সিলেট বিভাগের বৃহত্তর হাওড় হাকালুকিসহ বিভিন্ন হাওড়ে পাহাড়ী ঢল ও আকস্মিক বন্যায় ব্যাপক ফসলহানি হয়েছে। পাশাপাশি দেখা দিয়েছে মাছের মড়ক। আগাম বন্যায় তলিয়ে গেছে লাখ লাখ একর জমির ধান। জলমগ্ন ধান পচে এ্যামোনিয়া গ্যাস সৃষ্টি হয়েছে। পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাওয়ায় মাছের মড়ক দেখা দিয়েছে। ধান ও মাছ হাওড়ের দুই প্রধান সম্পদ হারিয়ে দিশেহারা হাওড়বাসী। এদিকে বিষাক্ত রাসায়নিকে মাছ মরে ভেসে ওঠায় হাওড়বাসী যখন মাছ ধরতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই হাওড় বিল জলাশয় অঞ্চলের জেলা প্রশাসন বৃহস্পতিবার রাত থেকে জনস্বার্থে সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এর পাশাপাশি সুনামগঞ্জের হালির হাওড়, শনির হাওড় ও খরচার হাওড়ের ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম তদন্তে এলাকায় গেছে দুদকের একটি দল। অসময়ের আকস্মিক বন্যায় ফসলরক্ষায় নির্মিত বেড়িবাঁধ হাওড় দ্বীপ খালিয়াজুরির ফসল রক্ষা করতে পারেনি। ৮৯ বেড়িবাঁধই পাহাড়ী ঢলে ভেঙ্গে গেছে। এতে নেত্রকোনার ৯ উপজেলার প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। কিশোরগঞ্জের হাওড় অধ্যুষিত ইটনা-মিটামইন-অষ্টগ্রামসহ কয়েকটি উপজেলায় আগাম বন্যায় বোরো ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। পরিযারী পাখির অভয়ারণ্য এসব হাওড়ে ধান গাছ পচে মাছ ও হাঁস মারা যাচ্ছে।
স্টাফ রিপোর্টার সিলেট অফিস থেকে জানান, হাকালুকিসহ বিভিন্ন হাওড়ে মাছের মড়ক দেখা দিয়েছে। হাওড়ের পাশাপাশি এবার কুশিয়ারা নদীতেও মাছের মড়ক দেখা দিয়েছে। বৃহস্পতিবার কুশিয়ারা নদীতে বিভিন্ন জাতের মরা মাছ ভাসতে দেখা গেছে। মাছের গায়ে লালচে ঘায়ের চিহ্ন রয়েছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, বুধবার রাত থেকে তারা এসব মরা মাছ দেখতে পাচ্ছেন। তবে এগুলো হাকালুকি হাওড় থেকে জুড়ি নদী হয়ে কুশিয়ারায় আসছে কিনা এটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এসব বিষাক্ত মাছ ধরা ও বিক্রয় নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও এক শ্রেণীর মৎস্যজীবী সেগুলো ধরে এনে বাজারজাত করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে কুশিয়ারা নদীর রেল ব্রিজের নিচে মাঝারি আকারের বোয়াল ও ছোট ছোট কাতলা মাছ পচে ভাসতে দেখা যায়। এ ব্যাপারে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা শফিকুল আলম বলেছেন, এককথায় এসব মাছ কিংবা এই মাছের শুঁটকি খাওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ। এগুলো খেলে ডায়রিয়াসহ নানা জটিল রোগ হতে পারে। বিষাক্ত এ্যামোনিয়া পেটে পড়লে মানবদেহের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। যেহেতু পানি বেশি ও চলমান, তাই আপাতত সচেতনতা বাড়ানো ছাড়া তেমন কিছু করার নেই। কেউ কোনভাবে আক্রান্ত হলে তাকে দ্রুত হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে অনুরোধ জানান তিনি। এদিকে হাকালুকি হাওড়ে স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে কয়েক দফা চুন ছিটানো হলেও বিশাল হাওড়ে তা তেমন কোন কাজে আসছে না। সিলেট সদর উপজেলার খাদিমনগর ইউনিয়নের সরিষাকান্দি, বাউয়ারকান্দি, ছড়ছড়িকান্দিসহ বিভিন্ন হাওড়ে ধান ও মাছ পচে গিয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। হাওড় বেষ্টিত এসব এলাকায় বাতাসে গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে।
সুনামগঞ্জে কৃষক পরিবারে আহাজারি বাড়ছে
নিজস্ব সংবাদদাতা সুনামগঞ্জ থেকে জানান, হাওড়ের বাঁধ ভেঙ্গে সুনামগঞ্জের প্রায় ৯০ ভাগ বোরো ফসল তলিয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাওড় পাড়ের শতভাগ কৃষক। স্থানীয়দের দাবি ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক পরিবারের সংখ্যা হবে অন্তত কয়েক লাখ। দুর্গম হাওড় এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মাঝে এখনও সরকারী ত্রাণ সহায়তা পৌঁছেনি। ধান ও মাছের জন্য সুনামগঞ্জের খ্যাতি দেশজোড়া এ বছর অকাল বন্যায় ধান তলিয়ে গেছে। আর তলিয়ে যাওয়া ধান পচে এ্যামোনিয়া গ্যাস তৈরি হচ্ছে। মারা যাচ্ছে মাছ। ফলে সব হারিয়ে এখন তাদের অসহায় অবস্থা। আর এর মধ্যেই চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম বৃদ্ধি করেছেন ব্যবসায়ীরা। সুযোগ বুঝে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এতে বর্তমানে তাদের জীবনধারণে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এদিকে হাওড় বিল জলাশয় অধ্যুষিত জেলা প্রশাসন বৃহস্পতিবার রাত থেকে জনস্বার্থে সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।
জানা যায়, ধর্মপাশা উপজেলার বাজারগুলোয় ৫০ কেজির প্রতিবস্তা চাল ২ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ মার্চেও এ চালের দাম ছিল ১ হাজার ৭০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা। আর শাল্লা উপজেলায় ব্যবসায়ীরা চালের দাম বৃদ্ধি করে দিয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন বাজারে চালের দাম বর্তমানে ২ হাজার ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা। ব্যবসায়ীদের এই দাম বৃদ্ধিতে অসহায় হয়ে পড়েছে হাওড়বাসী। এছাড়াও জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, দিরাই, ছাতকসহ সুনামগঞ্জের অন্যান্য উপজেলায়ও বেড়ে গেছে চালের দাম।
ধর্মপাশা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল হক বলেন, ‘কেউ যাতে অবৈধভাবে চাল মজুদ করতে না পারে ও চালের দাম বাড়াতে না পারে, সেজন্য নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চলছে।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলা সদরসহ প্রতিটি উপজেলার তিন পয়েন্টেসহ মোট ৪২ পয়েন্টে প্রতিদিন খোলাবাজারে ওএমএসের (ওপেন মার্কেট সেল) মাধ্যমে প্রতি কেন্দ্রে ৩ মেট্রিক টন চাল ও ৩ মেট্রিক টন আটা বিক্রি করা হচ্ছে। প্রতিটি উপজেলায় ৬শ পরিবারের মাঝে ১৫ টাকা কেজি দরে প্রতিদিন ৫ কেজি চাল ও ১৭ টাকা কেজি দরে ৫ কেজি আটা বিক্রি হচ্ছে। প্রত্যেক পরিবার ৫ কেজি চাল ও ৫ কেজি আটা কেনার সুযোগ পাচ্ছেন। গত ৯ এপ্রিল শুরু হওয়া এই কর্মসূচীর আওতায় এক মাসে ১২৬০ মেট্রিক টন চাল ও ১২৬০ মেট্রিক টন আটা বিক্রয় করা হবে।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের ত্রাণ ও পুনর্বাসন শাখা জানায়, সুনামগঞ্জের ৮২ ভাগ বোরো ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে প্রায় ৩ লাখ কৃষক পরিবার ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। গত ৩১ মার্চ থেকে ইতোমধ্যে জেলার বিভিন্ন এলাকায় ৬৬০ মে. টন চাল, ২৬ লাখ টাকা ও ১৫০ বান্ডিল ঢেউটিন বিতরণ করা হয়েছে। আরও ১০ মে. টন চাল, আড়াই লাখ টাকা ও ৩০ বান্ডিল ঢেউটিন মজুদ রয়েছে। প্রয়োজনে এসব ত্রাণ সহায়তার পরও প্রয়োজন হলে আরও বিতরণ করা হবে।
শাল্লা উপজেলার সদরের ডিলার স্বপন পালের বিরুদ্ধে ১৫ টাকা দরের ওএমএস চাল বিক্রিতে নানা দুর্নীতি অভিযোগ উঠেছে। উপজেলার কৃষক অনুজিত দাস জানান, ১৫ টাকা দরের ৫ কেজি চাল নিতে এসে ডিলাকে ৮০ টাকা দিতে হয়। তা না হলে চাল দিতে রাজি নয় তারা। জামালগঞ্জের সাচনাবাজারে ডিলারের কাছ থেকে ওএমএসের চাল কিনতে এসেছিলেন কৃষক মদরিছ আলী জানান, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত লাইনে দাঁড়িয়েও চাল না পেয়ে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে তাকে। শুধু মদরিছই নন এভাবে আরও অনেককেই খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে প্রতিদিন। এ এলাকার ওএমএস ডিলার আব্দুস সবুর বলেন, ‘প্রতিদিন আমাকে এক টন চাল ও এক টন আটা দিতে হয়। একজন প্রতিদিন পাঁচ কেজি করে আটা ও চাল কিনতে পারেন। এভাবে এক টন চাল ২০০ জনের কাছে বিক্রি করা সম্ভব হয়। কিন্তু প্রতিদিন লাইনে দাঁড়ান হাজারখানেক মানুষ। ফলে অনেককেই বঞ্চিত হতে হয়।
সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন বলেন, ‘লাইনে দাঁড়ানো অধিকাংশ মানুষই চাল পান না। ফলে তাদের অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাতে হচ্ছে। এ বিষয়ে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বিভিন্ন জায়গায় চালের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি ও দাম বাড়িয়ে বিক্রির অভিযোগ পাওয়া গেছে। এদের ধরতে প্রশাসন সচেষ্ট রয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের প্রচুর খাদ্য মজুদ রয়েছে। এরই মধ্যে জেলার ৪২ পয়েন্টে প্রতিদিন বিশেষ ওএমএসের মাধ্যমে চাল বিক্রি হচ্ছে। প্রয়োজনে এ সেবা আরও বাড়ানো হবে।’
ভারপ্রাপ্ত জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আব্দুর রউফ জানান, এই কর্মসূচী আরও বাড়ানো ও ওএমএস ডিলার সংখ্যাপ্রতি ইউনিয়নে ৪ জন করে বাড়ানোর জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয়ে ও খাদ্য অধিদফতরে চিঠি লেখা হয়েছে। কার্ডের মাধ্যমে ১০ টাকা কেজি দরে ৯১ হাজার ৫৯০ জনের কাছে চাল বিক্রি করা হয়েছে। এপ্রিল মাস পর্যন্ত চালু নির্দেশনা থাকলেও তা সারা বছর বিক্রি ও আরও নতুন ২ লাখ কার্ড বৃদ্ধির জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোন কিছুই অনুমোদন হয়নি।
এ বিষয়ে বুধবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য কালে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেন, আমাদের এই দুর্যোগ মোকাবেলার প্রস্তুতি ও সামর্থ রয়েছে। তিনি বলেন, ৬ মাস কেন, প্রয়োজনে ৬ বছর খাওয়ানোর মজুদ আমাদের রয়েছে। তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন একটি মানুষও না খেয়ে মারা যাবে না। মন্ত্রী সুনামগঞ্জ জেলার দেড় লাখ পরিবারকে তিন ধরনের খাদ্য সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
ফসলহানির পর এবার নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। হাওরে মাছের মড়ক লেগেছে। পানিতে তলিয়ে যাওয়া ধান পচে এ্যামোনিয়া গ্যাস তৈরি হয়েছে। এই গ্যাসের বিষক্রিয়ায় মাছ মরে ভেসে উঠছে। হাওরের মাছের মড়ক এখন নদ-নদী, খালসহ জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়ছে।
জেলা মৎস্য অফিস সূত্র জানায়, ডুবে যাওয়া ধানে ব্যবহৃত কীটনাশক ও সার পানিতে মিশে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, আধাপাকা ধান ও ধান গাছ পচে পানির গুণাগুণ নষ্ট করেছে। পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেছে। ফলে হাওড়াঞ্চলের সর্বত্র মাছ মরে গিয়ে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। এতে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। তারা এসব বিষক্রিয়াযুক্ত মাছ না খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে হাওড় এলাকার জনগণকে সতর্ক করে জাচ্ছেন। চিকিৎসকগণ এ্যামোনিয়া গ্যাসে আক্রান্ত মাছ না খাওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়ে বলছেন, বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হওয়ার ফলে এসব মরা মাছ খাওয়ায় হাওড় পাড়ের মানুষের ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। দুর্গন্ধযুক্ত দূষিত পানি ব্যবহারের ফলে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বাড়বে হাওড় এলাকায়। ফসলহারা কৃষক ও মৎসজীবীরা একে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা উল্লেখ করেছেন।
দুদক
সুনামগঞ্জে হাওড়ের ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণে ব্যাপক দুর্নীতি অভিযোগ ওঠার তদন্তে এসে দুর্নীতি দমন কমিশন বলেছে তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
গতকাল অনিয়ম তদন্তে দুদকের তিন সদস্যের একটি টিম সুনামগঞ্জের হালির হাওড়, শনির হাওড় ও খরচার হাওড়ের ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণে অনিময় তদন্ত করেন। পরিদর্শন শেষে বিকেল সাড়ে ৩টায় সুনামগঞ্জ সার্কিট হাউসের সম্মুখে দুদকের পরিচালক মোহাম্মদ বেলাল হোসেন সাংবাদিকদের বিফ্র করেন।
এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন, দুদকের উপ-পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার আবদুর রহিম ও সহকারী পরিচালক সেলিনা আক্তার মনি।
বেলাল হোসেন জানান, বাঁধগুলোতে আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ড, প্রকল্প কমিটির লোকজন কিংবা কোন ঠিকাদারকে পাইনি। জনগণকে পেয়েছি।
তিনি বলেন, আমরা দেখছি বাঁধ ভাঙ্গার পেছনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোন কর্মকর্তা, প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি অথবা ঠিকাদার দায়ি কি না। তদন্তে যারা দোষী প্রমাণিত হবেন দুদক তাদরে বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে। দুর্নীতি সঙ্গে জড়িত এবং দুর্নীতিতে যারা সহযোগিতা করেছে তাদের কাউকেই ছাড় দেব না।
তিনি আরও বলেন, কোন প্রকল্পে যদি পরিমাপ করে কাজ না পাওয়া যায় সেই প্রকল্পের বিল ছাড় দেয়ার আইনগত কোন সুযোগ নেই।
উল্লেখ্য, চলতি বোরো মৌসুমে সুনামগঞ্জে প্রায় সোয়া দুই লাখ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ হয়। আগাম বন্যায় হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে তলিয়ে যায় আবাদকৃত ফসলের প্রায় ৯০ ভাগ। এতে বিপাকে পড়েন জেলার সোয়া দুই লাখ কৃষক পরিবার।
নেত্রকোনার হাওড়াঞ্চল
নিজস্ব সংবাদদাতা, নেত্রকোনা থেকে জানান, কীর্তনখোলা, পাঙ্গাসিয়া, রাঙ্গামাটিয়াÑ এরকম নানা নামের ৮৯টি হাওড় আছে ‘হাওড়দ্বীপ’ খালিয়াজুরিতে। আর এ ৮৯টি হাওড়ের ফসল রক্ষার জন্য আছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ৮৯টি বেড়িবাঁধ। কিন্তু এ বছর একটি বেড়িবাঁধও খালিয়াজুরির ফসল রক্ষা করতে পারেনি। মার্চের শেষ থেকে এপ্রিলের শুরুতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলের তোরে একে একে সব ক’টি বাঁধই ভেঙ্গে গেছে। আবার কোন কোনটি ডুবেও গেছে। কৃষিবিভাগের তথ্যমতে, খালিয়াজুরি উপজেলার ২০ হাজার ৭০ হেক্টর বোরো জমির মধ্যে শতভাগই এখন পানির নিচে। অর্থাৎ এক ছটাক ধানও ঘরে তুলতে পারেননি খালিয়াজুরির কোন কৃষক। শুধু খালিয়াজুরিই নয়, মোহনগঞ্জ, মদন, কলমাকান্দাসহ নেত্রকোনার ৯টি উপজেলার প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে এবারের অকাল বন্যায়। আর এতে নিঃস্ব হয়েছেন লক্ষাধিক কৃষক। অভাব-অনটনের হাতছানিতে এসব পরিবার এখন দিশেহারা। ভরা বৈশাখে যেন ‘চৈতের আকাল’।
এদিকে ফসল নষ্টের পর এবার নতুন আরেক দুর্যোগ দেখা দিয়েছে নেত্রকোনার হাওড়াঞ্চলে। মোহনগঞ্জের সবচেয়ে বড় হাওড় ‘ডিঙ্গাপুতা’সহ আশপাশের বিভিন্ন হাওড়ে দেখা দিয়েছে মাছের মড়ক। ধান গাছ পচে এ্যামোনিয়া গাসের উৎপত্তি আর অক্সিজেনের অভাবে মরে ভেসে উঠছে নানা প্রজাতির মাছ। চৈত্রের অকাল বন্যা যেমন কৃষকদের কাছে নতুন, তেমনি এমন মাছের মড়কও এর আগে দেখেননি হাওড়ের বাসিন্দারা। স্থানীয়দের ভাষায় এটি ‘আল্লাহ্ও গজব’ ছাড়া আর কিছুই নয়।
সরেজমিনে ডিঙ্গাপুতা হাওড়ে গেলে তেঁতুলিয়া এলাকার কৃষক মক্রম আলী (৬০) ‘আল্লাহর গজব’ এর বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘ছোট্টু বেলা থাইক্যা কৃষি কাজ করি। কিন্তুক চৈত মাসে কোনুদিন পানিয়ে ফসল খাইতে দেখছি না। আর এইবায় মাছ মরতেও হুনছি না কোনুদিন’। তিনি জানান, বাপ-ছেলে মিলে পৌনে চার একর জমি চাষ করেছিলেন। ধান ক্ষেতে যুখন দুধ আসছিলÑ (মিল্কিং স্টেজ) তখনই চরহাইজদা বাঁধ ভেঙ্গে সমস্ত হাওড় তলিয়ে যায়। তার ঘরে এখন চাল নেই। বাজার থেকে চাল কিনে খাচ্ছেন। হাতও খালি। ওদিকে ধার-দেনার টাকা কিভাবে পরিশোধ করবেনÑ তারও কোন উপায় দেখছেন না। জমি বেচবেনÑ সে সুযোগ নেই। কারণ জমির ক্রেতা নেই। ফসল হারানোর কারণে হাওড়ের ধনী-গরিব সব কৃষক এখন একাকার। জানা গেছে, ফসল হারানোর পর হাওড়াঞ্চলের ঘরে ঘরে অভাব-অনটন দেখা দিয়েছে। এলাকায় কাজ না থাকায় অনেকে কাজের সন্ধানে দূর-দূরান্তের জেলায় চলে যাচ্ছেন। জানা গেছে, হাওড়ের কৃষকরা সাধারণত ব্যাংক, এনজিও বা মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে চাষাবাদ করে থাকেন। ফসল তোলার পর তা বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করেন। কিন্তু এবার ফসল বিনষ্টের সঙ্গে সঙ্গে ঋণ পরিশোধের ক্ষমতাও শেষ হয়ে গেছে। ব্যাংক থেকে আপাতত চাপ না দিলেও অন্যান্য ঋণের বোঝা ঠিকই চেপে আছে মাথার ওপর। এর কোন কূল-কিনারা দেখছেন না কেউই।
এদিকে ‘ধান আর মাছ’ এ দুই-ই হাওড়ের সম্পদ। হাওড়ের প্রধান পেশা কৃষি। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে মাছ ধরার পেশা। এখানকার ৯৫ ভাগ মানুষ ধান চাষ অথবা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। এরই মধ্যে সোনালি ধানের স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে। এখন ভাঙছে মাছ ধরার স্বপ্নও। মোহনগঞ্জের সবচেয়ে বড় ডিঙ্গাপুতা হাওড়সহ মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরির আশপাশের হাওড়গুলোতে ব্যাপক হারে দেখা দিয়েছে মাছের মড়ক। হাজার হাজার মাছ মরে ভেসে উঠছে পানিতে। পচা-দুর্গন্ধে টেকা যাচ্ছে না হাওড়-উপকূলের গ্রামগুলোতে। মোহনগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা দিলীপ কুমার সাহা জানান, হাওড়গুলোতে অকাল বন্যায় কাঁচা ধান গাছ পচে ‘এ্যামোনিয়া’ গ্যাসের সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে পানিতে অক্সিজেনের তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। প্রতি লিটার পানিতে যেখানে পাঁচ থেকে ছয় মিলিগ্রাম অক্সিজেন থাকার কথাÑ সেখানে আছে মাত্র দশমিক পাঁচ থেকে এক দশমিক আট মিলিগ্রাম। এ কারণে শ্বাসকষ্টে মাছ মরে যাচ্ছে। ওই কর্মকর্তা জানান, ডিঙ্গাপুতা হাওড়ে গত কয়েকদিনে অন্তত ২শ মে.টন মাছ মরে গেছে। এর মধ্যে রয়েছেÑ বোয়াল, বাইম, গুলশা, টেংরা, তারা বাইম, ইলিশ, ঘনিয়া, আইর, কাকিলা, পুঁটি প্রভৃতি প্রজাতির মাছ। এছাড়া মরে যাচ্ছে কাঁকরা ও শামুকসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী। তিনি আরও জানান, ডিঙ্গাপুতা হাওড়ে বছরে অন্তত ৬ হাজার মে. টন মাছ উৎপাদিত হয়। কিন্তু এ বছর মাছের উৎপাদন অনেক কম হবে। কারণ, মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত মাছের প্রজনন মৌসুম। এ সময়ে মড়ক দেখা দেয়ায় প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে। তবে মাছের মড়ক রোধে ইতিমধ্যে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে স্থানীয় মৎস্য বিভাগ। পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা বৃদ্ধির জন্য তারা ৩৫ কেজি ‘অক্সিফ্লো’ এবং দুর্গন্ধ দূর করতে আড়াই টন চুন প্রয়োগ করেছে মাছের আশ্রয়স্থলগুলোতে। বৃষ্টির পানি বাড়লে মড়ক কিছুটা কমতে পারে বলে জানান তিনি। এদিকে মৎস্য অধিদফতর এবং মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রতিনিধি দল ইতিমধ্যে আক্রান্ত এলাকা পরিদর্শন করে পানি ও মাছের নমুনা পরীক্ষা করেছেন। কৃষকদের পাশাপাশি মাছের মড়কে কারণে হাওড়ের মৎস্যজীবীরাও এখন দিশেহারা অবস্থায়। অন্যবারের মতো মাছ পাওয়া যাবে নাÑ এমন দুশ্চিন্তা মৎস্যজীবীদের কঠিন সঙ্কটে ফেলে দিচ্ছে।
এদিকে হাওড়াঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের জন্য সরকারী সাহায্য যা বরাদ্দ হয়েছে তা খুবই অপ্রতুল বলে জানা গেছে। জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সারা জেলায় নগদ মাত্র ২১ লাখ টাকা এবং ২৪৭ মে. টন চাল বরাদ্দ করা হয়েছে। ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বারদের মাধ্যমে এসব ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। খালিয়াজুরি উপজেলার ইউএনও মোহাম্মদ তোফায়েল আহমেদ জানান, ওই উপজেলায় এ পর্যন্ত ৭৬ মে. টন চাল এবং ৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা বিতরণ হয়েছে। চাহিদার তুলনায় এই সাহায্যের পরিমাণ অতি নগন্য। খালিয়াজুরি সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছানোয়ারুজ্জামান জোশেফ জানান, আমার ইউনিয়নে সাহায্য প্রার্থীর সংখ্যা অন্তত পাঁচ হাজার। কিন্তু এ পর্যন্ত আমি মাত্র ৯শ’ জনকে সর্বনি¤œ ৫ থেকে ১৫ কেজি করে চাল দিতে পেরেছি। সাহায্যের জন্য প্রতিদিন আমার কাছে শত শত মানুষ আসছেন। এদিকে খালিয়াজুরি সদরে মাত্র তিনজন ডিলারের মাধ্যমে দৈনিক তিন মে.টন চাল এবং তিন মে.টন আটা ‘ওএমএস’ কর্মসূচীর আওতায় বিক্রি হচ্ছে। সদরের বাইরের কোন ইউনিয়নে ওএমএসের ডিলার নিয়োগ করা হয়নি। সঙ্গত কারণেই প্রতিটি ইউনিয়নে এমনকি প্রত্যেক ওয়ার্ডে ওএমএস কর্মসূচী চালু এবং ত্রাণ বরাদ্দ বৃদ্ধিও দাবি উঠেছে। কারণ ওই উপজেলার প্রায় প্রত্যেকটি কৃষকের হাত এখন সাহায্য প্রার্থীর হাত।
কিশোরগঞ্জ
নিজস্ব সংবাদদাতা কিশোরগঞ্জ থেকে জানান, জেলার হাওড় অধ্যুষিত ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রামসহ পার্শ্ববর্তী কয়েকটি উপজেলায় আগাম বন্যায় কৃষকের উৎপাদিত একমাত্র বোরো ফসল পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। হাওড়াঞ্চলের মানুষের এ ফসলের ওপর নির্ভর করে সারা বছর ব্যয় নির্বাহ করত। কিন্তু আকস্মিক অতি বৃষ্টি আর উজানের পানিতে হাওড়ের সব ধান এখন পানির নিচে।
অন্যদিকে হাওড়াঞ্চলে পচে যাওয়া ধান থেকে ‘এ্যামোনিয়া গ্যাস’ জন্ম নেয়ায় বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মাছ মরে যাচ্ছে। আর মরা মাছ খেয়ে হাঁসও মারা যাচ্ছে। এ অবস্থায় কিশোরগঞ্জের হাওড়াঞ্চলের স্থানীয়দের মতে, অষ্টগ্রাম উপজেলাসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার হাওড়ে বন্যার পানিতে কিছুসংখ্যক মাছ মরে যাওয়ার তথ্য জানা গেছে। তবে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ আমিনুল ইসলামের মতে, কিশোরগঞ্জের হাওড় অধ্যুষিত কোন এলাকায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত অক্সিজেনের অভাবে মাছের ও হাঁস মরে যাওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করে আরও জানান, এ অঞ্চলের পানিতে স্রোত থাকায় এবং গত কয়েকদিনে বৃষ্টি হওয়ায় পানিতে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন ছিল। ফলে অক্সিজেনের অভাবজনিত কারণে হাওড়ের কোন এলাকায় মাছ মরে যাওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে বাতাস থেকে হাঁস স্বাভাবিকভাবে অক্সিজেন গ্রহণ করায় এখনও কোন হাঁস মারা যায়নি বলে তিনি নিশ্চিত করেছেন। তাছাড়া প্রতিনিয়ত সংশ্লিষ্ট উপজেলার ইউএনও, উপজেলা ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে। প্রতিনিয়ত এ বিষয়ে ভিজিল্যান্স টিম মাঠপর্যায়ে কাজ করছে। তারাও মারা যাওয়ার কোন তথ্য দিতে পারেনি।
অপরদিকে হাওড়ে আগাম বন্যায় ব্যাপক ফলসহানির ফলে সুযোগ সন্ধানী এক শ্রেণীর মজুদদার ধান চাউলের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ধান চালের বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ধান চাউল সংগ্রহ কমিটির প্রয়োজনীয় মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকায় বাজারগুলোতে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে এমনটি করে যাচ্ছে। ফলে এর প্রভাব পড়েছে জেলা শহরসহ বিভিন্ন উপজেলার চালের খুচরা ও পাইকারি বাজারগুলোতে। ধান-চালের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় খেটে খাওয়া মানুষের ভোগান্তি চরম আকার ধারণ করেছে। বাজার মনিটরিংয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নেই তৎপরতা। ফলে মজুদদারদের এখন পোয়াবারো।
পাঠক মন্তব্য
Ja, no… I dunno if I’d limit myself to Johannesburg, since there are so many other cities in the world I’ve never experienced, but I’ve done the o20;d2rpie⁙ thing and it’s so not for me!.-= MeeA´s last blog .. =-.
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন