‘হে সূর্য! শীতের সূর্য!/হিমশীতল সুদীর্ঘ রাত তোমার প্রতীক্ষায়/আমরা থাকি/যেমন প্রতীক্ষা করে থাকে কৃষকের চঞ্চল চোখ/ধানকাটার রোমাঞ্চকর দিনগুলির জন্যে।’- সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘প্রার্থী’ কবিতার মতোই পৌষের শেষ দিকে এসে ভয়ানক শীত পড়েছে দেশজুড়ে। সাধারণ মানুষের কাছে শৈত্যপ্রবাহের কামড় বসানো হিমঘন রাতগুলো সুদীর্ঘই বটে। দরিদ্র গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অবস্থা সবচেয়ে নাজুক। রাতভর শীতে কাঁপছে আর অপেক্ষার প্রহর গুনছে, কখন সূর্য উঠবে? তাদের কাছে সত্যি সত্যিই ‘সকালের এক টুকরো রোদ্দুর/এক টুকরো সোনার চেয়েও মনে হয় দামী।’
প্রচ- শীতে গত চব্বিশ ঘণ্টায় চার জেলায় অন্তত সাতজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। অসুস্থ হয়ে পড়েছে অনেক শিশু। বৃদ্ধদের অবস্থাও নাজুক। শৈত্যপ্রবাহ আর ঘন কুয়াশায় উত্তরের বেশিরভাগ জেলায়ই তাপমাত্রা কমে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে যাওয়ায় জবুথবু হয়ে পড়েছে জনজীবন। দেশের অন্য অঞ্চলগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। কনকনে ঠা-ার মধ্যে কাজে যেতে না পেরে বিপাকে পড়েছেন দিনমজুর, রিকশা-ভ্যানচালক ও শ্রমিক। চরম দুর্ভোগে দুস্থ ও ভাসমান মানুষ। দেশের বেশিরভাগ সড়ক ও নৌপথে ঘন কুয়াশায় বিঘিœত হচ্ছে যান চলাচল। এমনকি বিমান চলাচলও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
কয়েক দিন ধরেই শীতে কাঁপছে সারা দেশ। দিন দিন শীতের তীব্রতা বাড়ছে অনেকটা পাল্লা দিয়ে। উত্তরবঙ্গ ছাপিয়ে অব্যাহত শৈত্যপ্রবাহ ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে।
হাড়কাঁপানো শীতে বিভিন্ন রোগ দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা প্রায় প্রতিদিনই নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। রাজধানীর ঢাকা শিশু হাসপাতাল ও ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়ারিয়াল ডিজিজ রিসার্চ, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) ঘুরেও এমন তথ্যই পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা জানান, হাসপাতালে ঠা-াজনিত রোগী বেশি আসছে। গত কয়েক দিনে শীত বাড়ায় শিশু ওয়ার্ডে রোগীর চাপ বেশ বেড়েছে। বিশেষ করে নিউমোনিয়া, ব্রংকাইটিস, শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, হাঁপানি, সর্দি-জ্বর ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে অভিভাবকরা হাসপাতালে আসছেন।
ভাসমান, ছিন্নমূল ও শ্রমজীবী মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীর উপস্থিতিও কমে গেছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, দুদিনের উপমহাদেশীয় উচ্চচাপ বলয়ের কারণে মেঘ কেটে গেছে। ফলে শীতল বায়ু দেশের অভ্যন্তরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। তাই হঠাৎ করে শীত বেড়ে গেছে। এ অবস্থা আরও কয়েক দিন থাকতে পারে। মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়ার আভাস দেওয়া হয়েছে। দেশের কোথাও কোথাও দুপুর পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকতে পারে। রাজশাহী, পাবনা, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া অঞ্চলের ওপর দিয়ে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। শ্রীমঙ্গল ও সীতাকু-সহ ঢাকা, ময়মনসিংহ ও বরিশাল বিভাগ এবং রাজশাহী, রংপুর ও খুলনা বিভাগের অবশিষ্ট অংশের ওপর দিয়ে যে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে, তা অব্যাহত থাকতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর আরও জানিয়েছে, চলমান শৈত্যপ্রবাহ আরও কয়েক দিন অব্যাহত থাকবে। তবে শৈত্যপ্রবাহ কমে গেলেও ১০ তারিখ থেকে জানুয়ারি মাসজুড়েই শীতের অনুভূতি বিরাজ করবে সারা দেশে।
অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, গতকাল সকাল ৬টার আগের ২৪ ঘণ্টায় দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে দিনাজপুরে ৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়া অফিস জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় রাজশাহীতে ৫ দশমিক ৩, ইশ্বরদীতে ৫ দশমিক ৫, চুয়াডাঙ্গায় ৫ দশমিক ৩, বদলগাছীতে ৬, যশোরে ৬ দশমিক ৩, সাতক্ষীরায় ৭, সৈয়দপুরে ৭ দশমিক ২, রংপুরে ৭ দশমিক ৫, কুমারখালীতে ৭ দশমিক ৬, বরিশালে ৭ দশমিক ৮, তাড়াশে ৮, খুলনায় ৮ দশমিক ৬, ময়মনসিংহে ৮ দশমিক ৭, সিলেটে ১০ দশমিক ৫, ঢাকায় ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।
এদিকে তীব্র শীত কেবল গ্রামাঞ্চলকেই ছুঁয়ে যায়নি, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে রাজধানীবাসীও। অফিস-আদালতের জরুরি তাড়া ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। সন্ধ্যা হতেই রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। শীতের প্রভাব গ্রামাঞ্চলে পড়েছে সবচেয়ে বেশি। তীব্র শীতের কারণে ঘর থেকে বের হতে পারছেন না বেশিরভাগ মানুষ। গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষের জীবিকা যেন স্থবির করে দিয়েছে শীত। রাস্তার মোড়ে মোড়ে আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করতে দেখা গেছে গতকাল দেশের অনেক অঞ্চলে। কনকনে শীতে জবুথবু হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষসহ প্রাণিকুলও। দেশের অনেক এলাকায় দিনের বেলায়ও সূর্যের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না।
জেলা-উপজেলা থেকে প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর
রাজশাহী : টানা তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে উত্তরের শহর রাজশাহীর ওপর দিয়ে। দিনভর হিমেল হাওয়ার সঙ্গে কুয়াশার মিশেলে হাড়কাঁপানো শীত পড়ছে। ফলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ।
রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আশরাফুল আলম জানান, শনিবার ভোরে রাজশাহীতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৫ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চুয়াডাঙ্গায়ও একই তাপমাত্রা রেকর্ড হয়। কিন্তু রবিবার রাজশাহীতে সেই তাপমাত্রা আরও কমে ৫ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমেছে। বৃহস্পতিবার থেকে রাজশাহীতে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়। ওই দিন রাজশাহীতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর পর শুক্রবার সামান্য বেড়ে তাপমাত্রা দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
গাইবান্ধা : সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও সদরের চরাঞ্চলের দরিদ্র পরিবারগুলো শীতবস্ত্রের অভাবে চরম দুর্ভোগের মুখে পড়েছে। এ ছাড়া ঘন কুয়াশার কারণে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনাসহ বিভিন্ন নদনদীতে নৌ চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। সকালের দিকে সড়কপথে যানবাহন চলাচল করছে হেডলাইট জ্বালিয়ে। গাইবান্ধা সদর হাসপাতালে গত পাঁচ দিনে কোল্ড ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ১০৫ শিশু ভর্তি হয়েছে বলে হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডের ইনচার্জ শামচ্ছুন্নাহার জানান।
ফুলছড়ির ফজলুপুর ইউপি চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন জালাল জানান, শীতে তার ইউনিয়নে প্রায় ১০ হাজার দরিদ্র লোক অতিকষ্টে রয়েছে। এ পর্যন্ত সেখানে মাত্র জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে ৩৭৫ জনকে কম্বল বিতরণ করা হয়েছে।
সুন্দরগঞ্জের বেলকা ইউপি চেয়ারম্যান ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ জানান, তার ইউনিয়নে ছিন্নমূল পরিবারের সংখ্য ৫ হাজার। এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে ৪০০ শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. ইদ্রিস আলী জানান, গাইবান্ধায় এ পর্যন্ত ৫৪ হাজার ৭৫০ পিস শীতবস্ত্র দরিদ্র পরিবারগুলোর মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। আরও প্রায় ৭০ হাজার কম্বলের চাহিদাপত্র অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে।
সুন্দরগঞ্জ : শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে গতকাল রবিবার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলো মধ্য বেলকা গ্রামের ফিরিদুল ইসলামের মেয়ে মজিদপাড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী তানজিনা আক্তার তৃষা, উত্তর মরুয়াদহ গ্রামের আব্দুর রহমান (৭০) ও একই গ্রামের বঙ্কিম চন্দ্র (৬০)। বেলকা ইউপি চেয়ারম্যান ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ্ ও ছাপড়হাটী ইউপি চেয়ারম্যান কনক কুমার গোস্বামি তিনজনের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করেন।
রানীনগর : গত কয়েক দিনের টানা শৈত্যপ্রবাহে নওগাঁর রানীনগরে জেঁকে বসেছে প্রচ- শীত। এ পর্যন্ত উপজেলা প্রসাশনের পক্ষ থেকে প্রায় আড়াই হাজার শীতবস্ত্র বিতরণ করা হলেও আরও প্রায় ৪ হাজার শীতবস্ত্রের চাহিদা পাঠানো হয়েছে। প্রচ- শৈত্যপ্রবাহে গতকাল রবিবার দুপুরে আব্দুল জলিল (৬৫) নামের এক বৃদ্ধ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। তিনি উপজেলার সিম্বা গ্রামের বাসিন্দা।
সৈয়দপুর : নীলফামারীর সৈয়দপুরে শৈত্যপ্রবাহ ও হিমেল হাওয়ায় স্বাভাবিক জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। গতকাল রবিবার সকালে শীতজনিত কারণে দুইজন মারা গেছে। তারা হলেন শহরের নয়াটোলা মহল্লার শাহজাদা আলী (৭০) ও উপজেলার কামারপুকুর ইউনিয়নের কিসামত কামারপুকুর গ্রামের লায়লা বেগম (৬৫)। এদিকে শীত জেঁকে বসায় শিশু ও বৃদ্ধরা শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। সৈয়দপুর ১০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও) ডা. আরিফুল হক সোহেল জানান, হঠাৎ শীত বেড়ে যাওয়ায় প্রতিদিন শতাধিক শীতজনিত রোগী হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে আসছেন।
লালমনিরহাট : শৈত্যপ্রবাহে লালমনিরহাটের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। গতকালও দেখা মেলেনি সূর্যের। চরম দুর্ভোগে পড়েছে খেটে খাওয়া ছিন্নমূল মানুষ। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শীতজনিত রোগবালাই। বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বয়স্করা। শনিবার সন্ধ্যায় শীত নিবারণের জন্য আগুন পোহাতে গিয়ে জেলার পাটগ্রাম উপজেলার শ্রীরামপুর ইউপির ঝালংগী গ্রামের রফিকুল ইসলামের স্ত্রী ফাতেমা (৫৬) অগ্নিদগ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন। রংপুর মেডিক্যালে নেওয়া হলে রবিবার সকালে তার মৃত্যু হয়। পাটগ্রাম থানার ওসি অবনি শংকর কর ও শ্রীরামপুর ইউপি চেয়ারম্যান হাশেম আলী এ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন।
ঝিনাইগাতী : প্রচ- শীত পড়েছে শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলায়। গতকাল রবিবার বেলা ১১টা পর্যন্ত সূর্যের দেখা মেলেনি। গত বৃহস্পতিবার থেকে টানা ৪ দিনে সূর্যের লুকোচুরি ও মৃদু শৈত্যপ্রবাহে দুর্ভোগ বেড়েছে মানুষের। সেই সঙ্গে বেড়েছে শীতজনিত রোগ।
দিনাজপুর : শৈত্যপ্রবাহে বেকার হয়ে পড়েছে কর্মজীবী মানুষ। অনেকেই ছুটছেন গরম কাপড়ের দোকানগুলোয়। শিশু ও বৃদ্ধদের অবস্থা সবচেয়ে নাজুক। ঠা-া ও শীতজনিত নানা রোগে অসুস্থ হয়ে অনেকেই হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। গতকাল রবিবার দিনাজপুরে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়।
জেলা ত্রাণ কর্মকতা মোখলেসুর রহমান জানান, দিনাজপুরে পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র রয়েছে। ইতোমধ্যে জেলার ১৩ উপজেলা এবং আট পৌরসভায় ৭০ হাজার কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। মজুদ আছে ৬ হাজার কম্বল।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন