বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হল থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সম্পৃক্ত কয়েকজন ছাত্রীকে বের করে দেওয়ার ঘটনায় ফের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে। নানা প্রশ্নের মুখে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ঢাবি উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান দাবি করেছেন ফেসবুকে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অভিযোগে তাদের হল থেকে বের করে অভিভাবকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে, ফেসবুক থেকে গুজব রটানোর বিষয়টি তদন্তাধীন আছে। এ অবস্থায় ছাত্রীদের হল থেকে বের করে দেওয়ার বিষয়টি কতটা যৌক্তিক। কেউ কেউ বলছেন, দিনের জন্য অপেক্ষা না করে রাতের আঁধারে কেন এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সরকারের প্রতিহিংসামূলক আচরণ এবং ক্ষমতাসীনদের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাবির নগ্ন অবস্থান দৃশ্যমান হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। এর ফলে নিজেদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই অনিরাপদ বোধ করছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
হল থেকে শিক্ষার্থী বের করে দেওয়ার প্রতিবাদে গতকাল শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বের করে দেওয়া ছাত্রীদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হলে ফিরিয়ে আনার আল্টিমেটাম দিয়েছেন কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করে আসা সংগঠন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতারা। তারা বলেছেন, বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে ছাত্রীদের হলে না ফেরালে কঠোর আন্দোলনের ডাক দেওয়া হবে।
শুক্রবার বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে এই হুঁশিয়ারি দেন আন্দোলনকারীরা। এ সময় সুফিয়া কামাল হলের প্রভোস্ট সাবিতা রেজওয়ানা রহমানের পদত্যাগের দাবিও জানিয়েছেন তারা।
এদিকে অনেকের মতে, কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকেই পুরো আন্দোলনকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার কৌশলে হাঁটছে ক্ষমতাসীন দল, দলটির ছাত্র সংগঠনসহ বিভিন্ন মহল। বিশেষ করে আন্দোলনের শুরুর দিন পুলিশের বেপরোয়া হামলা এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের মারমুখী অবস্থান শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে অহেতুক সহিংসতার দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা চলেছে বলে অভিযোগ ওঠে নানা জায়গা থেকে। আন্দোলন চলাকালীন ঢাবির বিভিন্ন আবাসিক হলে আন্দোলনের কর্মীদের মারধর, ক্যাম্পাসে সশস্ত্র মহড়া, হুমকি-ধামকিসহ বিভিন্ন অভিযোগ এসেছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ছাত্রলীগেরই অনেক নেতাকর্মী প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংহতিও প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সুফিয়া কামাল হলের ছাত্রী নির্যাতনের অভিযোগে বহিষ্কার হওয়া ছাত্রলীগ নেত্রী ইফফাত জাহান এশার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের পর পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকে। ক্যাম্পাসের চারদিকে ছাত্রলীগের প্রহরা এবং শোডাউন সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধীরে ধীরে আতঙ্ক বাড়াতে থাকে।
গত ১৬ এপ্রিল (সোমবার) বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের তিন নেতাকে ডিবি অফিসে তুলে নেওয়ার পর এ আতঙ্ক আরও গভীর হয়। ওইদিনের ঘটনার পর থেকে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে দাবি করেছেন আন্দোলনকারী সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে হলে হলে আন্দোলনকারীদের তালিকা তৈরিতে ছাত্রলীগের তৎপরতা, বিভিন্ন জায়গা থেকে হুমকি-ধামকি, যেকোনো সময় মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার আশঙ্কা- ইত্যাদি কারণে প্রতিমুহূর্তের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটাতে হচ্ছে তাদের।
এমনই পরিস্থিতিতে সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাতে সুফিয়া কামাল হল থেকে তিন ছাত্রীকে বের করে দেওয়ার ঘটনা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ফের ক্ষোভ ও চাপা আতঙ্ক তৈরি করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে ‘গুজব’ ছড়ানোর অভিযোগে ছাত্রলীগ ২৬ জন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীর তালিকা তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দিয়েছে। ছাত্রলীগের প্রেসক্রিপশন মেনেই প্রশাসন তালিকার তিন ছাত্রীকে হল থেকে গভীর রাতে বের করে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক শিক্ষার্থী, দেশের বিশিষ্ট লেখক, শিক্ষক, অ্যাক্টিভিস্টরা এ ঘটনাকে নজিরবিহীন, ন্যক্কারজনক ও অগ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করেছেন। তারা বলেছেন- আমাদের স্মরণকালে গভীর রাতে আবাসিক হল থেকে ছাত্রীদের বের করে দেওয়ার ঘটনা ঘটেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, মানবাধিকারকর্মী এবং ঢাবির সাবেক শিক্ষার্থী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেছেন, এ ঘটনা আমাকে স্তম্ভিত করেছে, আমি অবাক যে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্রীদের সঙ্গে এমন আচরণ করতে পারে। এটা ভাবা যায় না।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নজিরবিহীন ছাত্র বিক্ষোভ এবং আন্দোলনকারীদের বিজয়কে ইতিবাচকভাবে দেখছে ক্ষমতাসীন দল ও তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ। ফলে আন্দোলনের কর্মীদের নানা অপপ্রচার, অপবাদ দিয়ে দুর্বল করা অথবা অপদস্ত ও হেনস্তা করার কৌশল নিয়েছে ক্ষমতাসীনরা। ইতোমধ্যে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে জামায়াত-শিবির ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অন্যান্য শক্তির সম্পৃক্ততার অপবাদ রটিয়ে পুরো আন্দোলনটিকে ছত্রভঙ্গ করা হয়েছে বলে মনে করছে বিভিন্ন মহল। কোটা সংস্কারের বদলে কোটা বাতিলে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাটিও আন্দোলনের কর্মীদের ‘বিপদে’ ফেলে দিয়েছে বলে মনে করেন অনেকে।
প্রধানমন্ত্রীর রাগ-ক্ষোভ-অভিমানসুলভ ওই সিদ্ধান্ত কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট উত্তপ্ত পরিস্থিতিকে শান্ত করার বদলে ঘোলাটে করে দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে কোটা সংস্কারকর্মীদের বিরুদ্ধে একটি শক্তিকে প্রকারান্তরে উসকে দেওয়া হয়েছে বলেও মনে করেন কেউ কেউ।
বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক শিক্ষার্থী-শিক্ষক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের কর্মীরা বলছেন, এ অবস্থায় আন্দোলনকারীদের ওপর অব্যাহত মানসিক চাপের কৌশল গ্রহণ করেছে ক্ষমতাসীনরা। ভয়ভীতি ছড়িয়ে, শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে আন্দোলন থেকে কর্মীদের সরাতে চাইছে তারা। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা বলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর যে কোনো ধরনের দমন-পীড়ন ক্ষমতাসীনদের জন্য বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে।
প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগ দাবি
রাতের অন্ধকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুফিয়া কামাল হল থেকে ছাত্রীদের বের করে দেওয়ার প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। পাশাপাশি সংগঠনটির পক্ষ থেকে হলের প্রাধ্যক্ষ সাবিতা রেজওয়ানার পদত্যাগও দাবি করা হয়েছে।
গতকাল বিকেল চারটায় এ প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়। বিক্ষোভ সমাবেশে সংগঠনটির নেতারা কবি সুফিয়া কামাল হল থেকে বের করে দেওয়া শিক্ষার্থীদের সম্মানের সঙ্গে হলে ফিরিয়ে আনার দাবি জানান।
সংগঠনটির যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খাঁন বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। আন্দোলনকারীদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। আমরা দুই মাস আন্দোলন করেছি। কিন্তু যখনই আন্দোলন সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে তখনই হুমকি দেওয়া হচ্ছে। হলে হলে বাধা দেওয়া হচ্ছে। আন্দোলনে যেতে বাধা দেওয়া হচ্ছে।
এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনের ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু এখন আন্দোলন করতে গেলে বাধা আসে। প্রশাসনকে বলতে চাই, হেনস্তা করবেন না। হলে সুন্দরভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করুন। হল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিন। আজ আমাদের এই বিক্ষোভ কর্মসূচিতে মেয়েদের উপস্থিতি কম। কারণ তাদের ভয় দেখানো হচ্ছে।’
সংগঠনটির আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক বলেন, ছাত্রীদের মিথ্যা ভয়ভীতি দেখিয়ে কবি সুফিয়া কামাল হল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। অতি দ্রুত সম্মানের সঙ্গে ওই ছাত্রীদের হলে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানাই। নয়তো ছাত্র সমাজ আবার রাজপথে নামবে। তিনি আরও বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রাধ্যক্ষের একটি অডিও রেকর্ড ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে তিনি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত দুই হাজার ছাত্রীকে বহিষ্কারের কথা বলেন। আমরা বলতে চাই, এই ঘটনার মাধ্যমে হল প্রশাসনের নৈতিক অবক্ষয় ঘটেছে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলঙ্কিত অধ্যায় রচিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান রক্ষার্থে হল প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগ দাবি করে নুরুল হক বলেন, ছাত্র সমাজের স্থান ক্লাসে, তাদের রাজপথে নামতে বাধ্য করবেন না।
প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে নুরুল হক বলেন, কোটার বিষয়টি নিয়ে তার সন্তানদের মধ্যে অস্থিরতা বিরাজ করছে। অতি দ্রুত প্রজ্ঞাপন জারি করে সন্তানদের অস্থিরতা দূর করুন। এক প্রশ্নের জবাবে নুরুল হক বলেন, নিরপরাধ কাউকে হয়রানি করা হলে তারা প্রতিবাদ করবেন। কিন্তু কেউ যদি সহিংসতায় জড়িত থাকে তার দায়ভার তারা নেবেন না।
প্রসঙ্গত, ফেসবুকে বিভ্রান্তিকর পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে বৃহস্পতিবার রাতে ওই ছাত্রীদের হল থেকে বের করে দিয়েছে কবি সুফিয়া কামাল হল কর্তৃপক্ষ। হলের সাধারণ ছাত্রীরা অভিযোগ করেছেন, হলের প্রাধ্যক্ষ ছাত্রীদের ছাত্রত্ব বাতিল, গোয়েন্দা নজরদারি ও মামলার ভয় দেখাচ্ছেন।
ছাত্রীদের হল থেকে বের করে দেওয়া প্রসঙ্গে হলের প্রাধ্যক্ষ ও যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সাবিতা রেজওয়ানা বলেন, ‘আমরা বেশ কয়েকজন ছাত্রীকে ডেকেছি। তাদের মোবাইল চেক করা হয়েছে। তারা ফেসবুকে ফেক অ্যাকাউন্ট খুলে গুজব ছড়াচ্ছে। মুচলেকা দিয়ে স্থানীয় অভিভাবকদের সঙ্গে তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
অভিভাবকের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে : ঢাবি উপাচার্য
কবি সুফিয়া কামাল হল থেকে রাতের বেলায় ছাত্রীদের বের করে দেওয়ার অভিযোগ বিষয়ে নিজের বক্তব্য দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান। এ প্রসঙ্গে উপাচার্য বলেন, অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়াতে সুফিয়া কামাল হলের তিন ছাত্রীকে অভিভাবক ডেকে এনে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
উপাচার্য বলেন, ফেসবুকে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে ‘সরকারবিরোধী বক্তব্য ও অপতথ্য ছড়ানোর কারণে’ কবি সুফিয়া কামাল হলের তিন ছাত্রীকে অভিভাবকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। ‘দোষী’ তিন ছাত্রীকে অভিভাবকদের হাতে তুলে দিয়ে হল প্রশাসন ‘সঠিক’ কাজ করেছে দাবি করে তিনি বলছেন, এটা না করলেই বরং তিনি হল কর্তৃপক্ষকে দোষারোপ করতেন।
গতকাল সকালে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে উপাচার্য এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে গুজব, উসকানি ও মিথ্যা কথা ছড়ানো হচ্ছে। কোনো গুজবে কান দেবেন না। সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোনো ধরনের হয়রানি করা হবে না। তিনি বলেন, হল কর্তৃপক্ষ অভিভাবকসুলভ আচরণ করেছে।
উপাচার্য বলেন, ‘আন্দোলনকারী আর উসকানিদাতা এক নয়। আন্দোলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ঐতিহ্যপূর্ণ। এটা খুব স্বাভাবিক। যৌক্তিক দাবিতে আন্দোলন করতে পারে যে কেউ। তবে উসকানি দেওয়া আর আন্দোলন এক নয়। আমরা আন্দোলনকে সমর্থন করি, উসকানিকে নয়।’ কোটা সংস্কার আন্দোলন সাধারণ শিক্ষার্থীদের হলেও এতে অপশক্তি ঢুকে গিয়েছিল বলে তিনি মনে করেন। সেই অপশক্তিই নাশকতার সঙ্গে জড়িত বলে জানান উপাচার্য।
আখতারুজ্জামান জানান, কোনো সাধারণ শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হয়রানি করেনি। হাজার হাজার শিক্ষার্থী এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিল। এর মধ্যে মাত্র ২৫/২৬ জনকে চিহ্নিত করেছে তদন্ত কমিটি। তিনি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত না হয়ে কোনো সংবাদ পরিবেশন করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ভুল সংবাদ বিভ্রান্তি তৈরি করে।
‘হল থেকে ছাত্রী তাড়িয়ে পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর করতে চাচ্ছে প্রশাসন’
রাতের অন্ধকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুফিয়া কামাল হল থেকে ছাত্রীদের বের করে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি করতে চাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার রক্ষা পরিষদের যুগ্ম আহŸায়ক নুরুল হক নুরু।
তিনি বলেছেন, রাত ১১টার পরেও অনেক ছাত্রী হল থেকে বের হয়ে গেছেন বলে খবর পেয়েছি। অনেকের মোবাইল কেড়ে নেওয়া হয়েছিল এবং প্রাধ্যক্ষের কক্ষে আটকে রাখা হয়েছিল। পরে অভিভাবক ডেকে রাতের অন্ধকারে হল ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে ছাত্রীদের।
নুরুল হক বলেন, কোনো অপরাধ করলে আইনানুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু এভাবে রাতের অন্ধকারে হল থেকে বের করে দিয়ে প্রশাসন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাচ্ছে।
গত বৃহস্পতিবার রাতে কবি সুফিয়া কামাল হলের বেশ কয়েকজন ছাত্রীকে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়। এর প্রতিবাদে রাত ২টার দিকে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতারা সেখানে উপস্থিত হয়ে বিক্ষোভ করেন। এ সময় তারা স্লোগন দেন ‘ভয় দেখিয়ে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না, আমার বোন পথে কেন, প্রশাসন জবাব চাই।’ প্রতিবাদে পরের দিন গতকাল শুক্রবার সারা দেশে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেন সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতারা।
বিক্ষোভ চলাকালীন হলের ভেতর থেকে কয়েকজন ছাত্রলীগ নেত্রী ফটকের কাছে এসে জানান, হলে কোনো সমস্যা হয়নি, আপনারা চলে যান। এ সময় বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা প্রাধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করতে চান। কিন্তু ছাত্রলীগ নেত্রীরা তখন কিছু না বলে ভেতরে চলে যান। রাত ৯টা থেকে অন্ততপক্ষে ৫০ জনকে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে বলে চাউর হয়। তবে এদের সবাইকে একসঙ্গে বের করে দেওয়া হয়নি।
গভীর রাতে হল থেকে ছাত্রী বিতাড়নের ঘটনায় সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন বলেন, এটি হল প্রশাসনের ধৃষ্টতা। আমরা প্রশাসনকে সব সহযোগিতা করছি। এর মধ্যে কোনো আলোচনা ছাড়াই কেন তারা এমন সিদ্ধান্ত নিল, আমরা তার জবাব চাই।
প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিজেই হলছাড়া
কবি সুফিয়া কামাল হলের তিন ছাত্রীকে অভিভাবকের হাতে তুলে দেওয়ার প্রতিবাদ করতে গিয়ে আর হলে ঢুকতে পারেননি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের শিক্ষার্থী ইয়াসিন আরাফাত।
ইয়াসিন স্যার এএফ রহমান হলে ৪০৭ নম্বর কক্ষে থাকতেন। তিনি জানান, গেল বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে সুফিয়া কামাল হল থেকে নিজের হলে ফেরার পর তাকে হল ছেড়ে চলে যেতে বলেন ছাত্রলীগের নেতারা।
এখন তিনি বুয়েটের একটি হলে পরিচিত এক ‘বড় ভাইয়ের’ কাছে আছেন। ইয়াসিন জানান, হল থেকে বের হয়ে এলেও তিনি তার জিনিসপত্র নিতে পারেননি। তবে তিনি এখন বুয়েটের কোন হলে আছেন, নিরাপত্তার কারণে সেই হলের নাম জানাতে চাননি।
বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে কবি সুফিয়া কামাল হলের বেশ কয়েকজন ছাত্রীকে হলত্যাগে বাধ্য করার অভিযোগ ওঠে হল প্রশাসনের বিরুদ্ধে। অভিভাবকদের ডেকে পাঠিয়ে রাতেই তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় ছাত্রীদের।
এর প্রতিবাদে রাত দেড়টার দিকে ইয়াসিন একাই প্রভোস্টের পদত্যাগের দাবিতে হলের ফটকে অবস্থান নেন। পরে রাত ২টার দিকে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করা সংগঠন ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’-এর নেতারা ইয়াসিনের সঙ্গে যোগ দেন। তারাও সেখানে বিক্ষোভ করেন।
পরিষদের নেতারা গতকাল বিকাল ৪টায় বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করলে রাতের অবস্থান কর্মসূচি শেষ করেন আরাফাত। তারপর হলের দিকে ফেরত যান বিক্ষোভকারী সবাই।
কিন্তু এফ রহমান হলে ঢোকার সময় ফটকে হল ছাত্রলীগের সভাপতি হাফিজুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসানসহ অনেকে অবস্থান নিয়ে তাকে বাধা দেন।
এ প্রসঙ্গে ইয়াসিন আরাফাত বলেন, ‘ছাত্রলীগের মাধ্যমেই হলে উঠেছিলাম। প্রতিবাদ করে ফেরার পর ছাত্রলীগের নেতারা আমাকে ডাকেন। বিক্ষোভে কেন গেলাম, তা জানতে চান। হলে উঠলে কোনো অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির দায়িত্ব নেবেন না বলে জানিয়ে দেন।’
‘এছাড়া নানা হুমকি দেওয়া হয়। আমাকে চলে যেতে বলা হয়। আমাকে রুমে রাখার জন্য রুমমেটকে শাসানো হয়।’
তবে ইয়াসিনকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এফ রহমান হল ছাত্রলীগের সভাপতি হাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘প্রত্যেকটা মানুষের নিজস্ব চিন্তা চেতনা আছে এবং সে তা চর্চা করবে। আর বিশ্ববিদ্যালয় হলো সে চেতনা চর্চার কেন্দ্র। এখানে আমি বাধা দেওয়ার কেউ না। তবে শিক্ষার্থীদের এ চিন্তা-চেতনা যাতে স্বাধীনতাবিরোধী না হয় সেদিকে আমরা সবসময় খেয়াল রাখি।’
হল গেটে ইয়াসিনের সঙ্গে কী কথা হয়েছিল জানতে চাইলে হাফিজ বলেন, ‘আমি তার রুম নাম্বার জিজ্ঞেস করেছিলাম। এবং জিজ্ঞেস করেছিলাম তাদের পরবর্তী প্রোগাম কখন।’
হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান তুষার ইয়াসিনের বিষয়টিতে কিছু জানা নেই বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেন, ‘এ নামে আমি তো কাউকে চিনিই না। হল থেকে বের করব কীভাবে?’।
তবে হল শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা জানান, হলে ঢোকার সময় গেটে ইয়াসিনের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলেন হলের কয়েকজন নেতা। পরে তাকে হল থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য করা হয়।
আলোচনায় ফেসবুক গুজব
যতদিন ধরে কোটা সংস্কারের আন্দোলন চলছে ততদিন ধরেই ঘুরেফিরে আলোচনায় এসেছে ফেসবুক। এ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন গুজব আর অপপ্রচার চালানোর অভিযোগ উঠেছে থেকে থেকে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুফিয়া কামাল হল থেকে ছাত্রীদের বের করে দেওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে তারা ফেসবুকের মাধ্যমে ‘গুজব’ ছড়াচ্ছে।
হল প্রাধ্যক্ষ সাবিতা রেজওয়ানা বলেন, ‘আমরা বেশ কয়েকজন ছাত্রীকে ডেকেছি। তাদের মোবাইল চেক করা হচ্ছে। তারা ফেসবুকে ফেক অ্যাকাউন্ট খুলে গুজব ছড়াচ্ছে। মুচলেকা দিয়ে তাদের স্থানীয় অভিভাবকদের সঙ্গে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’
অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান বলেছেন, ফেসবুকে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে ‘সরকারবিরোধী বক্তব্য ও অপতথ্য ছড়ানোর কারণে’ কবি সুফিয়া কামাল হলের তিন ছাত্রীকে অভিভাবকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সময় সময় ফেসবুকের মাধ্যমে ‘বিভ্রান্তিকর’ তথ্য ছড়ানোর কথা বললেও মধ্যরাতে ছাত্রীদের হল থেকে বের করে দেওয়ার ব্যাপারটিই এখন বিভ্রান্তিকর ঠেকছে অনেকের কাছে। কারণ, কোন তথ্যটি অপতথ্য কিংবা সরকারবিরোধী, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো বক্তব্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে পাওয়া যায়নি। কীভাবে মধ্যরাতে হল থেকে বের করে দেয়ওার মতো অপরাধ হয়, সেটাও পরিষ্কার করা হচ্ছে না।
এর আগে ছাত্রলীগের এক নেত্রী কর্তৃক কোটা সংস্কারের জন্য আন্দোলনকারী সুফিয়া কামাল হলের এক ছাত্রীর পায়ের রগ কাটা নিয়ে ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে যায়। তারও আগে উপাচার্যের বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় দায়ী করা হয় আরেকটি গুজবকে, যেখানে বলা হয়েছিল আন্দোলনের সময় পুলিশের টিয়ারশেলের আঘাতে এক আন্দোলনকারী মারা গেছে। এছাড়া এ আন্দোলন নিয়ে ফেসবুকে নানা সময় নানা আলোচনা হয়েছে, হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং ছাত্রলীগ থেকে বারবার অভিযোগ করা হচ্ছে, মাঠের আন্দোলনের পাশাপাশি ফেসবুকে বিভিন্ন অপপ্রচার বা গুজব চালানো হচ্ছে, যেটা বিশ্ববিদ্যালয়কে অশান্ত করে তুলতে পারে। একইভাবে এও দেখা যাচ্ছে যে, বিভিন্ন আইডি থেকে আন্দোলনকারীদের জামায়াত-শিবির প্রমাণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাই এ আন্দোলন প্রসঙ্গে এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে ফেসবুক।
বলা হচ্ছে, কোটা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার আগে তো বটেই, এমনকি বর্তমান সময় পর্যন্তও গুজব ছড়িয়েই একটা পক্ষ আন্দোলনকে ভিন্ন মাত্রা দেওয়ার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষই এখন হার্ডলাইনে।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মৃত্যু ও রগ কাটার মতো মিথ্যা তথ্য প্রচার করে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে যারা সহিংস করে তুলেছে তাদের খুঁজে বের করে আইনের মুখোমুখি করা হবে। পুলিশ প্রাথমিকভাবে ফেসবুকে ২০০টির মতো অ্যাকাউন্টকে সন্দেহ করেছিল। তবে শেষ পর্যন্ত বিভিন্নভাবে খতিয়ে দেখার পর এ সংখ্যা নেমে এসেছে প্রায় ৩০টিতে।
এ নিয়ে রমনা থানায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনে একটি মামলাও দায়ের করা হয়েছে। মামলাটি করা হয়েছে পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের পক্ষ থেকে। এজাহারে কারও নাম-ঠিকানা উল্লেখ করা হয়নি। তবে এর সঙ্গে বিভিন্ন ফেসবুক আইডির নাম ও পোস্টও যুক্ত করা হয়েছে।
সাইবার ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত উপকমিশনার নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে আন্দোলনের ডাক দেওয়া একটি গণতান্ত্রিক বিষয়। কিন্তু কিছু লোক যখন মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে ফেসবুকের অপব্যবহার করে সহিংসতায় প্ররোচনা দেয় তখন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।’
এ বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে যে পরিমাণ গুজব ছড়ানো হয়েছে, উসকানি দেওয়া হয়েছে তাতে সাধারণ মানুষের বিষয়ে সরকার দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। কিন্তু পরিস্থিতিকে যে রকম বিপজ্জনক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেটার বিষয়ে অনেকেরই বক্তব্য কিংবা দৃষ্টিভঙ্গি নেই।’
সবাই একযোগে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও কী উপায়ে সেই আইডিগুলো চিহ্নিত করা হবে, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো মতামত পাওয়া যায়নি। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, এতে করে হয়রানির শিকার হবে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা। এর আগেও বিভিন্ন সময় ব্যবস্থার নামে হয়রানির ঘটনা ঘটেছে বলে সেই আশঙ্কা আরও দৃঢ় হচ্ছে।
বাস্তবতা এমন যে, ফেসবুকে আসলে কে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে, সঠিকভাবে সেই ব্যক্তিকে খুঁজে বের করা খুবই মুশকিল। বিশেষজ্ঞরা সেটা বারবার বলেছেনও। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ও এমনটা বলেছেন- ‘ফেসবুকে অপপ্রচার সারা দুনিয়াতেই হচ্ছে। এটি বিপজ্জনক। কিন্তু এটিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।’
এ ধরনের আচরণ বন্ধ হোক
সুলতানা কামাল, মানবাধিকারকর্মী
গতকাল রাতের ঘটনা আমাকে স্তম্ভিত করেছে, আমি স্তম্ভিত। আমি অবাক, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এরকম একটি আচরণ করতে পারে, এটা ভাবা যায় না। কেউ যদি ভুল করে থাকে, তাহলে প্রতিষ্ঠানের নিয়মানুযায়ী, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। আমার মনে হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে কোথাও লেখা নেই, রাত ১২টার সময় কোনো ছাত্রীকে স্থানীয় অভিভাবকের হাতে তুলে দেওয়া যায়। নিয়ম ভেঙে যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা অগ্রহণযোগ্য। এটা অত্যন্ত খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আমরা আশা করব, ঘটনা আসলে কী হয়েছে, সেটা পরিষ্কারভাবে জানানো হবে। কারও যদি দোষ-ত্রুটি থেকে থাকে, তাহলে নিয়মসিদ্ধভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এ ধরনের আচরণ যেন অবিলম্বে বন্ধ হয়।
প্রেসক্রিপশন ছাত্রলীগের
জোবাইদা নাসরীন
শিক্ষক, ঢাবি
গভীর রাতে সুফিয়া কামাল হল থেকে ছাত্রী বিতাড়নের ঘটনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটা করার ক্ষমতা রাখে না। শুনেছি, ছাত্রীদের ফোন ক্রোক করা হয়েছিল আর সে ফোনের তথ্য যাচাই করেছে হল কর্তৃপক্ষ। এটাও একটা ভয়ঙ্কর অপরাধ করেছে। কারণ সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া কারও ফোন তল্লাশি করা অন্যায়। যদি সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকে এবং এ ব্যাপারে মামলা থাকে পুলিশ সে ফোনের তথ্য যাচাই করতে পারে। ফোনে তো প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগত বিষয়-আশয় থাকে। শিক্ষার্থীদের ব্যক্তি স্বাধীনতা ও গোপনীয়তা ক্ষুণ্ন করতে পারে না হল কর্তৃপক্ষ।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের পর থেকে ছাত্রলীগ উঠেপড়ে লেগেছে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মীদের হেনস্তা করতে। এটা তারই অংশ বলে মনে হয়। শুনেছি ছাত্রলীগের প্রেসক্রিপশনে ২৬ জনের নাম উঠে এসেছে, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়েছে গুজব ছড়ানোর। এ তিন ছাত্রী সে তালিকাভুক্ত। কিন্তু কথা হচ্ছে বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তদন্ত করছে। তদন্তাধীন অবস্থায় ছাত্রীদের এভাবে হেনস্তা করার অধিকার কারও নেই। খোঁড়া যুক্তি দেখানো হয়েছে- হলে থেকে নাকি তারা গুজব ছড়াবে। যারা গুজব ছড়ায় তারা হলের বাইরে বাসায় গিয়ে গুজব ছড়াতে পারে না?
আমি নিজেই ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের হাউজ টিউটর। আমরা ছাত্রীদের নিরাপত্তার ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকি। তারা আমাদের সন্তানের মতো। কোনো ছাত্রীকে রাতের অন্ধকারে বের করে দেওয়া উচিত নয়। তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি ভাবা উচিত ছিল। পরের দিন (গতকাল) তো শুক্রবার ছিল। বন্ধের দিন। কর্তৃপক্ষ চাইলে শুক্রবার সকালে অভিভাবকদের হাতে ছাত্রীদের তুলে দিতে পারতেন। কিন্তু তারা সেটা করলেন না। ছাত্রলীগের প্রেসক্রিপশন মেনে গভীর রাতেই ছাত্রীদের বিতাড়ন করা হয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রথম থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ক্ষমতাসীনদের দ্বারা প্রভাবিত। ফলে এত সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের একটা যৌক্তিক আন্দোলনকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যথাযথভাবে সামাল দিতে পারত। কিন্তু তারা সেটা করেনি।
ক্ষমতাসীনদের প্রতিহিংসাপরায়ণতা
বাকী বিল্লাহ
সাবেক ছাত্রনেতা
মধ্যরাতে সুফিয়া কামাল হল থেকে ছাত্রীদের বের করে দেওয়ার ঘটনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে নজিরবিহীন ও ন্যক্কারজনক। বিশ্ববিদ্যালয় এটা কোনোভাবেই পারে না। ব্রিটিশ আমলে প্রক্টরিয়াল ল’ বলতে একটা কালাকানুন ছিল। সেটার চর্চা রহিত হয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা সেগুলো আবার ফিরিয়ে আনছে। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় গণতান্ত্রিক পরিবেশ আর নেই। ফলে ক্ষমতাসীনরা এখানে ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠেছে।
তিন ছাত্রীকে গভীর রাতে যেভাবে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে তাতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ফৌজদারি অপরাধ করেছে। কারণ এ ঘটনার মধ্য দিয়ে ওই তিন ছাত্রী হেনস্তার শিকার হয়েছেন। তাদের মূল অপরাধ তারা কোটা সংস্কার আন্দোলনের কর্মী। এখন ফেসবুকে গুজব রটানোর অভিযোগ তোলা হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে। সে অভিযোগ যদি সত্যও হয়, তারপরও তো গভীর রাতে তাদের বের করে দিতে পারে না কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিটি শিক্ষার্থীর আশ্রয়ের জায়গা। তাছাড়া যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে সেগুলো তদন্তাধীন। তদন্তে কোনো কিছু প্রমাণ হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ তো ছিলই। এরপরও ঢাবি কৃর্তপক্ষ এমন আচরণ করল যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
যেদিন থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয় সেদিন থেকেই আন্দোলনের কর্মীদের চিহ্নিত করে তাদের ওপর চড়াও হচ্ছে ক্ষমতাসীনরা। মূলত প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়েই তারা এটা করছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন একটা যৌক্তিক এবং সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলন। নজিরবিহীন ছাত্রবিক্ষোভের কারণে দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে সরকার। এ আন্দোলনে সরকার নৈতিকভাবে হেরে গেছে। তাই প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়েই আন্দোলনের কর্মীদের ওপর চড়াও হয়েছে ক্ষমতাসীন দল ও তাদের ছাত্র সংগঠন। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানকে নগ্নভাবে ক্ষমতাসীনদের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে ঢাবি প্রশাসন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন