জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বদলে যাচ্ছে ঋতুচক্র। সময়ে দেখা না মিললেও অসময়ে বৃষ্টির বাড়াবাড়ি হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে। শীতও তার প্রচলিত সময়ের নিয়ম মানছে না। আবার বন্যাও ব্যাকরণ ভুলে হানা দিচ্ছে অসময়ে। এর প্রভাব পড়ছে জীবন ও প্রকৃতিতে। শুধু বাংলাদেশ নয়, আবহাওয়ার এ বৈরী আচরণ চলছে দক্ষিণ এশিয়া জুড়েই। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা ও জাতিসংঘের আন্তঃসরকার জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত প্যানেল (আইপিসিসি) বলছে, শিল্পোন্নত দেশগুলোর বিপুল কার্বন নিঃসরণের ফলে বিশ্বের তাপমাত্রা দিনের পর দিন বৈরী হয়ে উঠছে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মমতার শিকার বাংলাদেশ। এ কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়েছে। প্রকৃতি তার কোমলতা হারিয়েছে। আবহাওয়ার খামখেয়ালি আচরণ আগামী দিনে আরও বাড়বে। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনা নতুন কিছু নয়। তবে এর মাত্রা বেড়ে যাওয়ার মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে।
ষড়ঋতুর এ দেশে কার্তিক ও অগ্রহায়ণ হেমন্ত ঋতু। হেমন্ত মানেই শিশিরস্নাত প্রহর। এ সময় সোনালি ফসলে ভরা থাকে মাঠ। হেমন্তের প্রথম মাস কার্তিকে ধানে পাক ধরে। কার্তিকের দ্বিতীয় সপ্তাহ পার হতে চলেছে। কিন্তু এখনও প্রকৃতিতে নেই শীতের আমেজ। শ্রাবণের মতোই বৃষ্টি ঝরেছে। অক্টোবরের শেষে এবারের বৃষ্টিপাতের এই চিত্র স্বাভাবিক নয়। আবার রাত পেরিয়ে বেলা অবধি কুয়াশার ঘন আস্তরণ বিভ্রান্ত করে অনুভূতি শক্তিকে।
প্রতি বছর ১০০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। বৃষ্টিপাত আরও বাড়লে বাংলাদেশ, ভারত ও চীনের ১৩ কোটি ৭০ লাখেরও বেশি মানুষ ঝুঁকিতে পড়বে। ২০১২ সালের এক গবেষণায় এ তথ্য মিলেছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ওই গবেষণার শিরোনাম ছিল এশিয়ায় সবুজ নগরায়ন (গ্রিন আরবানাইজেশন ইন এশিয়া)। সমীক্ষায় দেখা গেছে, বৃষ্টির কারণে
১৯৫০ সাল থেকে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে চীন, ভারত এবং বাংলাদেশে। বেলজিয়ামের ইউনিভার্সিটি ক্যাথলিক দ্য লোভেনের তথ্য অনুসারে ১৯৫০ সাল থেকে এ পর্যন্ত বৃষ্টি-বন্যায় ২২ লাখ লোক প্রাণ হারিয়েছেন।
রাজধানীতে গত শুক্র ও শনিবার দুই দিন মিলিয়ে ২১২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এতে রাজধানীর রাজপথে ছিল থৈথৈ জল, চলেছে নৌকা। মানুষের দুর্ভোগের সীমা ছিল না।
বৃষ্টিপাতের ধরনে এই যে পরিবর্তন তার সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছেন দেশের কৃষক। সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জসহ হাওরাঞ্চলের মানুষ বছরের পর বছর ধরে দেখে আসছে, এপ্রিলের শেষ কিংবা মে'র প্রথম সপ্তাহে আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢল নামে। কৃষকদের প্রস্তুতিও থাকে ওই সময়কে ধরে। অথচ এবার মার্চের শেষের দিকে অতিবৃষ্টিতে উজান থেকে নেমে আসা ঢলে হাওরের ধান তলিয়ে যায়। এ বছর ব্রহ্মপুত্র নদের উজানে ১০০ বছরের রেকর্ড বৃষ্টি হয়েছে। ওই পানি উজানের এলাকা বাংলাদেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চল দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ার সময় দেশের প্রায় ৮০ লাখ মানুষের ক্ষতি করে গেছে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত সমকালকে বলেন, এ বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে ব্যাপক বৃষ্টি হয়েছে। বাংলা চৈত্র মাসেও আষাঢ় মাসের মতো বৃষ্টি হয়েছে। অসময়ের বন্যায় হাওরের ফসলহানি হয়েছে। এ অঞ্চলে তাপমাত্রাও ঘন ঘন পরিবর্তন হচ্ছে। সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ছে। এ বছর পাহাড়ে ৪০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। যাতে পাহাড়ধস হয়েছে। এবার উত্তর বঙ্গোপসাগরের মৌসুমি বায়ুর অক্ষ ভারতের ওড়িশা ও উত্তর প্রদেশে সক্রিয় ছিল। মূলত উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত এই মেঘমালা হিমালয়ের পাদদেশীয় অঞ্চলে প্রবল বৃষ্টি ঝরাচ্ছে। ওই অঞ্চলেই ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা অববাহিকার উৎস। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে অসময়ে বৃষ্টি, খরা ও বন্যার ঘটনা ঘটছে।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. হাফিজুর রহমান বলেন, আগামী মাসে জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ জার্মানির বনে বসবেন। প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী বছরে ১শ' বিলিয়ন ডলার দেওয়ার কথা শিল্পোন্নত দেশগুলোর। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক শিল্পোন্নত দেশ এ চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ফাঁকফোকর খুঁজছে। উন্নত বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন রোধের লাগাম এখনই টেনে না ধরলে আবহাওয়ার বৈরী আচরণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে স্বল্পোন্নত দেশগুলো।
আবহাওয়া বিশ্নেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এল-নিনোর শিকার দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো। এতে কোনো কোনো বছর কৃষি মৌসুমে তীব্র খরা হচ্ছে। আবার কোনো কোনো মৌসুমে অতিবৃষ্টি বা ঘন ঘন বন্যা হচ্ছে। আবহাওয়ার এ বৈরী আচরণের প্রভাব কৃষির ওপর সরাসরি পড়ছে। দেশের বরেন্দ্র অঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির সংকটও দিনকে দিন বাড়ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বর্তমান কৃষি ব্যবস্থায়ও বিপর্যয় নেমে আসবে।
বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর গত বছর 'বাংলাদেশের জলবায়ু' শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই গবেষণায় আবহাওয়ার বৈরী আচরণের চিত্র উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, প্রতি বছর বৃষ্টিপাত টেকনাফে ৩৬ শতাংশ, কক্সবাজারে ২২ এবং পটুয়াখালী ও বরগুনায় ১৫ ও ১০ শতাংশ করে বাড়ছে। অন্যদিকে ভোলা ও খুলনা-বাগেরহাট এবং সাতক্ষীরায় বৃষ্টিপাত ২০ শতাংশ করে কমে যাচ্ছে। গবেষণায় গত ৩০ বছরে দেশের চট্টগ্রাম বিভাগে বৃষ্টিপাত অব্যাহতভাবে বাড়ছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। সংশ্নিষ্টরা আশঙ্কা করছেন, অতিবৃষ্টির কারণেই পার্বত্য এলাকায় পাহাড়ধস বাড়ছে। অন্যদিকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় লবণাক্ততা বাড়ছে। এতে ফসল উৎপাদন বিপর্যস্ত হচ্ছে।
জলবায়ু বিশেষঞ্জ ড. আরিফুল হক বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রকৃতি বৈরী হয়ে উঠছে। তার স্বাভাবিক আচরণ পাল্টাচ্ছে। এতে দেশের কৃষি ও জীববৈচিত্র্য সংকটে পড়েছে। কৃষির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। জনজীবনও নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছে। প্রকৃতির নতুন এ আচরণের সঙ্গে মিলিয়ে চলা ছাড়া বিকল্প কিছু নেই। শিল্পোন্নত দেশগুলো কার্বন নির্গমন না কমালে এ থেকে মুক্তি মিলবে না।
বিশ্বব্যাংকের পরিবেশ অর্থনীতিবিদ সুস্মিতা দাশগুপ্ত বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা করছেন।
সেই গবেষণায় দেখা গেছে ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ২০ সেন্টিমিটার বাড়বে। বর্তমানে উপকূলীয় এলাকার ৪৩ লাখ মানুষ সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার। ২০৫০ সালে এই সংখ্যা দাঁড়াবে ৫৩ লাখে। বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২৫ লাখ গরিব মানুষ, যাদের মধ্যে ১৪ লাখ চরম দরিদ্র তারা লবণ পানির কারণে পানীয় জল ও শুকনো মৌসুমে চাষাবাদের জন্য পানি সংকটে ভোগে। ২০৫০ সাল নাগাদ পানির এই লবণাক্ততা আরও বাড়বে বলে গবেষণায় বলা হয়েছে। তখন ৫২ লাখ মানুষ এর নেতিবাচক প্রভাবের শিকার হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন