বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ছাত্রলীগের নাম। এই সংগঠনের নেতাকর্মীদের সেই অবদানের কথা সারা জীবন মনে রাখবে মুক্তিকামী মানুষ। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতেগড়া এই সংগঠনের রয়েছে অনেক ‘উজ্জ্বল’ ইতিহাস। কিন্তু দিন দিন সেই আলো যেন নিভতে বসেছে। এই সংগঠনের কিছু নেতাকর্মীর কিছু কার্যক্রমের জন্য ছাত্রলীগের নামের পাশে যুক্ত হচ্ছে নানা ‘অপরাধমূলক’ কাজ, যা মোটেও কাম্য নয়।
সর্বশেষ গত ২ জুলাই ছাত্রলীগের নামের পাশে একটি ‘সন্ত্রাসী’ কাজের তকমা লেগেছে। ওই দিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গেটের সামনে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে এক ছাত্রকে ‘সাপের মতো’ পিটিয়েছেন ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। সেই পিটুনিতে তরিকুল ইসলাম নামের বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের মাস্টার্সের ওই ছাত্রের এক পা ভেঙে গেছে, মাথায় সেলাই দিতে হয়েছে এবং পুরো শরীরে রয়েছে আঘাত ও জখমের চিহ্ন।
গাইবান্ধার কৃষক পরিবারের সন্তান তরিকুল এখন রাজশাহী নগরের একটি বেসরকারি হাসপাতলে ভর্তি রয়েছেন। তার চিকিৎসা করার মতো অর্থ পরিবারের কাছে নেই। বন্ধু ও সহপাঠীদের অর্থে তার চিকিৎসা চলছে কোনোমতে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হলেও তরিকুলকে গত বৃহস্পতিবার হাসপাতাল থেকে কোনো কারণ ছাড়াই ছাড়পত্র দেওয়া হয়। এর পর থেকে তরিকুল একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন তরিকুল ইসলাম। বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক তরিকুলকে গত ২ জুলাই রাস্তার ওপর ফেলে পেটান ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। গণমাধ্যমে যাদের নাম আসে তারা হলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুন (সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র, বাড়ি রাজশাহী), কর্মী লতিফুল কবির মানিক (ইতিহাস বিভাগের ছাত্র, বাড়ি লালমনিরহাট), সহসভাপতি রমিজুল রিমু (ইতিহাস বিভাগের ছাত্র, বাড়ি নাটোর), সহসভাপতি মিজানুর রহমান সিনহা (বাড়ি রাজশাহী), সহসভাপতি আহমেদ সজীব (ফলিত গণিত বিভাগের ছাত্র, বাড়ি রাজশাহী), সাংগঠনিক সম্পাদক হাসান লাবন (আইন বিভাগের ছাত্র, বাড়ি চট্টগ্রাম) ও মেহেদী হাসান মিশু (সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র, বাড়ি রাজশাহী)।
কৃষক বাবার সন্তান তরিকুলের ইচ্ছা ছিল বিশ্ববিদ্যালয় পাস করে বিসিএস পরীক্ষা দেবেন। এর পর ভালো একটা সরকারি চাকরি নিয়ে পরিবারের দুঃখ ঘোচাবেন। কিন্তু তার সেই সুন্দর স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তার চলার পথ এখন প্রায় বন্ধ হতে চলেছে।
ছবিতে হলুদ টি-শার্ট পরা ছেলেটার নাম আবদুল্লাহ আল মামুন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের এই ছাত্র এখন গোটা দেশে ছাত্রলীগের ‘সুনাম’ ছড়াচ্ছেন। ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহসম্পাদক মামুনকে ওই দিন একটি হাতুড়ি নিয়ে দৌড়াতে দেখা যায়। ওই হাতুড়ি দিয়ে তিনি তরিকুল ইসলামের পায়ের হাড় ভেঙে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তরিকুলের পুরো শরীরে রয়েছে আঘাতের চিহ্ন। ছাত্রলীগ নেতাদের চাপাতি, বাশ, রড ও হাতুড়ির আঘাতে তরিকুলের মাথা, পা, মেরুদণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মাথায় একাধিক সেলাই পড়েছে। এখন হাসপাতালের বিছানা থেকে উঠতে পারছেন না তরিকুল।
ছাত্রলীগের সেই নেতারা
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা (২০১২-২০১৬) করার সময় অনেক নেতার কাছে দেশি-বিদেশি অাগ্নেয়াস্ত্র দেখেছি। বিভিন্ন সময় ওসবের ব্যবহারও দেখেছি। টেলিভিশনের মারফত দেশের মানুষও ওসবের ব্যর্থ ব্যবহার দেখেছে। সংগঠনে বিভোর হয়ে তারা পরিবারের কথা ভুলে গিয়ে দেদারছে অস্ত্র নিয়ে খেলতেন। এসব করতে গিয়ে যে ওই সময়টায় নিজেকে অন্যভাবে উপস্থাপন করতেন, হয়তো সেগুলো কখনোই বুঝতেন না।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী হয়েছে? ব্যক্তিগত জীবনে চরম ভদ্র একজন মানুষ ছিলেন ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক তৌহিদ আল তুহিন। শিবিরকে ‘প্রতিহত’ করতে গিয়ে তার এক হাতে পিস্তুল, আরেক হাতে চাপাতি দেখা গিয়েছিল একদিন। সংগঠনের জন্য একজন ‘অকুতভয় সৈনিক’ ছিলেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সঙ্গেও তার ছিল সখ্যতা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রত্ব নিয়ে যেতে পারেননি। মেধাবী এই ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনা থেকে চলে যেতে হয়েছে সনদ ছাড়াই। এখন তিনি এক সন্তানের বাবা। তার কাধে এখন সংগঠের চেয়ে পরিবারের দায়িত্বই বেশি। শিবিরের হাতে নির্মম আঘাতের ক্ষত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি।
একইভাবে তৎকালীন ছাত্রলীগের সহসভাপতি তন্ময় আনন্দ অভি এবং শহীদ হবিবুর রহমান হল কমিটির সভাপতি মামুন-অর-রশিদকে বহিস্কার করা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগ থেকে ছাত্রত্ব বাতিল হওয়া আখেরুজ্জামান তাকিম ভাইয়ের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। তিনি পরিবারের অনেক আদরের একজন মানুষ ছিলেন। কিন্তু ক্যাম্পাসে এসে ছাত্রলীগ করতে গিয়ে সব হারিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত ছাত্রত্ব হারানো এই নেতা শিবিরের নির্মম হামলায় এক ধরনের পঙ্গু হয়ে ক্যাম্পাস ছেড়েছেন।
আমাদের ক্যাম্পাস জীবনে সবচেয়ে আলোচিত ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন সুদিপ্ত ছালাম ভাই। অসাধারণ একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি। বাণিজ্য অনুষদে পড়াশোনা করা ওই ছাত্র ক্যাম্পাস জীবনে অনেক মামলা খেয়েছেন। সেই মামলার টাকা সংগ্রহ করতে গিয়ে তার পরিবারকে নিঃস্ব হতে হয়েছে। সংগঠন থেকে কোনো ধরনের সহায়তা করা হয়নি। অথচ, এই সংগঠনের জন্য তিনি কি না করেছেন। নিজের মেধা-মনন সব উৎসর্গ করেছিলেন। ক্যাম্পাস জীবনে তিনি অস্ত্রসহ ডিবি পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন। অমানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল তাকে। এখন তিনি মেধার জোরে অবশ্য একটি ব্যাংকে অফিসার পদে চাকরি করছেন।
আমার হল জীবনে অনেক সময় সহায়তা পেয়েছিলাম ছাত্রলীগ নেতা মামুন ভাইয়ের। তিনি সংগঠনের প্রেমে পড়ে শিবিরের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন। পড়াশোনা বাদ দিয়ে সর্বদা সংগঠনের পেছনে ছুটতেন। তার বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষের সময়গুলো শুধুই সংগঠনের জন্য কাজ করেছেন। কিন্তু শিবির তাকে বাঁচতে দেয়নি। এসআইয়ের চাকরি হওয়া এই তরুণকে নিজ এলাকায় কুপিয়ে মারা হয়েছিল।
এভাবে বললে অনেকের নাম বলা যাবে, যারা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সংগঠন করতে গিয়ে নিজের পুরো জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সনদ নিয়ে যেতে পারেননি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এর পেছনে নিজেদের যেমন দোষ ছিল, ছিল নিজেদের জীবনবোধ সম্পর্কে চরম উদাসীনতা, যার মাশুল দিতে হয়েছে।
হাতুড়িবাহক বা চাপাতিবাহকরা
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের হাতে অনেকেই রগ হারিয়েছেন, পা হারিয়েছেন, এমনকি জীবনও হারিয়েছেন। উল্টো শিবিরের কর্মীরাও বিভিন্নভাবে হামলার শিকার হয়েছেন এই ক্যাম্পাসেই। ২০১৪ সালের দিকে ক্যাম্পাসের অনেক ছাত্রলীগ নেতা নিজেদের রক্ষা করতে বা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে নিজেদের কাছে অগ্নেয়াস্ত্র রাখতেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, মামুনের মতো নেতারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের দমাতে ব্যবহার করছেন হাতুড়ি, যা এর আগে কখনই আমরা দেখিনি।
মানুম বা মানিকদের মতো ছাত্রলীগের কিছু নেতার ‘সন্ত্রাসী রূপ’ হয়তো বেশি দিন থাকে না। আবার সেটা দীর্ঘায়িত হতে পারে। এখন হয়তো তাদের খুঁটির জোর আছে। বিশ্ববিদ্যালয় বা বাইরের কেউ তাদের এসব করতে উৎসাহ দিচ্ছেন, সামনে এগিয়ে যেতে বলছেন। কিন্তু একটা সময় ছালাম, তাকিম, তুহিনের মতো এই ‘হাতুড়িবাহক’ মামুন বা ‘চাপাতিবাহক’ মানিকরা হারিয়ে যান। মামলার ভার সইতে গিয়ে তাদের পরিবারের সদস্যদের অনেক ভোগতে হয়। কিন্তু এত কিছুর পর মামুনরা খালি হাতে ফেরেন বাড়িতে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাদের সেই সনদটাও কেড়ে নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তাই কিছু করার আগে অতীত বা বর্তমান ভেবে কাজ করতে হয়। এটাই বুদ্ধিমানের লক্ষণ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন