‘২০ বছর থাকি মাছ ধরি, বাজারোর ব্যাঁচে সংসার চালাও। কয় বছর থাকি অবস্থা খুব খারাপ, নদীত বেশি পানি নাই, মাছো নাই। অল্প এ্যানা পানি আছে তাত মাছো পাওয়া যায় না, ঘণ্টার পর ঘণ্টা জাল ফ্যালে অল্প কয়টা পাওয়া যায়, সংসার চলে না, হাতোত পাইসা কড়িও নাই’।
এভাবে কষ্টের কথা বলছিলেন নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার গোলমুন্ডা ইউনিয়নের পশ্চিম খামাতপাড়া গ্রামের জেলে আমিনুর রহমান(৬৫)। স্ত্রী সন্তানসহ ১০ জনের সংসার তার। স্থানীয় খাল-বিল, তিস্তা ও বুড়িতিস্তায় মাছ ধরে সংসার চালান তিনি।
ডিমলা উপজেলার খালিশা চাপানী ইউনিয়নের ছোটখাতা গ্রামের ছাইদুল ইসলাম ফরজ। নদীতে মাছ ধরে সংসার চালানো একমাত্র পথ তার। কিন্তু পর্যাপ্ত পানি না থাকায় নদীতে মাছও নেই।
আক্ষেপ করে ছাইদুল ইসলাম বলেন, সারাদিন বসি থাকি এক কেজি মাছ উঠে না জালোত। খায়া না খেয়া বসি থাকির নাগে নদীর পাড়োত। হামার এইলার যে কি হইবে।
তিনি বলেন, সরকার নাকি জেলেদের আইডি কার্ড দিয়া ভাতার ব্যবস্থা করিছে, কই হামরাতো কিছুই পাইছি না। অভাবের এই সময়ে যদি কিছু পাওয়া যাইতো তাহলে ভালোই হইতো।
একই উপজেলার পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়নের কলোনি এলাকার আয়নাল হক। তিস্তা নদীর জিরো পয়েন্ট থেকে তিস্তা ব্যারেজ পর্যন্ত নৌকায় ঘুরে বেরিয়েও পর্যাপ্ত মাছ পান না নদীতে।
তিনি বলেন, যখন অভাব পড়ে, চারদিকে অভাব পড়ে। হামার তি কাহো দেখে না। তিস্তা নদী পাড়ে অন্তত পাঁচ’শ জেলে রয়েছে, তারা যে কিভাবে চলে, কেউ একবার খোঁজও করে না। হামার কষ্টের শেষ নাই।
আয়নাল হক বলেন, হামার নদীত মাছ ধরা ছাড়া আর কি করার আছে। অন্য কোনোঠে যাবারও পাই না। তিন বেলা খাওয়া কষ্টকর হয়া পড়িছে। বর্ষার সময় নদীত পানি থাকায় বেশ মাছ পাওয়া যায় আর বাকিটা সময় খান খান(শূন্যতা)।
তিস্তা এলাকা ঘুরে এভাবে করুণ চিত্র জানা গেলো জেলেদের কাছ থেকে। অভাব অনটন এখন তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী।
খালিশা চাপানি ইউনিয়নের মাছ ব্যবসায়ী আব্দুস সবুর বলেন, আগের মত আর মাছ পাওয়া যায় না তিস্তা নদীত। দূর দূরান্ত থেকে মাছ নিবার জন্য মানুষ এইঠে ভিড় করছিলো, এখন আর ওই রকম দেখা যায় না। আশপাশের বাজারগুলোতেও মাছ পাওয়া যায় না তেমন। মানুষ ঠিকমত মাছ খেতেও পারছে না।
শুধু আমিনুর রহমান, ছাইদুল ইসলাম কিংবা আয়নাল হকই নয় নীলফামারী জেলার ৩২ হাজার জেলে পরিবারে চলছে এখন দুর্দিন। উপার্জন অনেকটা বন্ধ হয়ে থাকায় ধার দেনা করে চলতে হচ্ছে তাদের।
আন্তর্জাতিক নদী তিস্তা ছাড়াও বুড়িতিস্তা, চারালকাটা, বুড়িখোড়া, যমুনেশ্বরী, খড়খড়িয়া, দেওনাই, খেড়ুয়া, শালকি, নাউতারা, কুমলাই, ধুম, ধাইজান, চিকলি, আউলিয়াখানা নদী মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন কয়েক হাজার জেলে পরিবার।
চলমান শুষ্ক মৌসুমে নদ-নদী, খাল-বিলগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়ায় মাথায় বাঁজ পড়েছে তাদের। হাত গুটিয়ে বসে থাকা ছাড়া কোনো উপায় নেই অসহায় জেলে পরিবারগুলোর।
শুধু জেলে পরিবারে যে সংকট তা নয়। নীলফামারী জেলায় আমিষের চাহিদা পূরণে ঘাটতি রয়েছে মাছের। কমেছে উৎপাদনও।
জেলা মৎস্য অফিস সূত্র জানায়, জেলায় প্রায় সাড়ে ৩২ হাজার মেট্রিক টন মাছের চাহিদা রয়েছে। এরমধ্যে উৎপাদন হয় প্রায় ২০ হাজার মেট্রিক টন। সরকারি হিসেবে এখোনো ঘাটতি থাকছে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার মেট্রিক টন।
মৎস্যের সাথে নীলফামারী জেলায় ৩২ হাজার ১৫০ জন জড়িত থাকলেও এখন পর্যন্ত নিবন্ধনের আওতায় এসেছে মাত্র ৬ হাজার ২২২ জন। তারা আবার কোনো সুবিধার আওতায় পড়েনি।
জেলে পরিবারদের সংকটের এই সময়ে খাল বিলগুলো পুনঃখনন করা এবং দেশের বৃহৎতম সেচ প্রকল্প তিস্তার খালকে ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছেন মৎসজীবী নেতারা।
নীলফামারী সদর উপজেলা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি গেদন চন্দ্র দাস জানান, ভরে যাওয়া খাল বিল আর জলাশয়গুলো পুনঃখনন করে মাছ চাষ করা হলে আত্মসামাজাকি পরিবর্তন ঘটবে জেলে পরিবারগুলোর।
তবে জেলা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি মিজানুর রহমান বাদল জানান, জেলে পরিবারগুলোতে এখন চলছে দুর্দিন। তারা অসহায় হয়ে পড়েছেন। তাদের জন্য সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করা দ্রুত প্রয়োজন। মৎস্যচাষীরা অভাবে থাকার ফলে মাছের উৎপাদন হচ্ছে না অন্যদিকে মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে আমিষের চাহিদা পূরণে।
তিনি জানান, তিস্তার খালে ৫০ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হয়েছিলো তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। আরো বেশি উৎপাদন করা সম্ভব। বর্তমান নির্বাচিত সরকার জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এদিকে সুনজর দিবেন।
জানতে চাইলে নীলফামারী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আব্দুর রউফ জানান, শুষ্ক মৌসুমে প্রায় পানিশূন্য হয়ে পড়ে নদ-নদী, খাল-বিলগুলো। যার কারণে আর্থিক দৈন্যতায় পড়েন জেলে পরিবারগুলো।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন