সরকারি চাকরিতে পরীক্ষায় কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা নানামুখী চাপে অনেকটাই আড়ালে চলে গেছেন। শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেপ্তারের ফলে নেতৃত্বশূন্য তারা। বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনে বিক্ষোভ ও সমাবেশ হলেও আগের মতো অংশগ্রহণ নেই শিক্ষার্থীদের। সবার মধ্যে বিরাজ করছে ভয়-আতঙ্ক। নেতাদের ফেসবুক আইডি ডিস-অ্যাবল হওয়ার পাশাপাশি ফেসবুকে কোটা সংস্কারপন্থীদের ফেসবুক গ্রুপটিও হ্যাক হয়ে গেছে। মামলা-হামলা আর গ্রেপ্তার আতঙ্ক তো রয়েছেই। এ ছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হামলায় আহত আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা চিকিৎসার ক্ষেত্রেও বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ তাদের।
বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ছাত্রমাহফুজ খানের এখনো কোনো খোঁজ মেলেনি। রাজধানীর শাহবাগ থানায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনে (৫৭ ধারা) ছাত্রলীগকর্মীর দায়ের করা এক মামলায় গত ১ জুলাই মিরপুর ১৪ নম্বর ভাষানটেক বাজার, মজুমদার মোড় ১২ নম্বর বাসা থেকে রাশেদ খান ও মাহফুজকে একসঙ্গে তুলে নিয়ে যায় সাধারণ পোশাক পরা ডিবি পুলিশÑ এমনটিই জানিয়েছিলেন আন্দোলনকারীরা। রাশেদ খানকে গ্রেপ্তার দেখানো হলেও মাহফুজের কোনো খোঁজ মিলছে না। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন বলেন, রাশেদকে যে বাসা থেকে আটক করা হয়েছে সেই বাসায় মাহফুজ খানও ছিলেন। রাশেদের সঙ্গে মাহফুজ খানকে তুলে নেওয়া হয়েছে। এর পর থেকে তার কোনো খোঁজ মিলছে না।
জানা যায়, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে রয়েছেনÑ রাশেদ খান, ফারুক হাসান, জসিমউদ্দিন, মশিউর, আমানুল্লাহ, মাজহারুল, জাকারিয়া, রমজান ওরফে সুমন, রবিন ও তারেক আদনান। একজন এখনো নিখোঁজ। নিখোঁজ ছাত্রের নাম মাহফুজ। অন্যদের পরিচয় এখনো পুলিশ নিশ্চিত করেনি। এর মধ্যে ফারুক হাসান শহীদ মিনারে মানববন্ধন করতে গেলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মারধর করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। রাশেদ খান তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় গ্রেপ্তার হয়ে পুলিশি হেফাজতে। এ ব্যাপারে রাশেদ খানের স্ত্রী রাবেয়া খানম বলেন, মাহফুজ এবং রাশেদকে আমার সামনে থেকে একই বাইকে করে তুলে নিয়ে গেছে ডিবি পুলিশ। আমরা কারো কাছে কোনো যৌক্তিক বিচার পাইনি। একজন সাধারণ স্টুডেন্ট হয়েও সবার জন্য আন্দোলনে নেমেছিল; কিন্তু এখন তার ট্যাগ হয়ে গেল জামায়াত-শিবির। ও নাকি শিবির করে, জামায়াত-শিবিরের কাছ থেকে টাকা খেয়েছে। অথচ আমরা দিন আনি দিন খাই। আমরা টিউশনি করে পারিবারিক খরচ চালাতাম। তিনি বলেন, রাশেদ যেহেতু সবার জন্য আন্দোলন করেছে, তাই সবাই যেন রাশেদকে মুক্ত করার জন্য আন্দোলনে পাশে থাকে। রাশেদ একটা নিরপরাধ ছেলে।
আইন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তারেক আদনানকে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের একটি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে গত ১০ এপ্রিল শাহবাগ থানায় দায়ের হওয়া তিনটি মামলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে হামলা, পুলিশের বিশেষ শাখার সদস্যের মোটরসাইকেল ভাঙচুর ও ওয়াকিটকি কেড়ে নেওয়ার অভিযোগে ওই মামলাগুলো দায়ের করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা, পুলিশের বিশেষ শাখার এক সহকারী উপপরিদর্শক ও শাহবাগ থানার পুলিশ।
এদিকে গত ২ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক নুরুকে গভীর রাতে রাজধানীর আনোয়ারা খান মডার্ন হাসপাতাল থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। অসুস্থ অবস্থাতেই তাকে বের করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন নুরুল হক নুরু। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে সাংবাদিকদের নুরুল হক জানান, পুলিশ তাকে প্রথমে গ্রেপ্তারের কথা বলে চলে যায়। এর কিছুক্ষণ পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের নোটিশ ছাড়াই চিকিৎসা না দিয়ে আমাকে বের করে দেয়। এর আগে তার কাছ থেকে ফেসবুকের আইডি ও পাসওয়ার্ড নিয়ে যায় পুলিশ। বর্তমানে তিনি একটি বেসরকারি প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার শারীরিক অবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে বলে জানান কোটা সংস্কার আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন। গত ৩০ জুন শনিবার কোটা সংস্কার আন্দোলনের বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনের প্রাক্কালে মারধরের শিকার হন তিনি। মারধরে গুরুতর আহত হয়ে নুরুল হক নুরু ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হলে তাকে সেখানেও চিকিৎসা নিতে দেওয়া হয়নি। পরে ধানমণি-র বেসরকারি আনোয়ারা খান মডার্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন।
গত সোমবার বিকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ও বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক তরিকুল ইসলাম কোটা সংস্কার আন্দোলন করতে গিয়ে ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকের সামনের রাস্তায় ছাত্রলীগের রোষানলে পড়েন। তারা তরিকুলকে লাঠি আর হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ডান পা ভেঙে দেওয়াসহ পুরো শরীর জখম করে।
তরিকুল রাজশাহীর একটি প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় আমাদের সময়কে বলেন, ‘ভাঙা পা। পুরো শরীরে জখম। প্রচ- ব্যথায় তিন-চারজন না ধরলে নড়াচড়া পর্যন্ত করতে পারি না। আমি মুমূর্ষু একজন রোগী; কিন্তু এই অবস্থায় সরকারি হাসপাতাল থেকে আমাকে (বৃহস্পতিবার বিকালে) রিলিজ দেওয়া হয়েছে। এই দুঃখের কথা কাকে বলব।
তরিকুল ভাঙা পা, মাথায় ৯ সেলাই আর পুরো শরীরে যখম নিয়ে প্রচ- ব্যথায় হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছিলেন। বলছিলেনÑ বাবার অভাবের সংসারে আরও দুই ভাইবোন অনার্সে পড়ালেখা করে। বাবা প্রায়ই বলতেন, কবে একটা চাকরি করবি। সান্ত¡না দিতাম আর বলতাম, আর কিছুদিন ধৈর্য ধরো বাবা। বিসিএসের পড়াশোনাও শুরু করেছিলাম। স্বপ্ন ছিলÑ বিসিএস ক্যাডার হয়ে কৃষক বাবার দুঃখ ঘুচাব; কিন্তু স্বপ্নটা আজ দুঃস্বপ্ন। জীবনটাই অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেল।
এ বিষয়ে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জামিলুর রহমান বলেন, ‘চিকিৎসকরা যেটা ভালো মনে করেছেন সেটাই করেছেন। ডাক্তারদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। এটি একটি ক্লিনিক্যাল বিষয়। সুতরাং তারা যেটা অ্যাডভাইস দিয়েছেন, রোগীর নিয়ম অনুযায়ী দিয়েছেন।
তরিকুলের চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা বেসরকারি হাসপাতালের ডা. সাঈদ আহম্মদ বাবু জানান, তার মাথায় ৯টি সেলাই রয়েছে। এ ছাড়া শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে পিঠে ও কোমাড়ের নিচে বেশ কয়েকটি স্থানে মারাত্মক জখম রয়েছে; ডান পা তো ভেঙেই গেছে। তার শরীরে প্রচ- ব্যথা, শারীরিক অবস্থাও খারাপ। একটু উন্নতি না হলে সার্জারি কিংবা অন্য কোনো কিছু করা যাচ্ছে না।’
সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন বলেন, আমরা আহতরা কেউ প্রকাশ্যে চিকিৎসা নিতে পারছি না। পরিচয় জানার পর আমাদের হাসপাতাল থেকে বের করে দেওয়া হয়। বৃহস্পতিবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের হামলায় আহত তরিকুলকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ থেকে চিকিৎসা না দিয়েই বের করে দেওয়া হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তি ও প্রজ্ঞাপন জারি হওয়া পর্যন্ত তাদের আন্দোলন চলবে বলে তিনি জানান।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন