনীতি করতে এসেছিল। প্রাণনাশের জন্য এসেছিল। দেশকে অস্থিতিশীল করতে এসেছিল।
তিনি বলেন, কোটার সঙ্গে আমার কোনো সংযোগ নেই। এর পরও হামলা করা হয়েছে। আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই এ হামলা চালানো হয়েছে।
তিনি বলেন, আমি উদ্যোগ নিয়ে শিক্ষার্থীদের কোটার বিষয়টি সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলোচনার ব্যবস্থা করেছি। শিক্ষার্থীদের বক্তব্য তাদের জানানো হয়েছে। এর পরও আমার বাসায় তাণ্ডব পরিচালিত হয়েছে। এটি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। সেখানে আমার পরিবার ছিল। তাদের জীবন ঝুঁকিতে ছিল। সবাইকে মেরে ফেলার চেষ্টা ছিল। কিছু ছাত্র আমার প্রাণ রক্ষা করেছে। এখানে লাশের রাজনীতি ছিল। এখানে আমাকে হত্যার পরিকল্পনা থেকে এ হামলা করা হয়েছে।
উপাচার্য বলেন, হামলার ঘটনায় অনেক প্রাণহানি ঘটতে পারত। আন্দোলনরত ব্যক্তিরা ৪০-৪৫ মিনিট চেষ্টার মাধ্যমে দরজা ভেঙেছে। আমি নিজের নিরাপত্তার কথা ভুলে শিক্ষার্থীদের অবস্থা দেখার জন্য বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলাম। এ জন্য বেঁচে গেছি। বেডরুমে থাকলে আমি মারা যেতাম।
উল্লেখ্য, রোববার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে থেকে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া পদযাত্রাকে ঘিরে ক্যাম্পাস উত্তাল হয়ে পড়ে।
হাজার হাজার আন্দোলনকারী ক্যাম্পাস থেকে শাহবাগ মোড়ে গিয়ে রাত ৮টা পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন।
এর পর পুলিশ অবরোধকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে অভিযান শুরু করলে আন্দোলনকারীরা ক্যাম্পাসে এসে টিএসসিতে অবস্থান নেন।
রাত পৌনে ১০টার দিকে সেখানে জড়ো হওয়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
পরে রাতভর পুরো ক্যাম্পাসে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। রাত ১টার দিকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের ত্রিমুখী সংঘর্ষের একপর্যায়ে উপাচার্যের বাসভবনে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
ওই সময় সেখানে পুলিশ ও ছাত্রলীগের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়। তখন শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করা হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।
পরে শিক্ষার্থীরা টিএসসিতে এসে অবস্থান নেন। সেখানে তাদের সঙ্গে বিভিন্ন হলের ছাত্রীরাও মিছিল নিয়ে এসে যোগ দেন।
রাত ৩টার দিকে টিএসসিতেও আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ ও ছাত্রলীগ হামলা করে। তখন ছাত্রীরা টিএসসির ভেতরে ও রোকেয়া হলে আশ্রয় নেন। অন্যদিকে ছাত্ররা বাংলা একাডেমি ও পুষ্টি বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে গিয়ে অবস্থান নেন।
সর্বশেষ ভোরে শহীদুল্লাহ হলে জড়ো হন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। সকাল সাড়ে ৬টায় সেখানে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে উপস্থিত হলে উভয়পক্ষে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন