জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত, এর অন্তর্গত চরিত্রটি বাইরে থেকে সহজে বোঝা যায় না। স্বভাবে আবাসিক বলেই শিক্ষার্থীদের চেতনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাপ মুদ্রিত হয়েই যায়। কতদিন এর সঙ্গে পরিচয়? মনে হয়, এই তো সেদিন। ১৯৭২-৭৩ সেশনে রসায়ন বিভাগে ভর্তি হই। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলাম আমরা, এখন চলছে ৪৭তম। মাঝে পেরিয়ে গেছে কয়েক দশক সময়। দীর্ঘদিনের পরিচিত অথচ এ ক্যাম্পাসটা এখন মাঝে মাঝে অচেনা লাগে। বিশেষ করে সপ্তাহের দুদিন। শুক্র ও শনিবার। সবুজ বাস এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য। সরকারি অনুদানের বিআরটিসির কিছু লাল বাস ক্যাম্পাসের গাড়িবহরে যোগ হলো কয়েক বছর আগে। কিন্তু এখন ঘটনা ভিন্ন। সপ্তাহের বিশেষ এ দুদিনে হরেক রকমের বাসের দেখা মেলে ক্যাম্পাসে। সামনে আবার প্ল্যাকার্ড ঝোলানো থাকে— জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। এ বাসগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ধ্যাকালীন কোর্সের শিক্ষার্থীদের আনা-নেয়া করে। ভাড়া করা। শুধু রঙেই ভিন্ন নয়; এর যাতায়াত, যাত্রীদের গতিবিধি, আচার-ব্যবহার পর্যন্ত আলাদা। সকালে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসে, ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। এখানে নতুন কেউ এলে প্রথম দেখায় ক্যাম্পাসকে কোনো অস্থায়ী বাসস্ট্যান্ড ভেবেও বসতে পারেন। কয়েক মাস আগের এক সিন্ডিকেট সভায় এ বাসগুলোকে ক্যাম্পাসে অবস্থান না করতে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। শিক্ষার্থীদের নামিয়ে দিয়ে বাসগুলো বাইরে চলে যাওয়ার কথা, তা মানা হচ্ছে না। কয়েক বছর ধরে সপ্তাহের এ দুদিন জাহাঙ্গীরনগরে সন্ধ্যাকালীন কোর্সের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বেড়ে গেছে বহুগুণ। নানা বয়স ও শ্রেণীর শিক্ষার্থী আসেন, তাদের বেশির ভাগই পেশাজীবী। তাদের চাপে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক শিক্ষার্থীদের চলাচল, খাওয়া-দাওয়ার অসুবিধার কথা তারা বিভিন্ন সময়ে হল প্রশাসনকে জানিয়েছেও।
অর্থনীতির ক্রমসম্প্রসারণে ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চাকরির ক্ষেত্রে ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে ব্যবসা বিষয়ের একটি ডিগ্রি। আমি দ্বিধাহীনচিত্তেই স্বীকার করি, উপাচার্য থাকাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম সন্ধ্যাকালীন কোর্সের অনুমোদন দিই। সে সময় বলা হয়েছিল, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এসব কোর্সে ভর্তি হয়ে সর্বগুণে গুণান্ব্বিত হয়ে মেধার দৌড়ে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাবে। আমরাও বিষয়টিকে সেভাবেই দেখেছি— ব্যবসায়িক চিন্তা থেকে এর শুরু হয়নি। কিন্তু হায়! আজ যখন পুরো ক্যাম্পাসে হাঁটি শুক্র ও শনিবার, দেখি বেশির ভাগ বিভাগের সামনেই সন্ধ্যাকালীন কোর্সের শিক্ষার্থীদের ভিড়। এরই মধ্যে অনেক বিভাগ ও ইনস্টিটিউট এ সন্ধ্যাকালীন বা প্রফেশনাল কোর্স চালু করেছে, বাকি বিভাগগুলোয়ও খোলার চেষ্টা চলছে প্রাণান্তকর। কিন্তু আজ যখন দেখি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে সন্ধ্যাকালীন কোর্সের ব্যস্ততার কারণে, তখন আফসোস হয় সিদ্ধান্তটি আমার হাত দিয়ে অনুমোদন পেয়েছিল বলে। আমি যদি সে সময়ে বিষয়টির অনুমোদন না দিতাম, হয়তো এ রকম নাও হতে পারত। আমার এ সিদ্ধান্তের কারণে আজ অনুশোচনায় দগ্ধ হই।
যে বিষয়ে বলছিলাম, বাজারের ক্রমবর্ধমান চাহিদা কাজে লাগিয়ে বেশির ভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট নানা বিষয় খুলে বসেছে সন্ধ্যাকালীন কোর্সের নামে। এতে চলে নিয়মিত পাঠদানও। নামমাত্র ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়মিত শিক্ষার্থীর দ্বিগুণ বা তারও বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে এসব কোর্সে। যদিও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভালো ফল করার পর তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তির সুযোগ পায় খুব কমসংখ্যক শিক্ষার্থী। বিপরীতে সান্ধ্য কোর্সে টাকার বিনিময়ে পড়ার সুযোগ পায় এদের কয়েক গুণ। অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষকদের বেশি মনোযোগ সন্ধ্যাকালীন কোর্স নিয়েই। তারা নিয়মিত পাঠদানের চেয়ে এসব কোর্সেই বেশি সময় দেন। ভাগে কোর্স সংখ্যা কম পড়লে ঝগড়া পর্যন্ত করছেন। এতে প্রশ্ন উঠছে শিক্ষার মান নিয়ে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা এর বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বিভিন্নভাবে। শিক্ষকরা নিজেরাও হয়তো স্বীকার করবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান লেখাপড়ার মান নিম্নগামী। বছরে কেউ কেউ ১০-১২, খুব বেশি হলে ১৫-২০টি মাত্র ক্লাস নিচ্ছেন। এমন চিত্র কেবল জাহাঙ্গীরনগর নয়, দেশের শীর্ষস্থানীয় বিদ্যাপীঠ থেকে শুরু করে কয়েক দিন আগে প্রতিষ্ঠিত নবীনতম বিশ্ববিদ্যালয়েরও। বলতে গেলে প্রায় বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র একই রকম। উদাহরণ হিসেবে নিজের ক্যাম্পাসকেই বেছে নিচ্ছি।
আমাদের দেশটি ছোট্ট। প্রতি বছর কয়েক লাখ শিক্ষার্থী উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হচ্ছে। সে অনুপাতে উচ্চশিক্ষার সুযোগ কম। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংকট রয়েছে। শিক্ষার প্রসার ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য নানা পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এ পরিপ্রেক্ষিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি উদারচিত্তে উচ্চশিক্ষা প্রসারের এমন সুযোগ গ্রহণ করত, তবে তা হতো যুগান্তকারী পদক্ষেপ। দুঃখের বিষয়, তা হয়ে ওঠেনি। আমাদের কতিপয় সহকর্মীর চেতনায় জাতীয় উন্নয়ন চিন্তার পরিবর্তে বাণিজ্যিক ভাবনার প্রসারই গুরুত্ব পেয়েছে, পাচ্ছে।
বাণিজ্যিক লক্ষ্য সামনে রেখে সন্ধ্যাকালীন কোর্সের প্রসার ঘটছে ঠিকই, কিন্তু তাতে মানসম্মত শিক্ষা প্রদান নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। ফলে উচ্চশিক্ষার ডিগ্রির প্রসার বাড়ছে, গুণগত মানের শিক্ষা প্রদান হচ্ছে না, শিক্ষার্থীরাও গুণগত মানের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নীরব অসন্তোষ বাড়ছে তাদের মাঝেও। শিক্ষার প্রসারে এ গ্র্যাজুয়েটদের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদাহানি ঘটছে। নামে-ভিন্ন নামে অসংখ্য সান্ধ্য মাস্টার্স কোর্স চালু করা হচ্ছে, কখনো কখনো নামমাত্র বা ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই নিম্নমানের শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে। উদ্দেশ্য, বেশি ছাত্র, বেশি টাকা। নতুন নতুন এসব বিভাগ চালুর সঙ্গে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি, অবকাঠামো, জনবল ও আবাসনে প্রতি বছরই বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ বাড়ছে। যদিও বলা হচ্ছে, নিজস্ব আয় বৃদ্ধি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে সান্ধ্য মাস্টার্স বা প্রফেশনাল কোর্স চালু করেছে। কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতা তা নয়, এ আয় বা টিউশন ফির বড় অংশেরই সুবিধাভোগী শিক্ষকরা। চার মাসের একটি সেমিস্টার পড়াতে পারলেই একজন শিক্ষক ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পান। অনুষদভেদে এ পরিমাণ ভিন্ন হয়। একজন শিক্ষক বছরে তিনটি সেমিস্টার পড়াতে সক্ষম হলে নিয়মিতই বেতনের বাইরে কয়েক লাখ টাকা অতিরিক্ত আয় করতে পারেন। এতে নিয়মিত শিক্ষার্থীর চেয়ে সান্ধ্য কোর্সের শিক্ষার্থীদের প্রতিই শিক্ষকদের মনোযোগ বেশি থাকে— এমন অভিযোগ খোদ নিয়মিত শিক্ষার্থীদের। সন্ধ্যাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পতিত অবকাঠামো ব্যবহার করে নিজের আয় বৃদ্ধি ও উচ্চশিক্ষার পরিধি বাড়াতে সান্ধ্য প্রফেশনাল কোর্স (স্নাতকোত্তর) চালু রয়েছে। এ কোর্সের ৩০ শতাংশ টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়। অর্থাৎ ১ লাখ টাকা টিউশন ফি থেকে মাত্র ৩০ হাজার টাকা। ১০ শতাংশ টাকা বরাদ্দ রাখা হয় বিভাগ উন্নয়নে আর ৬০ শতাংশ কোর্স শিক্ষক ও সংশ্লিষ্টরা ভাগাভাগি করে থাকেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট বিবরণী ঘেঁটে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে এসব কোর্স চালু করা হলেও কার্যত বৈষয়িক উন্নয়ন হচ্ছে শিক্ষকদের। কারণ আয়ের ৬০ শতাংশের অংশীদার শিক্ষকরা। যদিও প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘাটতির পরিমাণ বাড়ছেই। সান্ধ্য বা প্রফেশনাল কোর্স হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে প্রফেশনাল কোর্স। নির্ধারিত টিউশন ফি প্রদানসাপেক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত নন এমন শিক্ষার্থীরা ভর্তির সুযোগ পান, যা তাদের প্রফেশনাল কাজের সহায়ক হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত কোনো শিক্ষার্থী চাইলে নির্ধারিত টিউশন ফি দিয়ে পড়তে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন সূত্র জানায়, কমিশনের অনুমোদনসাপেক্ষেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন কোনো কোর্স খুলতে হয়। কিন্তু টিউশন ফি সংশ্লিষ্ট বিভাগ নির্ধারণ করে থাকে। নিয়ম অনুযায়ী, নিজস্ব আয় বৃদ্ধি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন ও উচ্চশিক্ষার পরিধি বাড়াতে সান্ধ্য মাস্টার্স কোর্স চালু করা হয়েছে। কিন্তু এসব কোর্সের শিক্ষাক্রম, ক্লাস প্রেজেন্টেশন, লেকচার, পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়েও সমালোচনা শুরু হয়েছে। মানসম্মত শিক্ষার অনুপস্থিতি এসব কোর্সের দুর্নাম বয়ে আনছে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত পাঠদানের বাইরে এ কোর্সগুলো চলে দ্রুতগতিতে। নিয়মিত কোর্সের পরীক্ষা নির্ধারিত সময়ের কয়েক মাস পরে বা বছর পেরিয়ে অনুষ্ঠিত হলেও শিক্ষকদের মাথাব্যথা কম দেখা যায়। তবে এ কোর্সগুলো নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করার একটা তাড়া দেখা যায় শিক্ষকদের মধ্যে। ফলে ক্লাস লেকচার, প্রেজেন্টেশন বা গবেষণার মান যে খুব একটা ভালো হয় না, তা বলাই বাহুল্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক নিজেদের ক্যাম্পাসের চেয়ে অনেক বেশি সময় দিচ্ছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। একই সঙ্গে তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ সন্ধ্যাকালীন কোর্সও। তাদের তুলনামূলকভাবে বেশি অর্থ আসে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও সন্ধ্যাকালীন কোর্স থেকে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত পাঠদান তাদের কাছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনেকটাই গৌণ হয়ে পড়ে। বিভাগে যে ক্লাস রুটিন দেয়া হয়, তা অনুসরণ করেন না বেশির ভাগ শিক্ষকই। সারা বছর ঠিকমতো ক্লাস না নেয়ার ফলে সিলেবাস বাকি থেকে যায়। এ রকম পরিস্থিতিতে শিক্ষকরা অনেক সময় বিশেষ সাজেশনস দিয়ে দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেতে চান। আবার অনেকে পরীক্ষার আগে আগে সিলেবাস শেষ করার তাগিদে এত বেশি অতিরিক্ত ক্লাস নেন যে, শিক্ষার্থীদের ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়ে। উত্তরপত্র মূল্যায়নে সময়ের অভাব কিংবা শিক্ষার্থীদের তুষ্ট রাখার জন্য অবিবেচকের মতো নম্বর বাড়িয়ে দিয়ে থাকেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিপুল স্বাধীনতা। তারা কী করেন, কেউ খবর রাখেন না। ইচ্ছে হলে ক্লাসে যান, না হলে যান না। পড়ানোয় জবাবদিহি করতে হয় না। প্রমোশনের সময় কিছু প্রকাশনা লাগে, দায়সারা গোছে তা করে ফেলেন। এমফিল পিএইচডি হয়ে গেলে তাকে আর পায় কে! জোর দিয়ে বলতে পারি, এমন শিক্ষকের সংখ্যা নেহাত কম নয়, যারা কেবল প্রমোশনের জন্য জার্নালে লেখালেখি করেছেন, পরে আর তার ধারে-কাছেও ঘেঁষেননি। এসব শিক্ষক কী করেন, হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন, না হলে না পড়াচ্ছেন। এখন তো আবার শুরু হয়েছে সন্ধ্যাকালীন কোর্স। বিশ্ববিদ্যালয়ও এখন দুদিন বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আগে শিক্ষার্থীরা তাও বলার সুযোগ পেতেন, শনিবার নিয়মিত ক্লাস পরীক্ষা বাদ দিয়ে শিক্ষকরা সন্ধ্যাকালীন বা প্রফেশনাল কোর্সের ক্লাস পরীক্ষা নিচ্ছেন। এখন সে সুযোগ নেই। সপ্তাহে বন্ধ দুদিন, দুদিনই তারা বিশেষ এ কোর্স নিয়ে ব্যস্ত, সকাল থেকে শুরু, সারা দিন। গল্পটা এখানে শেষ হলে ভালোই হতো। অন্তত শিক্ষার্থীরা এসব শিক্ষকদের পেতেন সপ্তাহের বাকি পাঁচদিন। সে সুযোগ নেই। শিক্ষকরা এসবের পাশাপাশি অন্য কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেন, কনসালট্যান্সি করছেন, আর্থিকভাবে ভালোই স্বাবলম্বী হচ্ছেন।
আমার বেশ পরিচিত জাহাঙ্গীরনগরেরই একটি ফ্যাকাল্টির চারটি বিভাগই পরিচালিত হচ্ছে অপেক্ষাকৃত কম বয়সী ও কম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষক দ্বারা। এসব বিভাগে কোনোমতে শিক্ষকের সংখ্যাটাও দুই অংক ছাড়ায়নি। অপ্রতুল শিক্ষক দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সসহ চলমান পাঁচটি বর্ষের কোর্স পরিচালনা করা স্বাভাবিকভাবেই দুরূহ। তারা অপর্যাপ্ত এ সংখ্যার শিক্ষক দিয়েই নিয়মিত কোর্স পরিচালনা করেন। তাদের রয়েছে বিশেষায়িত সন্ধ্যাকালীন কোর্সও। আবার এ শিক্ষকদের বলতে গেলে সবাই কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েও ক্লাস নেন। সপ্তাহের পরিধি সাতদিন কিন্তু তারা কখন কোথায় সময় ব্যয় করেন, কীভাবে এত ব্যস্ততা সামলান, লেখাপড়া করেন কখন! আবার তাদের তো পারিবারিক জীবনও রয়েছে। এভাবে চললে নিয়মিত কোর্সের শিক্ষার্থীদের— পাঁচটি ব্যাচের, আবার সেশনজটের কারণে কোনো কোনো বিভাগে সাত-আটটি ব্যাচও রয়েছে— পড়াশোনার হালহকিকত কী ধরনের হতে পারে! আবার যে সন্ধ্যাকালীন কোর্সে তাদের এত গুরুত্ব, সেখানেও চলছে জোড়াতালির মতো বিষয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো একটি ইনস্টিটিউটের নিয়মিত কোর্সের একটি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল এক বছরেরও আগে। দীর্ঘ এ সময়ে তাদের ফল প্রকাশ হয়নি। কথাচ্ছলে আলাপ হচ্ছিল সেই ইনস্টিটিউটের এক শিক্ষকের সঙ্গে। তার মাঝে দায়িত্বানুভূতির ছিটেফোঁটাও দেখলাম না। একটা দীর্ঘশ্বাস এল কেবল, হায়! আমাদের শিক্ষকসমাজ, হায়! আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়, হায়! আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন!!
উদাহরণ হিসেবে একটি ইনস্টিটিউটের প্রসঙ্গ টানলাম। কিন্তু এ চিত্র তো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ বিভাগ ও ইনস্টিটিউটেরই। এ চিত্র সারা দেশের বেশির ভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের। প্রায় প্রতিটি বিভাগের শিক্ষকই সন্ধ্যাকালীন কোর্সের সঙ্গে জড়িত, সপ্তাহের কয়েকটা দিন কাটে এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে দৌড়াদৌড়ি করে। তাদের কাছে নিয়মিত কোর্সগুলো, যেটা পেশাদারিত্বের প্রধানতম দায়িত্ব, তা পালন হয় কতটুকু। এভাবে চলতে থাকলে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অকালমৃত্যু হতে আর কতক্ষণই বা লাগবে? জাতির অধোগতি ঠেকাবে কে?
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আরো বিজ্ঞ, উদার, সংস্কৃতিমনা। অজ্ঞতা, কুসংস্কার, সংকীর্ণ মানসিকতার ঊর্ধ্বে উঠে শিক্ষকরা জাতি গঠনে ব্রতী হন। তাদের চিন্তায় কেবল দেশ ও জাতির স্বার্থই প্রাধান্য পায়। কোনো নির্দিষ্ট বেড়াজালের আবরণ তাদের জ্ঞানার্জন ও জ্ঞান পরিবেশনে বাধা তৈরি করতে পারে না। তারা শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট বিষয়ে পড়ানোর পাশাপাশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সভা, সিম্পোজিয়াম, কর্মশালা, সেমিনারে অংশ নেবেন। নিজে গবেষণা করবেন, শিক্ষার্থীদের গবেষণায় উৎসাহিত করবেন। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের মাধ্যমে নিজের জ্ঞানকে সময়োপযোগী করবেন, বিলিয়ে দেবেন শিক্ষার্থীদের মাঝে। উদ্যমী ও প্রত্যয়ী প্রজন্ম গড়ে তুলবেন শিক্ষকরা। নতুন জ্ঞান, উদ্ভাবনী ভাবনা, বিশ্বজনীনতা, আইনের অনুশাসন, দক্ষ জনশক্তি, সামাজিক ন্যায়বিচার, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব প্রদানে এগিয়ে থাকবেন শিক্ষকরা। শিক্ষকদের গবেষণার ওপর ভিত্তি করেই রাষ্ট্র সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। শিক্ষক কোনো কিছুর বিনিময়েই আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ন করবেন না।
তবে নানা সীমাবদ্ধতার কারণেই শিক্ষকরা এ পথে এগোচ্ছেন। এটি রোধ করা উচিত। সান্ধ্য বা প্রফেশনাল কোর্স চালু হতে পারে, সেখানে বাণিজ্যের পরিবর্তে শিক্ষা প্রসারের বিষয়টি গুরুত্বের আওতায় আনতে হবে। শিক্ষার গুণগত মান, ডিগ্রির মান নিশ্চিত করতে হবে। আর শিক্ষকদের অন্য আর্থিক কার্যাবলির সঙ্গে জড়িত হওয়ার প্রবণতা রোধ করতে পর্যাপ্ত বেতনসহ আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। যদিও প্রতি বছর শিক্ষা খাতেই সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করা হচ্ছে। তবে এ বিনিয়োগের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অনিয়ম, দুর্নীতি, আর্থিক অব্যবস্থাপনা রোধ হলে সার্বিক পরিবেশ আরো উন্নত হবে। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতে অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণের সরবরাহ ও গবেষণাগারের সমৃদ্ধি ঘটাতে হবে।
শিক্ষকদের একটি অংশ বলে থাকেন, তারা পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পান না, বেতন-ভাতা অপর্যাপ্ত, বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার সুষ্ঠু পরিবেশ নেই। এ পরিপ্রেক্ষিতে বলব, যেটুকু সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, তার কতটুকু ব্যবহার হচ্ছে? কোনো কোনো ক্ষেত্রে সুযোগের ব্যবহার হচ্ছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তার ব্যবহার হচ্ছে না। যদিও সংখ্যায় কম, তবু বেশকিছু শিক্ষক আছেন গবেষণাকর্মে, যারা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। আবার কিছু শিক্ষক কখনই গবেষণা করেন না। যতটা লেখালেখি তাদের করার কথা, তার অনেক কম করেন তারা। প্রতিটি বিভাগের বার্ষিক জার্নাল থাকে, অনুষদেরও থাকে। এতে কয়জন শিক্ষক লেখেন? যে ক’জনইবা লেখেন, তার মান কি আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হচ্ছে? বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের কাছে সবার প্রত্যাশা, তিনি সব প্রতিবন্ধকতা, সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে কিছু করবেন।
ড. শরীফ এনামুল কবির
লেখক: সাবেক সদস্য, পাবলিক সার্ভিস কমিশন
সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
skabir_ju@yahoo.com
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন