ভালোবাসা-বন্ধুত্ব, রক্ত-সংগ্রাম, জীবন-মৃত্যু, হাসি-কান্না, একাকিত্ব সময় কিংবা প্রেমিকযুগলের হাতের উষ্ণ ছোঁয়া; যুগের পর যুগ ধরে এমন বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়ে আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘প্যারিস রোড’।
রাস্তার দু’ধারে গগন শীরিষ গাছে আচ্ছাদিত এ রাস্তা বহন করে চলেছে অনেক কালের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। কখনও বিদ্রোহে কেঁপে উঠেছে তার বুক, কখনও ভালোবাসায় শীতল হয়েছে; আবার কখনও বা তাজা রক্তের সঙ্গে মিশেছে প্যারিসের চোখের জল।
প্যারিস রোড একেক সময় সাজে একেক রূপে। সকালবেলা আকাশচুম্বী গগন শীরিষের পাতার ফাঁক দিয়ে আসা হালকা রোদে রাস্তার ধারে চোখে পড়ে কাঠবিড়ালিদের আড়মোড়া ভাঙার অদ্ভুত দৃশ্য। সারা দিনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত থাকে রাস্তাটি।
বিকাল হতে না হতেই আনাগোনা শুরু হয় শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং বিভিন্ন বয়স ও পেশার মানুষের। কোনো দর্শনার্থী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঘুরতে এসে প্যারিস রোডে হাঁটার অভিজ্ঞতাটুকু নিতে ভুলেন না কখনও। আর বর্তমান ছেলেমেয়েদের প্যারিসে দাঁড়িয়ে মুহূর্তটাকে ক্যামেরায় ফ্রেমবন্দি না করলে মিছেই যেন হয়ে যায় অন্য সব অভিজ্ঞতা।
‘প্যারিস রোড’ শুধু একটি রাস্তার নাম নয়; কালের ইতিহাস বহনকারী এক জায়গার নাম। বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আন্দোলনের সাক্ষী এ রাস্তাটি। ছাত্রদের বিক্ষোভ, আন্দোলন যেমন প্যারিস রোড ছাড়া প্রাণ পায় না, তেমনি ক্যাম্পাসের ভালোবাসাও প্রাণ পায় না প্যারিস রোড ছাড়া।
মনে প্রেম উদয় হওয়া প্রেমিক-প্রেমিকার প্রথম অনুভূতিও প্যারিস রোডের শীতল ছায়ায় হাঁটার মধ্য দিয়ে পূর্ণতা পায়। আবার বিরহ-বিচ্ছেদের যন্ত্রণাটাও ভাগাভাগি করতে চায় রাতের নির্জন প্যারিস রোডের শূন্যতার সঙ্গে।
আড্ডা ও গানের আসরেরও একটি আদর্শ জায়গা এ রাস্তা। ক্যাম্পাসে অনেক দিন পর কোনো বন্ধুর সঙ্গে হঠাৎ দেখা হলে মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়- ‘চল বন্ধু, প্যারিসে একটু ঘুরে আসি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন কোনো শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে এলে প্রথমেই মনে পড়ে মমতায় ঘেরা রাস্তাটিকে এক নজর দেখে আসি। রাতে হঠাৎ যদি কারো হিমু হতে ইচ্ছা করে অথবা ঘুম উধাও হয় চোখ থেকে, কিংবা বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় গরমে জীবন যায় যায় অবস্থা, সেই মুহূর্তে অনেকের মনে পড়ে প্যারিস রোডের শীতল হাওয়ার আত্মাটাকে একটু জুড়িয়ে নেয়ার কথা।
গভীর রাতেও প্যারিস রোড থেকে ভেসে আসে ছাত্রদের সম্মিলিত কণ্ঠে গানের সুর। মন খারাপের সময়ে দু’পাশে সারি সারি সোডিয়াম লাইটের নিচে আলো-আঁধারি পরিবেশে হেঁটে প্রশান্তি খুঁজে পান অনেকে।
এত বিশেষত্ব থাকলেও প্যারিস রোডের জন্মের ইতিহাস কিন্তু অনেকটা সাদামাটা। ১৯৬৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য বৃদ্ধিকরণের লক্ষ্যে ক্যাম্পাসের কাজলা রোড থেকে শেরেবাংলা হল পর্যন্ত এই গগন শিরীষ গাছ লাগানো হয়।
তৎকালীন উপাচার্য এম শামসুল হক ফিলিপাইন থেকে কিছু গাছ নিয়ে আসেন। তিনি এ গাছগুলো রোপণের দায়িত্ব দেন উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের তৎকালীন সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী মোহাম্মাদ ইউনুসকে। তার হাত ধরেই লাগানো হয় গাছগুলো। তখন এটি ছিল নেহাৎ একটি বৃক্ষরোপণের উদ্যোগ।
উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে গাছগুলোর সৌন্দর্য। প্রকৃতির অপরূপ শোভায় শোভিত হতে থাকে রাস্তাটি। পরিচিতি পায় দেশের একটি দর্শনীয় স্থান হিসেবে। পিচঢালা কালো রাস্তার দুই পাশে অতন্দ্র প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকা এই দৃষ্টিনন্দন গাছগুলোর সৌন্দর্যই আকৃষ্ট করে প্রকৃতিপ্রেমী হাজারো মানুষকে।
রাস্তাটির সঙ্গে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের রাস্তাগুলোর অনেকটা মিল খুঁজে পাওয়া যায় বলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা একে প্যারিস রোড বলতে থাকেন। সেই থেকে রাস্তাটি প্যারিস রোড নামে পরিচিত হয়ে উঠে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ও বর্তমান এমন কোনো শিক্ষক-শিক্ষার্থী পাওয়া যাবে না, যার সঙ্গে এই প্যারিস রোডের কোনো স্মৃতি জড়িত নেই। সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা কিংবা রাতে আড্ডা, গান, গল্প ও নানা মানুষের পদচারণায় মুখরিত থাকে সবার ভালোবাসার এ ‘প্যারিস রোড’।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন