সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হলে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীণ কোন্দলকে দায়ী করেছেন হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক সাবিতা রেজওয়ানা চৌধুরী। তিনি সরাসরি ছাত্রলীগের নাম উচ্চারণ না করে বলেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্র সংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে কেন্দ্র করে সুফিয়া কামাল হলে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া, ছাত্রীদের উত্তেজিত করতে গুজবই সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে।’
বিগত কয়েক সপ্তাহজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা নিয়ে মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই মন্তব্য করেন। সংবাদ সম্মেলনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ক্লাবে অনুষ্ঠিত হয়।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা বিভাগের শিক্ষক ও নীলদলের আহ্বায়ক অধ্যাপক সামাদ।
এই সংবাদ সম্মেলনে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া সব ঘটনার বর্ণনা দেয় শিক্ষক সমিতি।
গত ১০ এপ্রিল দিবাগত গভীর রাতে হলে কোটা সংস্কার আন্দোলনে যোগ দেয়া ছাত্রীদের মারধর এবং এক ছাত্রীর রগ কেটে দেয়ার গুজব ছড়ায় এশার বিরুদ্ধে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের ছাত্রী এশাকে তাৎক্ষণিক বহিষ্কার করে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি। পরে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও বহিষ্কার করা হয়।
পরে জানা যায়, রগ কাটার যে ঘটনা ছড়ানো হয়েছে সেটা নিতান্তই গুজব। মোর্শেদা খানম নামে আরেক ছাত্রলীগ নেত্রীর পা কেটে যাওয়াতেই মূলত এই গুজব ছড়ানো হয়। তবে পরে জানা যায় মোর্শেদা কাঁচের জানলায় লাথি মারার পর তার পা কেটে যায় এবং এটাকেই পুঁজি করে গুজব ছড়ানো হয়েছে।
মোর্শেদা নিজেও ছাত্রলীগের একজন নেত্রী। তবে তিনি কোটা সংস্কার আন্দোলনের পক্ষেই ছিলেন। আর তিনি এই আন্দোলনে যোগ দেয়ায় এশা তাকে গালিগালাজ করেন বলে অভিযোগ আছে।
এই গুজব ছড়ানোর পর ছেলেদের বিভিন্ন হল থেকে কয়েক হাজার ছাত্র সুফিয়া কামাল হলে গিয়ে বিক্ষোভ করে। আর হলের ভেতরেও মেয়েরা তাকে ঘিরে ধরে লাঞ্ছনা করে। পরে এশাকে আপত্তিকর সাজা দিয়ে হল থেকে বের করে দেয়া হয়। এ সময় তার জামা ধরেও টানাটানি করে কয়েকজন ছেলে। এই ভিডিও সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকেও ছড়িয়ে দেয়া হয়।
তবে পরে এশার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে ছাত্রলীগ এবং তার ছাত্রত্বও ফিরিয়ে দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এশাকে নির্যাতনের সঙ্গে যারা জড়িত পরে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয় ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
উপাচার্যের বাসায় হামলাকারী কারা?
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, শিক্ষকদের অভিযোগ শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি ও অনুভূতিকে পুঁজি করে স্বার্থান্বেষী মহল বিভিন্ন সময় নানা রকমের গুজব এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে আন্দোলন ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার মাধ্যমে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করার চেষ্টা করেছে। এরই অংশ হিসেবে তাণ্ডব চালানো হয়েছে ভিসির বাসায়।
সংবাদ সম্মেলনে গণমাধ্যম কর্মীরা হামলাকারীদের পরিচয় সুস্পষ্টভাবে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকল্যাণ ও গবেষণা বিভাগে শিক্ষক অধ্যাপক সামাদ বলেন, ‘হামলাকারীদের বিষয়ে আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত কোনো তথ্য নেই। কারণ ঘটনাটি নিয়ে পুলিশ তদন্ত করছে। তদন্তের পর জানা যাবে আসলে কারা আসল হামলাকারী।’
তবে ঘটনার পরদিনই উপাচার্যের বাসভবন পরিদর্শন করতে এসে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও ঢাকা মেট্রোপলিশন পুলিশ কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া বলেছিলেন, হামলাকারীরা চিহ্নিত হয়েছে।
‘এশার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পাইনি’
ছাত্রলীগের প্রোগ্রামে না যাওয়ার কারণে প্রায় প্রতিরাতেই কবি সুফিয়া কামাল হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইফফাত জাহান এশার দ্বারা শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত হতো হলের সাধারণ মেয়েরা। এমন অভিযোগ তারা অনেক আগেই করেছিল হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক সাবিতা রেজওয়ানা চৌধুরী কাছে।
শিক্ষার্থীদের এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সংবাদ সম্মেলনে এক গণমাধ্যম কর্মী জানতে চান তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না।
জবাবে অনুজীব বিজ্ঞানের অধ্যাপক সাবিতা এশার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগকে ভিত্তিহীন ও গুজব বলে উড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, ‘এইগুলোও গুজব ও ভিত্তিহীন তথ্য। কারণ আমি আজ পর্যন্ত এই বিষয়ে কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি।’
তবে এই অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখতে কোনো তদন্ত কমিটি করবেন কি না এই বিষয়ে বারবার জানতে চাওয়া হলেও তিনি কিছু বলেননি।
‘এশাকে লাঞ্ছনায় কাউকে বহিষ্কার করা হয়নি’
হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক সাবিতা রেজওয়ানা বলেন, ‘হলের বেশ কয়েকজন মেয়ে ফেসবুকের মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে দিচ্ছিল এই বলে যে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২৬ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আসলে বিশ্ববিদ্যালয় তো এশার লাঞ্ছনার ঘটনায় কাউকে বহিষ্কার করেনি। তাছাড়া ওইদিন দুপুরে হলের কিছু মেয়ে সন্দেহজনকভাবে করিডোরে ঘোরাঘুরি করছিল। তাই আমরা হল প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা না নিয়ে অভিভাবকদের কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে এই সমস্যা নিরসন করতে চেয়েছিলাম।’
তবে গেল ১৯ এপ্রিল গণমাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, ‘এশার লাঞ্ছনার ঘটনায় জড়িত ২৬ জনকে কারণ দর্শানোর চিঠি পাঠানো হয়েছে। যেখানে তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে এই ঘটনার দায়ে কেন তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হবে না।’
এই নোটিশ কি ছাত্রীদের উৎকণ্ঠিত করে না এমন প্রশ্নের জবাবে প্রাধ্যক্ষ বলেন, ‘এইটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা বোর্ডের সিদ্ধান্ত, এই ব্যাপারে হল প্রশাসন কিছুই জানে না।’
সচেতন শিক্ষকদের মানববন্ধন প্রসঙ্গে
গেল রবিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষকদের ব্যানারে ‘শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষা কর’ শীর্ষক এক মানবন্ধনের আয়োজন করেন শিক্ষকরা। যেখানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থনপুষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংগঠন নীল দলের কাউকে দেখা যায়নি। এই নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয় সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে।
কেন তারা আসেননি এই বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক সামাদ বলেন, ‘এই বিষয়ে তারা আমাদেরকে কিছুই জানাননি এবং কোনো আলোচনাও করেননি। জানালে অবশ্যই আমরা তাদের আন্দোলনে সমর্থন দিতাম।’
গতকাল একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের টক শোতে একই কথা বলেন সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাদেকা হালিম। তিনি বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে ব্যস্ত ছিলাম, তাই তাদের মানববন্ধনে যোগদান করতে পারিনি।’
ভাইরাল হওয়া অডিওর ব্যাখ্যা প্রাধ্যক্ষের
হলের দুই হাজার মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে দেব এমন একটি অডিও টেপ ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। এই নিয়ে সমালোচনাও হয়েছে অনেক।
এই বিষয়ে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে ঘটনাটি স্বীকার করে হল প্রাধ্যক্ষ বলেন, ‘এশাকে লাঞ্ছনার বিষয়ে আমি হলের মেয়েদের বলেছিলাম যারা এই ঘটনায় জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু মেয়েরা বলছিল, আমরা সবাই ওই সময় উপস্থিত ছিলাম। সুতরাং আপনি নির্দিষ্ট কয়েকজনকে বহিষ্কার করতে পারেন না। বহিষ্কার করলে সবাইকে করতে হবে। তখনই আমি এই কথাটি বলেছিলাম।’
প্রাধ্যক্ষ বলেন, ‘যে অডিওটি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে সেখানে অসম্পূর্ণ তথ্য রয়েছে। কারণ শিক্ষার্থীরা আগে পরে অনেক কিছু বাদ দিয়ে মাঝখানের অংশটা ফেসবুকে ছড়িয়ে দিয়েছে।’
(ঢাকাটাইমস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন